নতুন দীনি ব্যক্তিত্ব, নতুন এক সান্নিধ্যের খোঁজে
তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর সঙ্গে আবুল হাসান আলি নদভির সাক্ষাৎ এবং সম্পর্কের সূচনাও হয়েছিলো একটি দীনি অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে। ১৯৩৯ সালে মাওলানা আলি মিয়া [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] তাঁর সাড়া জাগানো গ্রন্থ ‘সীরাতে সাইয়িদ আহমাদ শহিদ’ প্রকাশিত হলে তিনি গ্রন্থখানি তাঁর সাথী বিখ্যাত আলেম ও আল-ফুরকান স¤পাদক হজরত মাওলানা মনজুর নোমানি সাহেবের নিকট পাঠিয়ে দেন। হজরত নোমানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] কিতাবখানি পড়ে এতোই মুগ্ধ হন যে, সাথে সাথে লেখককে পত্র লিখে মোবারকবাদ দেন এবং একটি আবেগ প্রকাশ করেন যে, আসুন আমরা কোনো নতুন দীনি আন্দোলন গড়ে তুলি। নোমানি সাহেবের এ আহবানে সাড়া দিয়ে আলি মিয়া তাঁর বন্ধু হাজি আবদুল ওয়াহেদসহ নোমানি সাহেবের সাথে মিলিত হন। দীর্ঘ আলোচনার পরে তারা সিদ্ধান্ত নেন যে, তারা প্রথমে কয়েকটি দীনি মারকাজ পরিদর্শন করবেন। সে-সকল স্থানের কোন কাজ তাদের পছন্দমত হলে তাঁরা সেখানেও সহযোগিতা করবেন। এর কয়েক মাস পূর্বে মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের দাওয়াত ও তাবলিগের উপর মাওলানা মওদুদির একটি শক্তিশালী প্রবন্ধ মাসিক তর্জমানুল কোরান পত্রিকায় ‘একটি গুরুত্বপূর্ণ দীনি আন্দোলন’ নামে প্রকাশিত হয়েছিলো। জনাব মওদুদি স্বয়ং নিজামুদ্দিন ও মেওয়াত সফর করেছিলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি নিজে কিছু পরামর্শ দিয়ে এই দীনি প্রচেষ্টার পরিচয় করিয়েছিলেন এবং এ সম্পর্কে তাঁর গভীর অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন।
উল্লেখ্য, সমসাময়িক হওয়ার সুবাদে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদুদির প্রতি এক সময় আলি নদভি সুধারণা পোষণ করতেন। কিন্তু পূর্বসূরী বুজূর্গানে দীন ও মনীষীগণের প্রতি মওদুদির লাগামহীন সমালোচনা, সুন্নাতের পাবন্দির অভাব এবং ইসলামের মৌলিক কিছু বিষয়ে ভুল ব্যাখ্যার ফলে জামায়াতে ইসলামী ও মওদুদি সাহেব সম্পর্কে তাঁর ধারণা পাল্টে যায়। যাই হোক, হজরত আলি মিয়া এ প্রবন্ধটি পড়ে খুবই অনুপ্রাণিত হন। তিনি সাইয়িদ সুলায়মান নদভি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর সাথে এক সফরে থানেশ্বরে হজরত মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের নাম এবং তাঁর তাবলিগি প্রচেষ্টার কথা সর্বপ্রথম শুনেছিলেন। তবে হজরতজির সাথে মাওলানা মনজুর নোমানির [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] পরিচয় পূর্বেই হয়েছিলো।
১৯৩৯ সালের শেষদিকে তাঁরা তিনজন সর্বপ্রথম সাহারানপুর রওয়ানা হন। সেখানে তখনকার বিখ্যাত শায়খ হজরত মাওলানা আবদুল কাদের রায়পুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর খেদমতে উপস্থিত হন। হজরত রায়পুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] তাদের উদ্দেশ্য শুনে খুবই খুশি হন। তিনি বলেন, আমার বয়স তো অনেক হয়েছে, আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি। আপনারা সর্বপ্রথম নিজামুদ্দিন গিয়ে হজরত মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর সাথে মোলাকাত করুন এবং তাঁর তাবলিগি মেহনত দেখুন। কাজ সম্পর্কে নিশ্চিত হলে এ কাজেই লেগে যান। হজরত আলি মিয়া রায়পুর