জীবনী মুসলিম মনীষী

তাবলীগ জামাতের সোনালী কণ্ঠস্বর ছিলেন মাওলানা ওমর পালনপুরি [রহ.]

লিখেছেন মিরাজ রহমান

দীনদার-খোদাভীরু ওস্তাদের নেক সোহবতে…
এমন দরদি, এমন দীনদার-খোদাভীরু ওস্তাদ না হলে কি ইলমে অহির সঠিক ‘সবক’ লাভ করা সম্ভব? কখনো সম্ভব না। ওস্তাদ বা শিক্ষক যদি দীনদার-সৎ এবং খোদাভীরু-আল্লাহওয়ালা না হন, তাঁর কাছ থেকে ইলমে অহির সঠিক সন্ধান লাভ করা কখনও সম্ভব না। আবার সেটা যখন হয় কোরান হাদিসের ইলম— অসম্ভব হওয়ার পরিমাণ আরো বেড়ে যায়। কবির ভাষায় বলতে গেলে এভাবেই বলতে হয়, ‘বে ইশকে নবি যিছ নে দিয়া দরসে বোখারি, আতি হায় বোখার উছ ছে বোখারি নেহি আতি।’

ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন । বাবাকে হারানোর পর মায়ের আচলই ছিল তাঁর একমাত্র অবলম্বন, একটি মাত্র নিশ্চিত ঠিকানা। মাওলানা ওমর পালনপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর মা অত্যন্ত ধার্মিক একজন মহীয়সী নারী ছিলেন। ইসলামের প্রতি ভালোবাসা এবং আল্লাহ মহানের প্রতি অগাধ বিশ্বাস নিয়ে জীবন চলার পথে কঠিন থেকে কঠিনতর পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন তিনি। মাওলানা ওমর পালনপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর মায়ের বড় ইচ্ছা ছিল, ছেলে একদিন বড় আলিম হবে। ইসলামের দায়ি বেশে বিশ্বময় ঘুরে বেড়াবে এবং মানবতার সেবায় নিয়োজিত থাকবে চিরকাল। নববি আদর্শের বাহক হবে আমার ওমর। খুব কষ্ট করে, একবেলা খেয়ে আর একবেলা উপোষ থেকে ছেলের পড়ালেখার খরচ জোগাতেন মা। একবার গ্রামের মাওলানা হাফিজ জালালপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] নামক এক ওস্তাদের কাছে ছেলেকে নিয়ে গেলেন তিনি এবং বললেন, ‘হুজুর! আমার ছেলেটা একজন হক্কানি আলিম হোক— এটাই আমার মনোবাসনা। আল্লাহর ওয়াস্তে আপনি যদি ওকে গ্রহণ করতেন, খুব খুশি হতাম আমি। যে ভাবেই হোক, আমি ওর খরচ বহন করবো, ইনশাল্লাহ।’ একজন মায়ের ‘দীনদারিয়াতপূর্ণ’ এমন অনুরোধ শুনেই ওমরকে পড়ানোর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন শায়খ আব্দুল হাফিজ জালালপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। বিষয়টি মোটেও একতরফা নয়, শায়খ আব্দুল হাফিজের ভাষ্য, ‘ওমরকে দেখেই আমার সাহাবা আজমাইনের কথা স্মরণ হলো। আমি ওর মাঝে নববি আদর্শের ‘নূরানিয়াত’ দেখেছি। ওকে দেখেই আমার মনে হয়েছে, এই ছেলে একদিন ইসলামের অনেক বড় খাদেম হবে।’

ইলমে অহি অর্জনের পবিত্র জীবন হলো শুরু
ওস্তাদ আব্দুল হাফিজ জালালপুরির অনুগ্রহে শিক্ষা গ্রহণ করার ঠাঁই মিললো ওমরের। শুরু হলো ওমরের ইলমে অহি অর্জনের পবিত্র জীবন। খেয়ে না খেয়ে মা ছেলের জন্য মাসিক খরচ পাঠাতেন আর ছেলে এ দিকে ইলমে অহি শিক্ষা করেতো। মাস শেষে ওস্তাদকে দেওয়ার জন্য মাওলানা ওমর পালনপুরির মা যখন পাঁচ রুপি নিয়ে আসতেন, শায়খ আবদুল হাফিজ জালালপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] তখন কেঁদে কেঁদে বলতেন, ‘মাগো! ওমরকে আমি দুনিয়ার জন্য কিছু শিখাচ্ছি না, ওকে আমি আখিরাতের জন্য শিক্ষা প্রদান করছি। আমার কোনো খরচ লাগবে না।’