থেকে দেওবন্দ হয়ে সোজা দিল্লি হাজির হন। সেখান থেকে মেওয়াতও সফর করেন। সফর থেকে ফিরে এসে তিনি এক প্রবন্ধে লেখেন যে, আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছি, মেওয়াত এলাকায় হজরত মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর তাবলিগি কাজ যেন বিংশ শতাব্দির কোনো দৃশ্য নয়; হিজরি প্রথম শতাব্দি, মহানবির [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] যুগের মানুষের যে অবস্থা এবং তাদের ইসলাম গ্রহণের যে সকল জঝবার কথা আমরা সীরাত গ্রন্থসমূহে পড়েছি, মেওয়াতের গোক্ষানের জামে মসজিদ, কসবায়ে নূহ ও শাহপুরের গলিসমূহে তাঁরই নমুনা বিরাজ করছে। বাস্তবতা এই যে, এই চিশতি দরবেশ নিজামুদ্দিনে হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজারের পাশে বসে হজরত খাজা মঈনুদ্দিন আজমিরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর ইসলাম প্রচার এবং হজরত মুজাদ্দেদি সেরহেন্দি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] ও সাইয়িদ আহমাদ শহিদ বেরেলভি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর ইসলাম হেফাজতের আদর্শ পুনরুজ্জীবিত করেছেন।
১৯৪০ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি যখন নিজামুদ্দিন হাজির হন তখন হজরত মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] সাহারানপুরে কোনো এক তাবলিগি ইজতেমায় গিয়েছিলেন। মারকাজ থেকে তাকে জানানো হয় যে, হজরতজি ১/২ দিন পর নিজামুদ্দিন ফিরে আসবেন। ঐ সময় নিজামুদ্দিনের কাজের দায়িত্বে ছিলেন মাওলানা এহতেশামুল হাসান কান্দলভি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। তিনি হজরত মাওলানাকে মেওয়াতের নূহ এলাকায় ইজতেমায় পাঠিয়ে দেন। কিন্তু হজরতজির সাথে সাক্ষাতের জযবা তাকে পাগল করে তোলে। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন— তখন আমার অবস্থা এমন হয়েছিলো যে, মনে হচ্ছিলো আমি দরজা খুলে নিজামুদ্দিনের দিকে দৌঁড় দেই। পরে তিনি নিজামুদ্দিনে ফিরে এলে হজরতজি আলি মিয়ার সাথে এমনভাবে মিলিত হন যেন বহু বছরের পরিচিত মানুষ; যেন আলি মিয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুণছিলেন তিনি। তিনি যখন জানলেন যে, আলি মিয়া সীরাতে সাইয়িদ আহমেদ শহিদের লেখক এবং শহিদ বেরেলভির [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] সাথে তাঁর খান্দানি স¤পর্ক রয়েছে, তখন তিনি মহব্বত ও মেহমানদারিতে আরো এক ধাপ এগিয়ে যান। সর্বপ্রথম মাওলানা আলি মিয়া [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-কে আকর্ষণ করেছিলো, হজরতজির অন্তরের বিশেষ অবস্থান। প্রথম সাক্ষাৎ হওয়া সত্ত্বেও কোন অপরিচিত ভাব পরিলক্ষিত হয়নি। তৃতীয় দিন মাওলানা আলি মিয়া [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর বিদায়কােেল হজরতজি দীর্ঘক্ষণ তাঁর জন্য দোয়া করেন।
লাখনৌতে দাওয়াতি কাজের সূচনা
মাওলানা আলি মিয়া [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] লাখনৌ এসেই মেওয়াতের মেহনত অনুযায়ী শহরের আশেপাশে তাঁর সাথে ব্যক্তিগতভাবে জড়িত কয়েকজন ছাত্রকে সাথে নিয়ে কাজ শুরু করেন। লাখনৌ শহরের গরিব মহল্লাগুলিতে যাতায়াত করতে থাকেন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া দীন-ঈমান পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন; সাথে সাথে হজরতজির নিকট পত্র মারফত বিস্তারিত জানাতে থাকেন। ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে হজরতজির প্রথম পত্র আসে। এভাবে চিঠিপত্রের ধারাবাহিকতা শুরু হয়ে যায়। এসকল চিঠিতে হজরতজি আলি মিয়ার কাজে সন্তষ্টি প্রকাশ করেন। চিঠিতে তাকে এমনভাবে সম্বোধন করতেন যা অন্যের জন্য ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়াত। চিঠিগুলো ‘মাকাতিবে ইলিয়াস’ গ্রন্থে মুদ্রিত হয়েছে।