মাওলানা আবদুল হাফিজ [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ছিলেন বলে ওমরের মায়ের টাকা ফিরিয়ে দিতেন এমনটি নয়; আর্থিকভাবে সম্পূর্ণ অস্বচ্ছল একজন মানুষ হওয়ার পরও ‘লিল্লাহিয়াতান’ ইলমে অহি প্রদান করেছেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহওয়ালা ‘মুখলেস’ বান্দা ছিলেন হজরত জালালপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। মাওলানা ওমর পালনপুরির জীবনে ওস্তাদের এই ‘মুখলিসানা’ স্বভাব বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। দুনিয়াবি চাহিদা পূরণের জন্য বড় ধরণের তেমন কোনো আয়োজন গ্রহণ করেননি মাওলানা ওমর পালনপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]।

প্রাথমিক শিক্ষা এবং তাবলিগি পথচলার সূচনা
ওস্তাদ মাওলানা আবদুল হাফিজ [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর কাছে প্রাথমিক পর্যায়ের কিতাবাদি অধ্যয়ন করার পর তাঁরই তত্ত্বাবধানে ১৯৪৪ সালে ভারতের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম দেওবন্দ মাদরাসায় ভর্তি হলেন মাওলানা ওমর পালনপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। প্রখর মেধাবী ও পরিশ্রমী ছাত্র ছিলেন মাওলানা ওমর। দিন-রাত মিলিয়ে ২০ থেকে ২২ ঘণ্টা পড়াশুনা করার রেকর্ডও রয়েছে তাঁর জীবনে। পারিবারিক সমস্যার কারণে একবার সাময়িকভাবে পড়াশুনা ত্যাগ করেছিলেন তিনি। একটি মসজিদে ইমামতি করতেন এবং সেখান থেকে যে সামান্য অর্থ পেতেন, তা দিয়ে মায়ের খরচ চালাতেন। ছাত্রজীবন থেকেই দাওয়াতে তাবলিগের সঙ্গে স¤পর্ক ছিল তাঁর। এরই সুবাদে তাবলিগ জামাতের দ্বিতীয় আমির মাওলানা ইউসূফ কান্দলভি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর সঙ্গে পরিচয় হয় এবং এই পরিচয় এক সময় আন্তরিকতার রঙ্গিন পৃথিবীতে প্রবেশ করে।

মাওলানা ইউসূফ [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর পরামর্শে ১৯৫৫ সালে দ্বিতীয়বার এসে দেওবন্দ মাদরাসায় ভর্তি হন ওমর পালনপুরি এবং সেখান থেকে ‘দাওরায়ে হাদিস’ জামাত সমাপ্ত করেন তিনি। মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] ছিলেন তাঁর হাদিসের ওস্তাদ। মাওলানা মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর কাছেই হাদিস শাস্ত্রের বড় বড় কিতাবগুলো অধ্যয়ন করেছেন মাওলানা ওমর পালনপুরি। হাদিসশাস্ত্রসহ বিভিন্ন শাস্ত্রে বেশ পান্ডিত্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেলিন তিনি। পড়াশুনা করতেন এবং পাশাপাশি জড়িত ছিলেন দাওয়াত ও তাবলিগের কাজেও। রমজানের ছুটিতে ছুটিতে চিল্লায় যেতেন তিনি। অভাবী ছাত্র ছিলেন মাওলানা পালনপুরি, মাঝে মাঝে তেলের অভাবে রাস্তার লাইট পোস্টের বাতিতে পড়তেন।

মায়ের অবদানে ধন্য একটি জীবন
বেশ কয়েকজন ভুবনবিখ্যাত আলিম এবং আল্লাহওয়ালা একজন মায়ের ঐকান্তিক দোয়া ও নিজস্ব আগ্রহ-কোরবানির বদৌলতে আল্লাহ মহানের ‘কবুলিয়াত’ প্রাপ্ত হয়েছেন মাওলানা ওমর পালনপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। প্রিয়তম প্রভুর দানে ধন্য হয়েছে তাঁর জীবন-বাসর। মাওলানা ওমর পালনপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর গোটা জীবন তাঁর মায়ের অবদান এবং কোরবানিতে সমৃদ্ধ ছিল। মায়ের অবদান-দোয়া এবং ভালোবাসায় সিক্ত ছিলেন তিনি। এমন একজন আল্লাহওয়ালা মায়ের কোলে মাওলানা ওমর পালনপুরির মতো সুযোগ্য সন্তান জন্মানোটাই স্বাভাবিক। পৃথিবীর ইতিহাসের সোনালি অক্ষরে খচিত থাকবে এই ইতিহাস-অবদান। একজন আল্লাহওয়ালা দরদি মা এবং একজন ইলম পিপাসু মাতৃভক্ত সন্তানের গল্প।