হজরতজির সঙ্গে সম্পর্কের কারণ
হজরতজির সাথে আলি মিয়ার গভীর সম্পর্কের অন্যতম কারণ ছিলো যে, তিনি ইতিপূর্বে মাকতুবাতে ইমামে রব্বানি, ইযালাতুল খেফা, সিরাতে মুস্তাকিম, মানসাবে ইমামত গ্রন্থাদি পড়েছিলেন। ফলে ইতিহাস ও সাহিত্যের পাঠ তাকে দুই ধরনের দাওয়াতি প্রোগ্রাম ও কর্মপদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য করতে শিখিয়েছিলো যে, একটির স¤পর্ক শুধু মেধা, অধ্যবসায়, বিশেষ দর্শন, আন্দোলন ইত্যাদির সাথে। অন্যটির সম্পর্ক ইবাদাত, ইনাবাত, দোয়া, কোরআনের উপর গভীর চিন্তা-ফিকির, সিরাতে নববির বাস্তবায়ন এবং উম্মতের জন্য বিশেষ চিন্তাভাবনার সাথে। মাওলানা আলি মিয়ার উপর ছিলো হজরতজির বিশেষ মনোযোগ ও মহব্বত। ফলে অল্পদিনের মধ্যে তিনি হজরতজির নয়নমণি হয়ে ওঠেন। তখনো দীনি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকগণ এ কাজে আকৃষ্ট হননি। অথচ সে সময়ই দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামার মতো ঐতিহাসিক দরসগাহের একজন শিক্ষক ও ছাত্রদের এ কাজে অংশগ্রহণ করা হজরতজির নিকট খুবই গুরত্বপূর্ণ ছিলো। এতে দারুল উলূমের মধ্যেও এক নতুন জাগরণের সৃষ্টি হয়। মাওলানা আলি মিয়া [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, আমরা নদওয়ার পক্ষ থেকে উলামা ও মাশায়েখের কাছে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলোাম, কিন্তু উল্লেখযোগ্য সাড়া পাওয়া যায়নি। হজরতজিই সর্বপ্রথম আমাদের উপর শফকতের হাত রেখেছেন।
নদওয়াতুল উলামার তাবলিগি মেহনত
দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামার ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে মাওলানা মুহাম্মাদ নাজেম নদভি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] লাখনৌর এই তাবলিগি কাজে প্রাণখোলা সহযোগিতা করেছিলেন। হজরত আলি মিয়া বৃহস্পতিবার লাখনৌ থেকে ৮ মাইল দূরবর্তী মালহর এলাকায় ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে চলে যেতেন। জুম্মার দিন মেহনতে ছাত্রদের দীনি ও ইসলাহি ফায়েদা, নামাজের একাগ্রতায় উন্নতি, জিকির ও রাত্রি জাগরণের ফায়েদা ছাড়াও ছাত্রদের কোরান-হাদিসের ভাষার বুৎপত্তি লাভে অদম্য স্পৃহা সৃষ্টি থেকো। হজরত আলি মিয়া [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] ছাত্রদের জামাতে বের হবার সময় শুধু মাত্র আরবিতে কথা বলার হুকুম দিতেন। এর দ্বারা ফায়দাও থেকো। তবু এক চিঠিতে হজরতজিকে এ ব্যাপারে জানানো হলে হজরতজি জবাবে লেখেন, ‘আরবি ভাষার সুন্নাত জিন্দা করার খবরে খুশি হয়েছি। অন্যান্য মাদরাসাকেও এ মেহনতের দিকে আকৃষ্ট করার কাজে আপনাকে আল্লাহ পাক মাধ্যম বানান— এই দোয়া করি।’ হজরতজি সব সময় মাওলানা আলি মিয়া ও তাঁর চিঠির অপেক্ষায় থাকতেন। এক চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘আপনার আগমনের সংবাদে অন্তর ভরে যায়। হক তায়ালা আমাদেরকে আপনার ব্যক্তিত্ব থেকে উপকৃত হবার তাওফিক দান করুন। অন্য চিঠিতে লেখেন যে, আপনার পত্রাবলি আমাদের হৃদয়ের তালা খোলার চাবিস্বরূপ। হজরত আলি মিয়ার অবস্থাও ছিলো এই যে, তিনি এক-দুই মাস পর পর হজরতজির খেদমতে হাজিরা দেয়ার চেষ্টা করতেন এবং মেওয়াতের বিভিন্ন ইজতেমায় শরিক থেকেন।
লাখনৌ শহরে হজরতজির আগমন
কিছুকাল পর্যন্ত এই দাওয়াতের মেহনত নদওয়ার উলামা, তালাবা ও শহরের আশেপাশের এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকার পর হজরত আলি মিয়া এই শহরের ধর্মপ্রাণ লোকদের মধ্যে এই কাজের পরিচয় করান। ফলে লাখনৌ থেকে বড় বড় জামাত নিজামুদ্দিন ও মেওয়াত যেতে থাকে। ১৯৪৩ সালের ১৮ জুলাই হজরতজি হাফেজ ফখরুদ্দীন, মাওলানা এহতেশামুল হাসান কান্দলভি, মুহাম্মাদ শফি কুরায়শি ও হাজি নাসিমসহ তাশরিফ নিয়ে আসেন। নদওয়ার অদূরে মতিমহলের পুলের পূর্বে এক সবুজ ময়দানে মেহমানগণ অবস্থান গ্রহণ করেন। আল্লামা সাইয়িদ সুলাইমান নদভি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি], মাজাহিরে উলূমের শিক্ষক মাওলানা আবদুল হক মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] ও মাওলানা মনজুর নোমানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-ও সেখানে আসেন। দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামা বন্ধ থাকায় ছাত্র বেশ কম ছিলো। মাওলানা আলি মিয়া [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] বলেন, একদিন হজরতজি আমাকে বললেন, আমাকে এমন এক স্থানে নিয়ে চলো যেখান থেকে পুরো দারুল উলূম দেখা যায়। আমি তাকে মাদরাসার ছাদের উপর নিয়ে গেলাম যেখান থেকে পার্শ্ববর্তী নদীর দৃশ্য এবং দারুল উলূমের মসজিদ, শিবলি দারুল ইকামাহ ও অন্যান্য ভবন নজরে আসে। এসময় হজরতজি ও আলি মিয়া ব্যতীত আর কেউ সেখানে ছিলেন না। হজরতজি তাঁকে বললেন, আমি দারুল উলূমের কিছু খেদমত করতে চাই, বলুন, কী খেদমত করতে পারি? মাওলানা আলি মিয়া তখন হজরতজিকে বলেছিলেন, শুধু এতোটুকু চাই যে, আপনি মাদরাসা মাজাহিরে উলূম যেভাবে দেখাশুনা করেন নদওয়াকেও সেই একই নজরে দেখবেন। হজরতজি নদওয়ার জন্য দোয়া করেন এবং নীচে নেমে আসেন।
হজরতজির মুখপাত্ররূপে
হজরতজি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] মাওলানা আলি মিয়াকে তাঁর তরজুমান বা মুখপাত্র করেছিলেন। লাখনৌতে এক বিশেষ মজলিসে হজরতজির তাকরির হয়। সেখানে শহরের উচ্চ শিক্ষিত লোকজন এবং কয়েকজন উকিল উপস্থিত ছিলেন। আলি মিয়া বুঝছিলেন যে, মেহমানরা হজরতজির কথা ভালো বুঝতে পারছেন না। তাই তিনি দাঁড়িয়ে যান এবং হজরতজির কথার সারাংশ ভালো করে বুঝিয়ে দেন। এতে হজরতজি ও উপস্থিত ব্যক্তিগণ খুবই খুশি হন। হজরতজি এই বয়ান ছাপিয়ে প্রকাশ করারও আগ্রহ প্রকাশ করেন। একবার হজরতজি মাওলানাকে ফজরের নামাজ পড়াতে বলেন। নামাজ শেষে বয়ান করারও আদেশ করেন। মজলিসে ডা. জাকির হুসাইন খানসহ বেশ কয়েকজন বিশিষ্টব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, হজরত আমার মাথার কিছুই নেই, কী বলবো? কিন্তু হজরতজি আলি মিয়ার বয়ান শুনতে তার দিকে মুখ করে বসে থাকেন। হজরতজি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] আলি মিয়াকে সবসময় কাছে কাছে রাখতেন। একবার জিম্মাদাররা হজরত আলি মিয়াকে নিজামুদ্দিনের আশেপাশে কোথাও গাশতে পাঠিয়ে দেন। হজরতজি এ খবর পেয়ে বলেন, এক ব্যক্তিই আমার কথাবার্তা কিছু বোঝে, তোমরা তাকেও বাহিরে পাঠিয়ে দিয়েছো, এখন আমি কার সাথে কথা বলবো?