একবার ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন মাওলানা ওমর পালনপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর মা। বেশ কিছুদিন বেহুঁশ অবস্থায় পড়েছিলেন বিছানায়। প্রতিবেশীরা কেউ কেউ এসে বললো, ‘আমরা না হয় ওমরকে খবর পাঠাই?’ তাঁর মা তখন বলেছিলেন, ‘ না, না ওমরকে কেউ তোমরা খরব দিয়ো না। আমি তাকে দীনের পথে পাঠিয়েছি। আমার ছেলে এখন দীন শিখছে। কিয়ামতের দিন আমি যদি জিজ্ঞাসিত হই যে, কি নিয়ে এসেছি আমি? তখন আমি বলবো, হে আমার প্রভু! আমি আমার ওমরকে নিয়ে এসেছি।’ ১৯৫৫ সালে মাওলানা ওমর পালনপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর মা ইনতিকাল করেন। মায়ের মৃত্যুর রাতে স্বপ্ন দেখলেন মাওলানা ওমর। তিনি দেখলেন, তাঁর মা তাকে ডেকে বলছে, ‘বাবা ওমর! আনা ফিল জান্নাহ।’ সুবহানাল্লাহ! কত সুন্দর মৃত্যু!! কত সুন্দর স্বপ্ন!!!

সুললিত কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন তিনি
সুললিত কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন মাওলানা ওমর পালনপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বয়ান শুনলেও মন ভরতো না। অপলক নয়নে দর্শক-শ্রোতারা তাকিয়ে থাকতো এবং তাঁর বয়ান শুনতো। মাওলানা ওমর [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর কোরান তেলাওয়াতও ছিল সুমধুর। কোরানের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিল তাঁর। ছোটবেলায় পবিত্র কোরান হিফজ করতে পারেননি বলে থেমে থাকেননি তিনি। ইতিহাসবিদদের বর্ননা অনুযায়ী ৬৫ বছর বয়সে তিনি পবিত্র কোরান হিফজ করেছেন বলে জানা যায়। শ্রুতিমধুর কণ্ঠে বয়ান করতেন বলে তাবলিগ জামাতের ‘সোনালি কণ্ঠস্বর’ বলা থেকো মাওলানা ওমর পালনপুরিকে [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। কেবল সুরের মোহনীয়তাই নয়, ইলমি প্রজ্ঞা এবং অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ ছিল মাওলানা ওমর পালনপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর বয়ান। তাঁর এই সুবক্তা হওয়ার স্বীকৃতি প্রদান করতে গিয়ে দারুল উলূম দেওবন্দের সাবেক মুহতামিম মাওলানা মারগুবুর রহমান [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] বলেছিলেন, ‘আল্লাহ মাওলানা ওমর পালনপুরির মুখে ‘নূর’ দান করেছিলেন। তাঁর বয়ানে লক্ষ লক্ষ মানুষ হেদায়েতের নূর লাভ করেছে।’

তাবলিগ জামাতের ইজতেমাগুলোতে মাওলানা ওমর পালনপুরির বয়ান শোনার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো। বয়ানের মধ্যে তাবলিগ জামাতের ব্যাপারে একটি কথা সব সময় বলতেন মাওলানা ওমর পালনপুরি। আর সেটা হলো, তিনি বলতেন, ‘ইয়ে এইছা এক কাম হায়, যিছ কা কোয়ি মোকাবিলা নেহি। মরতে মরতে কর যা, অরনা করতে করতে মর যা।’ মাওলানা ওমর পালনপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর ইনতিকালের পর পাকিস্তান তাবলিগের মুরুব্বি হাজি আব্দুল ওহাব সাহেব এক শোকবার্তায় লিখেছিলেন, ‘মাওলানা ওমর পালনপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] তাবলিগের ইজতেমাগুলোর নূর ও বরকত ছিলেন। তাঁর ইনতিকালে বিশ্ব তাবলিগ জামাতের যে ক্ষতি সাধিত হলো, তা পূরণ হওয়ার নয়।’

পালনপুরের পালনপুরি— তাবলিগের চিরউৎসর্গিত একটি প্রাণ
১৯২৯ সালে ভারতের ‘পালনপুর’ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন মাওলানা ওমর পালনপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। পিতার নাম ওয়াজিরুদ্দিন। ১৯৫২ সালে মাওলানা ইউসূফ কান্দলভির [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] পরামর্শে প্রথম জামাতে বের হন মাওলানা ওমর, যদিও তাবলিগ জামাতের সঙ্গে তাঁর স¤পর্ক ছিল আরো আগে থেকেই। দেওবন্দ মাদরাসার ছাত্র থাকাকালীন বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষকে দীনের দাওয়াত দিতেন তিনি। দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে প্রায় শতাধিক দেশে সফর করেছেন মাওলানা পালনপুরি। হজের সফর ছাড়া প্রতি বছর অসংখ্যবার বিভিন্ন দেশে সফরে যেতেন বলে জানা যায়।

মোটকথা, দাওয়াত ও তাবলিগের পথের চিরউৎসর্গিত একটি প্রাণ ছিলেন মাওলানা ওমর পালনপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। মুসলিম উম্মাহর ইমানি জাগরণের জন্য জীবনব্যাপী দীনের পথে সফর করেছেন এবং মানুষকে দীনের পথে আহ্বান জানিয়েছেন। হজরত মাওলানা ইউসূফ কান্দলভি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] থেকে শুরু করে হজরতজি মাওলানা এনামুল হাসান [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] আমির থাকাকালীন পর্যন্ত পুরোটা সময় জামাতে তাবলিগের একনিষ্ঠ একজন খাদেম হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। এতো ইলম, এতো অর্থ-স¤পদের মালিক থাকার পরও কোনো প্রকারের কোনো অহংকার, দাম্ভিকতা ছিল না তাঁর মাঝে। ছিল না কোনো প্রকার বাড়তি চাহিদা। উত্তম চরিত্রের মাধুর্যতায় পরিপূর্ণ ছিল তাঁর আখলাক। নববি আদর্শে উজ্জীবিত ছিল তাঁর জীবন-সংসার।

জামাতে তাবলিগের খতিব
মাওলানা ইউসূফ [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর সাথে মাওলানা ওমর পালনপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] খুব হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। দাওয়াত ও তাবলিগের কাজের বাহিরেও মাওলানা ইউসূফ [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর পরামর্শে জীবন যাপন করেছেন তিনি। এককথায়, মাওলানা পালনপুরির একজন বিশেষ পরামর্শদাতা-মুরুব্বি ছিলেন মাওলানা ইউসূফ [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। মাওলানা ইউসুফের নির্দেশনায় দাওয়াতের কাজে যুক্ত হয়ছেন তিনি এবং তাঁরই রাহবরিতে তাবলিগি সফরে পাড়ি জমিয়েছেন দেশ-বিদেশে। এমন এক ব্যক্তিত্ব তিনি, যিনি ছিলেন সবার প্রিয়পাত্র, সদা হাস্যোজ্জ্বল একটি মুখ— মাওলানা ওমর পালনপুরি। কোরআনে কারিমের খুব আশেক ছিলেন তিনি।

তাঁর তেলাওয়াত ছিল হৃদয়স্পর্শী। বয়ান ছিল দর্শক আকর্ষী। ওলামায়ে কেরামের মাঝে এমন আবেগময় ভাষায় তিনি বয়ান করতেন— যার তুলনা নেই। অনেক সময় তিনি শুধু কোরআনের আয়াত দিয়েই বয়ান করতেন। ৩-৪ ঘণ্টা বয়ান করলেও তন্ময় হয়ে শুনতেন দায়িগণ। বিশ্ব তাবলিগের সব জলসা, সব ইজতেমাতে মাওলানা পালনপুরির বয়ান থাকতোই থাকতো। এককথায় বিশ্ব তাবলিগের খতিব বলা হতো মাওলানা পালনপুরিকে। দাওয়াত ও তাবলিগের একটি জীবন্ত মিম্বর ছিলেন তিনি। তাঁর এই অবদানের কাছে চিরঋণী তাবলিগ জামাত, চিরঋণী জামাতে তাবলিগের লক্ষ-কোটি সাথী-মুহিববিন। সারা বিশ্বে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমাগুলোতে মাওলানা পালনপুরির বয়ান ছিল কেন্দ্রবিন্দু। মাওলানা পালনপুরির বয়ানে কান্নার ঢল নামতো শ্রোতাসমুদ্রে। বাংলাদেশের টঙ্গী ময়দানের বিশ্ব ইজতেমায় তাঁর আবেগময় বয়ানের সুরের ধ্বনি আজও চিরভাস্বর।