তাবলিগের জন্য শিক্ষকতা থেকে অব্যাহতি
দাওয়াতি প্রোগ্রাম ও বারবার নিজামুদ্দিন যাতায়াতের ফলে দারুল উলূমের অধ্যাপনার কাজে বেশ অসুবিধা দেখা দেয়। তাই মাওলানা আলি মিয়া ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মাদরাসার চাকুরি ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং হজরতজির নিকট স্বাধীনভাবে দীনের খেদমত করার বিষয়ে পরামর্শ চান। হজরতজি বলেন, আমাদের বুজূর্গরা পুর্বের চাকুরির চেয়ে ভালো চাকুরি না পাওয়া পর্যন্ত ছাড়ার অনুমতি দেন না। তরপর তিনি জিজ্ঞেস করেন, আপনি নদওয়া থেকে কত টাকা পান? মাওলানা জবাবে বলেন, পঞ্চাশ টাকা। ‘এ রকম হাজার পঞ্চাশ টাকা আপনার গোলামদের পায়ের উপর কোরবানি হবে’— বলে তিনি অনুমতি দিয়ে দেন। পরে তিনি ১৯৪৩ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে পুনরায় দারুল উলূমে সবক পড়ানো শুরু করেন। ১৯৪৫ সালের নভেম্বর থেকে স্থায়ীভাবে দারুল উলূমের চাকুরি ছেড়ে দেন এবং দাওয়াতি মেহনতের সাথে বিভিন্ন সামাজিক ও অন্যান্য কাজ করতে থাকেন।
ব্যাপক পরিসরে তাবলিগ
১৯৪৪ থেকে ৫২-৫৩ পর্যন্ত লাখনৌর সাধারণ শিক্ষিত শ্রেণি, আইনজীবী, পেশাদার গোষ্ঠী, আলেম সম্প্রদায় ও ইউনিভার্সিটি ছাত্র-শিক্ষকদের দৃষ্টি এ কাজের দিকে দ্রুত গতিতে বাড়ছিলো। তখন লাখনৌ থেকে বিহারের পূর্বসীমান্ত কাটিহার ও পূর্ণিয়া জেলা পর্যন্ত এবং পাঞ্জাব ও কাশ্মীর পর্যন্ত হজরত মাওলানা মনজুর নোমানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর সাথে হজরত আলি মিয়া বহু দাওয়াতি সফর করেন। ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাসে মেওয়াতের গুরুত্বপূর্ণ জলসায় যোগদান ছিলো তাঁর দাওয়াতি সফরের বিশেষ অংশ। এ ছাড়া ভূপাল, লাখনৌ, কানপুর বসতি, সিতাপুর প্রভৃতি এলাকায় তাবলিগি ইজতেমায় হজরত আলি মিয়া শরীক থাকেন এবং বয়ানও করেন। ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হজরতজি মাওলানা ইউসূফ [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] এক বড় জামায়াতসহ হজরত আলি মিয়ার বাড়ি রায়বেরেলির দায়েরায়ে শাহ আলামুল্লাথেকে উপস্থিত হন। ১৯৫১ সালে তিনি দীর্ঘ এক বছর ভারতের বাহিরে মধ্যপ্রাচ্যে দাওয়াতের কাজ করে লাখনৌ ফিরে এসে জামায়াতের অবস্থা আরো সুসংহত পেয়ে খুশি হন। ফজরের পর তরবিয়তি তাকরীর থেকো। এই তাকরির সাধারণত আলি মিয়াই করতেন। যেসকল ছাত্র বছরের পর বছর এসব সাপ্তাহিক ইজতেমায় শরীক থেকো তাঁরা ফারেগ হওয়ার পর নিজের এলাকায় এবং বিদেশি ছেলেরা দেশে গিয়ে দাওয়াতি কাজ শুরু করতো। তারাও নদওয়ার ছাত্র জীবনের এই মেহনতের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে চিঠিপত্র দিতো। ১৯৪৫ সাল থেকে এই ইজতেমা কাছারি রোডের বর্তমান মারকাজে স্থানান্তরিত হয়।
হিজাযের দাওয়াতি কাজের জন্য নির্বাচন