পারিবারিকভাবে ব্যবসায়ী ছিলেন হজরত পালনপুরি
মাওলানা পালনপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] পারিবারিকভাবে ব্যবসায়ী ছিলেন। একজন পেশাদার ব্যবসায়ী ছিলেন তাঁর পিতা। পিতার ব্যবসার কারণে পালনপুর ছেড়ে মোম্বাই চলে এসেছিল তাঁর পরিবার। ব্যক্তিগত জীবনে বাবার পেশাকে অনুসরণ করে মাওলানা ওমর পালনপুরিও [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] ব্যবসায় অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং আল্লাহ মহানের ইচ্ছায় খুব অল্প সময়ে ব্যবসায় ভালো উন্নতি অর্জন করেছিলেন তিনি। আল্লাহ তাঁকে ব্যবসায় বরকত দিয়েছিলেন। ব্যবসায়ী আলিম হিসেবে পরিচিতি ও খ্যাতি ছিল তাঁর। ব্যবসায়ী ছিলেন বটে কিন্তু আচার-আচরণ ও স্বভাব-আদর্শে একজন খাঁটি আলিম ছিলেন তিনি। এতো অর্থ-বিত্ত থাকার কোনো প্রকারের কোনো ছাপ পরিলক্ষিত থেকো না। তাঁর মাঝে ছিল না কোনো অহংকার, ছিল না কোনো টাকার গরিমা।

প্রথম হজ এবং কিছু তাবলিগি সফর
১৯৫৭ সালে প্রথম হজ করেন মাওলানা পালনপুরি। এছাড়া আরো বেশ কয়েকেবার পবিত্র হজব্রত পালন করেছেন তিনি। হজের সফর ছাড়া তাবলিগের সফরে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিশ্বময়। ১৯৫৯ সালে মিশর, লিবিয়া, মরক্কো এবং ১৯৬০ সালে সিরিয়া ও অন্যান্য আরব রাষ্ট্রে সফর করেন তিনি। দাওয়াত ও তাবলিগের জন্য মাওলানা মুহাম্মদ ওমর পালনপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর জীবন ওয়াকফ ছিল। একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, দাওয়াতি কাজে প্রায় ৮০ বার বিদেশ সফর করতে হয়েছে মাওলানা পালনপুরিকে। ৪০ বছর যাবত একাধারে দেশে দেশে আম বয়ান ও খাস বয়ান করেছেন তিনি।

মাওলানা পালনপুরির একটি বিখ্যাত বাণী
বিভিন্ন বয়ান ও বিভিন্ন আলোচনায় নানানমুখি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতেন মাওলানা ওমর পালনপুরি। তাঁর প্রতিটি বয়ানই ছিল কয়েক লক্ষ বাণীর সমষ্টি। দাওয়াত ও তাবলিগের কাজের ব্যাপারে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও দর্শনসিক্ত কথা বলতেন মাওলানা পালনপুরি। তাঁর এইসব বাণী বা কথামালার মাঝে একটি বাণী বা কথা চিরায়ত হয়ে আছে। তাবলিগ জামাতের কাজের জন্য একটি অমোঘ উচ্চারণ তাঁর সেই কথাটি। প্রায়ই বয়ানে এবং তাঁর প্রায় সব আলোচনাতে এই কথাটি তিনি বলতেনই। এমন কোনো বয়ান বা এমন কোনো মজলিস নেই যেখানে তিনি এই কথাটি বলতেন না। বাণীটি হলো— মূল উর্দূ : ‘মরতে মরতে কর যা, করতে করতে মর যা।’ বাংলা অনুবাদ : মরতে মরতে করো (তাবলিগের কাজ) এবং করতে করতে মৃত্যুবরণ করো।