হজরতজির অন্তরের একান্ত কামনা ছিলো যে, ভারতে কাজ কিছু এগিয়ে চললে সৌদি আরবে গিয়ে এই কাজের বুনিয়াদ পত্তন করবেন। কিন্তু সৌদি আরবের আলেম-উলামা ও শিক্ষিত শ্রেণির কাছে এ দাওয়াত পেশ করার জন্য আরবি ভাষায় দক্ষ ও দাওয়াতি কাজের সাথে মনে-প্রাণে স¤পৃক্ত আলেমের প্রয়োজন ছিলো। হজরতজির বড় ছেলে মাওলানা উবায়দুল্লাহ [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] সম্ভবত নিজামুদ্দিনে মাওলানা আলি মিয়া [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর নাম প্রস্তাব করেছিলেন। কেননা তিনি আলি মিয়ার আরবি সাহিত্যে ব্যুৎপত্তি স¤পর্কে পূর্বেই অবগত ছিলেন। ফলে হজরত মাওলানাকেই এ কাজের জন্য উপযুক্ত মনে করে হজরত শায়খুল হাদিস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর পরামর্শে ছয় মাসের জন্য সৌদি আরবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। হজরত আলি মিয়া তাঁর আম্মা, স্ত্রী, এক বোন ও ভাগ্নে মাওলানা মুহাম্মাদ সানি হাসানকে [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] নিয়ে ১৯৪৭ সালের জুলাই করাচি থেকে জাহাজে রওয়ানা হয়ে ১৯ জুলাই জেদ্দা পৌছেন। হজের বেশ দেরি থাকায় তিনি প্রথম মদিনা শরিফে উপস্থিত হন। ভাগ্নে মাওলানা সানি সাথে থাকায় তিনি সকল সাংসারিক ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে পুরো সময় দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে ব্যয় করতে থাকেন। নতুন কোন দেশে দাওয়াতের কাজ শুরুর জন্য দায়ির আবশ্যকীয় বংশ পরিচিতি ও ব্যক্তিত্বের উভয়গুণই তার মধ্যে বিদ্যমান ছিলো। কিন্তু সৌদি আরবে তখনও তাঁর কোনো পরিচিতি গড়ে ওঠেনি। এজন্য এ সফরের পূর্বেই তিনি তাঁর লিখিত এবং দিল্লিতে এশিয়ান কনফারেন্সে পঠিত একখানি আরবি পুস্তিকা সাথে নিয়েছিলেন। পুস্তিকাখানির সাহিত্যমান খুবই উন্নত ছিলো এবং দাওয়াতের তরিকাও ছিলো উচ্চ পর্যায়ের।
সৌদি আরবে তখনও পর্যন্ত দাওয়াত ও আত্মশুদ্ধিমূলক আরবি পত্র-পত্রিকা কমই পাওয়া যেতো। তবে তিনি যে সমাজের মধ্যে দীনি দাওয়াতের কাজ চালাবেন, সে সমাজের সামনে তাঁর ইমেজ যথার্থভাবেই গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং বড় বড় জ্ঞানী ও শিক্ষিত মানুষের সাথে ওঠাবসা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর আরবি ভাষা ও সাহিত্যের পা-িত্যের মাধ্যমে আরবের সে সময়ের সুধী সমাজে এই নবাগত এই ভারতীয় ইসলাম প্রচারক এবং আরবি সাহিত্যিক সবার নিকট সমভাবে সমাদৃত হয়েছিলেন। ফলে অভিজাত শ্রেণিতেও দাওয়াতের কাজ করা তাঁর জন্য সহজ হয়ে পড়ে। হজরত মাওলানা তিন মাস মদিনা শরিফে অবস্থান করে মসজিদে নববিতে তারাবিহ নামাজের পর উলামা সমাবেশে, জুমআার নামাজের পর ‘মাদরাসা শরিয়াহ’র একটি হলে এবং শহরের বিভিন্ন এলাকায় সমাবেশে বক্তব্য পেশ করেন। তাছাড়া গাশত বা ঘুরে-ফিরে দীনি কাজের জন্য সদস্য সংগ্রহসহ তাবলিগের যাবতীয় কর্মসূচীকে দ্রুত এগিয়ে নিতে সক্ষম হন। জিলকদের শেষের দিকে তিনি মক্কা শরিফে উপস্থিত হন। সেখানকার বড় বড় আলেমের সাথে হজরতের স¤পর্ক সৃষ্টি হয়। যাদের মধ্যে আল্লামা সাইয়িদ আলভি মালেকি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি], শায়খ আমিন কাতবি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি], শায়খ হাসান মুশশাত [রহমাতুল্লাহি আলাইহি], শায়খ ইবনে আরাবি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি], শায়খ মাহমুদ শাওবিল [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] এবং শায়খ আবদুর রাজ্জাক হামযা [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। মক্কা শরিফে শায়খ উমর ইবনুল হাসান আশ-শায়খ; যিনি শায়খ মুহাম্মাদ আবদুল ওহাবের বংশধর, সৌদি সরকারের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় কাযিউল কুযাত ও শায়খুল আবদুল্লাহ বিন হাসানের [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] আপন ভাই, তাঁর সাথে হজরত আলি মিয়ার [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] গভীর স¤পর্ক হয়ে যায়, যা দাওয়াতের কাজের জন্য সহায়ক হয়। শায়খ উমর মৃত্যু পর্যন্ত তাবলিগের সহায়তা করে যান। সৌদি আরবে হজরত আলি মিয়া হকের আওয়াজকে কী করে সৌদির আমির-উমারার কাছে পৌঁছাবেন তাঁর উপায় সন্ধান করতে থাকেন। তিনি সৌদি বাদশাহর নিকট অত্যন্ত আবেগের সাথে একটি পত্র লেখেন, যাতে আরবদের তৎকালীন অবস্থা, হজরত উমর ইবনে আবদুল আজিজের রাজত্বকালে খায়ের-বরকতের কথা এবং সৌদি আরবের কাছে পৃথিবী কী চায় ইত্যাদি বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। শায়খ উমর এই চিঠি সৌদি বাদশাহকে পড়ে শোনান।
আরব বিশ্বে দীর্ঘ দাওয়াতি সফর
এ সফর শুরু হয় ১৯৫০ সালের ৪ সেপ্টেম্বরে হজরত রায়পুরির [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] সঙ্গে হজ্জের সফরের সময়। হজের সফর শেষ হলে হজরত রায়পুরিকে বিদায় দিয়ে তিনি তাঁর কয়েকজন সাথী নিয়ে মক্কা মোকাররমায় দাওয়াতি প্রোগ্রাম চালাতে থাকেন। সে সময় তিনি দাওয়াতি কাজ নিয়ে আরব বিশ্বের প্রাচীন কেন্দ্রীয় মারকাজ মিশর সফর করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ১৯৫১ সালের ২০ জানুয়ারি ইসলাহি ও দাওয়াতি ছোট কাফেলা নিয়ে জেদ্দা থেকে ইটালির ওনভা জাহাজে সুয়েজ অভিমুখে রওয়ানা হন এবং মিশর উপস্থিত হন। মিসরে তিনি প্রায় ছয়মাসব্যাপী তাঁর দাওয়াতি মিশনের মাধ্যমে তৎকালীন মিশরের সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে এক নতুন জীবনের প্রেরণা জাগাতে সক্ষম হন। মিসরের পর তিনি সুদান ও দামেশক সফর করেন। এ সকল স্থানে তিনি তাঁর খোদাপ্রদত্ত যোগ্যতা দিয়ে আহলে আরবদের আধুনিক শিক্ষিত, ছাত্র, শিক্ষিক, সাহিত্যক ও সাংবাদিকদের মাঝে ব্যাপক ধর্মীয় আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এ সফরেও মাওলানা মুয়িনুল্লাহ নদভি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] ও মাওলানা মুহাম্মাদ রাবে [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] এবং মাওলানা উবায়দুল্লাহ বলিয়াভি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] তাঁর সাথে ছিলেন। মোটকথা তিনি সমাজের উঁচু শ্রেণির মধ্যে দাওয়াতি ও ইসলাহি মিশনের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করতে সমর্থ হন। ১৯৫১ সালের আগস্ট মাসে তিনি দামেশক পৌছেন। অবশেষে দীর্ঘ এক বছরের সফর শেষ করে ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে ভারতে ফিরে আসেন। ###