যাওয়ার জন্য আসা; তাই চলে যাওয়া…
মুসলিম উম্মাহর জাগরণে মানুষের কল্যাণে জীবনব্যাপী দাওয়াতি কাজ করেছেন মাওলানা ওমর পালনপুরি। দাওয়াত ও তাবলিগের জন্য চিরউৎসর্গিত একটি সত্তা ছিলেন তিনি। সর্বশ্রেণির মানুষের প্রিয়ভাজন মাওলানা পালনপুরি ১৯৯৭ সালে ইনতিকাল করেন। ১৯৯৭ সালের ২১ মে চিরতরে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন জামাতে তাবলিগের সোনালি কণ্ঠস্বরখ্যাত মাওলানা ওমর পালনপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। চলে গেলেন কিন্তু আর ফিরে এলেন না। ফিরবেনও না আর কখনও। কারণ ওখান থেকে আর ফেরা যায় না। না ফেরার দেশ ওপার। আর কখনো ফিরে আসবেন না তিনি এবং আর কখনো মধুর কণ্ঠে ইজতেমায় বয়ান করবেন না মাওলানা পালনপুরি। কারণ, যেখানে গিয়েছেন তিনি, একবার সেখান গেলে থেকে আর ফিরে আসা যায় না। তাই তিনিও আর আমাদের মাঝে ফিরলেন না এবং ফিরবেন না কোনোদিন। যেখানে, যার সান্নিধ্যে তিনি চলে গেছেন, ফেরা-না ফেরার মালিক তিনি, বিশ্ববিধাতা মহান আল্লাহ। ###

Comment

লেখক পরিচিতি

মিরাজ রহমান

গতানুগতিক ধারার বাইরে থেকে কাজ করে ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন মিরাজ রহমান। পেশায় পুরোদস্তুর একজন সাংবাদিক হলেও কেবল ইসলামকে ঘিরেই আবর্তিত তার ধ্যান-জ্ঞান। দৈনিক পত্রিকার ইসলাম পাতায় লেখালেখি থেকে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন বটে, কিন্তু একসময় শিল্প চর্চায়ও ছিলেন বেশ মনোযোগী।
মিডিয়ায় সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেছেন যখন, তখনও তিনি ছাত্র। মাদানিনগর মাদরাসার কাফিয়া জামাতের (শ্রেণি) শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় কণ্ট্রিবিউটর হিসেবে প্রথম কাজ শুরু করেন দৈনিক যুগান্তরে। ধারালো লিখনী শক্তি অল্পদিনের মধ্যে পরিচিত করে তোলে তাকে। দেশের জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রায় সবগুলোতেই ইসলামবিষয়ক কলাম ও ফিচার লিখেছেন দীর্ঘ সময়। জাতীয় প্রিন্ট মিডিয়াগুলোতে তার অন্তত দুই সহস্রাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
মিরাজ মূলত পড়াশুনা করেছেন কওমি শিক্ষাধারায়, এর পাশাপাশি তিনি জেনারেল শিক্ষাধারায়ও পড়াশুনা করছেন। সহ-সম্পাদক হিসেবে প্রথম যোগদান করেন দৈনিক ডেসটিনি পত্রিকায়। সেখান থেকে দৈনিক কালের কণ্ঠে। দেশে-বিদেশে অনলাইন গণমাধ্যমের জয়যাত্রা শুরু হলে মিরাজ ইন্টারনেট জগতকে ইসলাম প্রচারের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র বিবেচনা করে অনলাইনেই গাঁটছাড়া বাঁধেন। দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইসলামবিষয়ক অনলাইন পোর্টাল প্রিয়.কমের ‘প্রিয় ইসলাম’-এর সৃষ্টি ও পথচলার সূচনা তারই হাতে। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন প্রিয়.কমের প্রিয় ইসলাম বিভাগের এডিটর ইনচার্জ। সর্বশেষ কর্মরত ছিলেন দৈনিক বাংলাদেশের খবরের ফিচার ইনচার্জ হিসেবে।
টেলিভেশনে অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা ও আলোচনার সঙ্গেও ইতিমধ্যে যুক্ত হয়েছেন মিরাজ রহমান। পরিচালনা করেছেন বেশ কিছু অনুষ্ঠানও। এসো কলম মেরামত করি, ছোটদের নবী-রাসূল সিরিজ, তাবলিগী জামাতের পৃষ্ঠপোষক-মুরুব্বি ছিলেন যাঁরা, শরয়ী পর্দার বিধান, আশিক মিন ফিলিস্তিন, নারী তুমি সৌভাগ্যবতী ও হালাল ব্যবসা ও হালাল অর্থনীতির কথকতাসহ বেশ কিছু আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থেও জনক তিনি। বর্তমান তিনি ইসলাম প্রতিদিনের সম্পাদক ও প্রকাশক এবং দ্য সুলতান প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।