একটি নাম, জীবন্ত অনেকগুলো আন্দোলন…
মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] একটি নাম, জীবন্ত অনেকগুলো আন্দোলন, ভারত উপমহাদেশের স্বনামধন্য একজন আলিম, আধ্যাত্মিকপুরুষ— এমন আরো বেশ কিছু পরিচয়-অভিধায় চিহ্নিত করা সম্ভব তাঁকে। এককথায় বলতে গেলে, দীন ইসলামের প্রচার-প্রসাররের এমন কোনো শাখা-পল্লব নেই, যা মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর অবদানের বারিধারায় সিঞ্চিত হয়নি। তিনি কেবল একজন ব্যক্তি ছিলেন না; বহুমুখি গুণ-প্রতিভার অধিকারী ইসলামের সুউচ্চ এক জীবন্ত মিনার ছিলেন সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। কেবল একজন মানুষ ছিলেন না; জীবন্ত একটি ইলমি প্রতিষ্ঠান ছিলেন তিনি। সহপাঠী এবং শিক্ষকদের অনেকেই মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানিকে চলমান ইলমি লাইব্রেরি নামে আখ্যায়িত করতেন। উপমহাদেশের বরকতপূর্ণ এই জমিন-সীমানায় যে কজন বিপ্লবী আলিমে দীনের আবির্ভাব ঘটেছে, ইংরেজ বেনিয়াদের নানামুখি ‘নীল নকশা’ থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের জান-মাল-ঈমান রক্ষার আন্দোলন করেছেন যাঁরা, সাইয়িদহুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব। ইসলামি আন্দোলনের অগ্রগামী একজন সিপাহসালার ছিলেন তিনি। জীবন সাধনার নানামুখি কর্মদক্ষতা, চিন্তা-ফিকির, সংস্কার-মানসিকতা এবং গুণ-বৈশিষ্ট্যের বিচারে শতাব্দির প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারকের [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] সাথে তুলনা করা থেকো যাঁকে। মাওলানা মাদানির ব্যাপারে বিজ্ঞ অনেকের ভাষ্য এমন— ভারত উপমহাদেশের সীমানায় মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানিই একমাত্র আলিম; দীন ইসলামের সব বিষয়-দিক ও শাখা-পল্লবে সমান দক্ষতা এবং সুদীপ্ত পদচারণা ছিল যাঁর।
কিন্তু আফসোসের কথা হচ্ছে…
ইলমি খেদমত, আধ্যাত্মিক সাধনা, রাজনৈতিক আন্দোলন এবং সংস্কারমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করাসহ দীনের বিভিন্ন শাখা-পল্লবের মতো দীনের দাওয়াত ও তাবলিগের ক্ষেত্রেও সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানির [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] অবদানমূলক অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। দীনের অনেক বড় একটি সেক্টরে কর্মরত থাকা এবং বিভিন্ন আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদান করার কারণে প্রচুর ব্যস্ত থাকতে থেকো তাঁকে। তদুপরি বিভিন্ন সময় তাবলিগ জামাতের খুব গুরুত্বপূর্ণ আয়োজনগুলোতে নিজে অংশগ্রহণ করে এবং অনেক সময় ভক্ত-মুরিদানসহ ভারতের অনেক আলিমকেও তাবলিগের কাজে অংশগ্রহণ করার জন্য পরামর্শ প্রদান করেছেন মাওলানা মাদানি।
প্রতিটি কাজের কিছু নিয়ম-নীতিমালা রয়েছে। রয়েছে কিছু আদর্শগত বিচার-বিবেচনা। সবাইকে একই আকার-পরিমাপে কাজ করতে হয় না। কোনো কাজে কেউ কেউ নিয়োজিত থাকবেন পুরোপুরিভাবে; কেউ কেউ কাজ করবেন দূরতম দূরত্ব বজায় রেখে, আবার কেউ কাজ করবেন শুধু পৃষ্ঠপোষক বা পরামর্শদাতা হিসেবে— এমনটাই সব কাজের বিধি-নীতি। ইসলামের দাওয়াতি কার্যক্রমগত প্রচার-প্রসারও এই নীতিমালা বা আদর্শমালার বহির্ভূত নয়। মাওলানা ইলিয়াস কান্দলভি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি], মাওলানা ইউসূফ কান্দলভি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি], মাওলানা এনামুল হাসানসহ [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] মাওলানা ওমর পালনপুরিরা [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] দাওয়াতে তাবলিগের সাথে জড়িত ছিলেন অঙ্গাঙ্গিভাবে। আর মাওলানা মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] পক্ষ থেকে দাওয়াত তাবলিগের কাজের প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা ছিল, ছিল নানাবিধ পরামর্শগত অংশ গ্রহণ। তাঁর মতো একজন কর্মব্যস্ত ইলমি সাধকের পক্ষ থেকে পরামর্শ প্রদান বা সম্মতি প্রদানের এই অংশ গ্রহণই ছিল তাবলিগ জামাতের জন্য অতুলনীয় প্রাপ্তি। কিন্তু আফসোসের কথা হচ্ছে, মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর জীবনী থেকে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে সহায়তা প্রদান করার সেই ইতিহাস কালক্রমে মুছে যাচ্ছে। একেবারেই হারিয়ে যাচ্ছে এবং তলিয়ে যাচ্ছে কাল থেকে কালান্তরে। বর্তমান সময়ে এসে অনেক তাবলিগওয়ালা ভাইদের মুখেও শুনতে হয় মাওলানা মাদানি বিদ্বেষী কথা। এক তাবলিগি ভাই বলেই ফেললেন, ‘আরে ভাই মাওলানা হুসাইন মাদানিকে তাবলিগ জামাতের মুরুব্বি বানানোর দরকার কি? তিনি তো মূলত একজন রাজনৈতিক আলিম ছিলেন।’ অবাক হয়ে ভাবলাম— তাবলিগ জামাতের সাথে মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানির নাম যুক্ত হওয়াতে মাওলানা মাদানির মান-শান বৃদ্ধি হয়নি বা হবেও না, কিন্তু এতে যে তাবলিগ জামাতের স্তরগত সমৃদ্ধি ঘটেছে— সেই বোধটুকু আল্লাহ মহান এই তাবলিগি ভাইকে হয়তো দান করেননি। মবাইকে সবকিছু দান করেন না আল্লাহ মহান।
আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর জীবনী নিয়ে বাংলাদেশসহ ভারতের নামীদামী লেখকদের রচিত শত-সহস্র পৃষ্ঠার জীবনীগ্রন্থ বের হয়েছে, স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে; তাঁর জীবনী নিয়ে ‘এমফিল’ গবেষণা হয়েছে। কিন্তু আফসোস, সে সব থিসিসসমূহের একটি পাতায়, একটি বাক্যেও দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে মাওলানা মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর সহযোগিতা প্রদানের কথাগুলো স্থান পায় না। তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠা, পথচলায় মাওলানা মাদানির নানাবিধ পরামর্শগুলোও আলোচিত হয়নি দুই মলাটবদ্ধ কোনো বইয়ে। তাবলিগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস কান্দলভি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর সঙ্গে সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর অন্তরঙ্গ সম্পর্কের কোনো তথ্য-ইতিহাস কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
মাওলানা মাদানির দরদমাখা আহবান
১৯৪১ সালের নভেম্বর মাসে ভারতের মেওয়াত উপজেলার ‘নূহ’ নামক স্থানে তাবলিগ জামাতের সর্বপ্রথম বিশাল ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] সে ইজতেমার উদ্বোধন করে শামিয়ানা টানানো ময়দানে নামাজের ইমামতি করেছিলেন। তৎকালীন ভারতের বিখ্যাত আলিম মুফতি কিফায়েতুল্লাহসহ [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] অনেক বড় বড় আলিম-ওলামা সেদিনের সেই ইজতেমায় উপস্থিত ছিলেন। ইজতেমার ময়দানে প্রদত্ত ভাষণে তাবলিগের কাজে অংশগ্রহণ করার জন্য সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর দরদমাখা আহবান শুনে প্রচ- খুশি হয়েছিলেন মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। আরো আগে বাড়ার স্পৃহায় সেদিন আরো বেশি আন্দোলিত হয়েছিল মাওলানা ইলিয়াসের হৃদয়। শ্রদ্ধাভরা হৃদয়ে দরদমাখা কণ্ঠে কৃতজ্ঞতম চিত্তে মাওলানা মাদানি অংশ গ্রহণের শুকরিয়া প্রকাশ করেছিলেন তিনি। এই প্রসঙ্গ নিয়ে মাওলানা মনজুর নোমানির [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] কাছে পাঠানো একপত্রে তিনি লিখেছেন, ‘সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] যখন ইজতেমা উদ্বোধন করে দরদভরা কন্ঠে তাবলিগের কাজে অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানালেন, তখন আমার বিশ্বাস হলো আল্লাহ মহানের দরবারে এ কাজ কবুল হয়েছে। বিশ্ব তাবলিগের জন্ম এবং জগতব্যাপী এই কাজের বিস্তার লাভের ইতিহাসে মাওলানা মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর এই অংশগ্রহণের কি কোনোই মূল্য নেই?
প্রকৃত পৃষ্ঠপোষক-পরামর্শদাতা এবং শুভাকাক্সিক্ষ মুরুব্বি
কেবল ইজতেমার অনুষ্ঠানের উদ্বোধক সেজে নয়, শুধুমাত্র দরদভরা ভাষণ প্রদান করা পর্যন্তই শেষ নয়; প্রকৃত অর্থেই হজরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] ছিলেন দাওয়াত ও তাবলিগ জামাতের অন্যতম একজন পৃষ্ঠপোষক-পরামর্শদাতা এবং শুভাকাক্সিক্ষ মুরুব্বি। মাওলানা ইলিয়াসসহ [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] গোটা তাবলিগ জামাত যাঁর অবদানের কাছে কৃতজ্ঞ-ঋণী। আরেকটু আগে চলে যাই। আরেকবার প্রমাণ করি যে, দাওয়াত ও তাবলিগের সঙ্গে সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] কত বেশি পরিমাণে স¤পৃক্ত ছিলেন। আরো একবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে সেইসব লেখক এবং সেইসব তাবলিগি ভাইদের মাওলানা মাদানির তাবলিগপ্রীতির নমুনা দেখানো চেষ্টা করি— মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানিকে তাবলিগি মুরুব্বি মানতে নারাজ যারা। ১৯৩৩ সালের কথা। মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] প্রতিষ্ঠিত তাবলিগ জামাতের শিশুবয়স চলছে তখন। প্রচন্ড শীত উপেক্ষা করেও ২০০ জন ‘মেওয়াতি’ মাওলানা মাদানির [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] আহ্বানে দুই মাসের তাবলিগি সফরে বেড়িয়েছিলেন এবং মাওলানা ইলিয়াসের [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] অনুরোধে দিল্লির জামে মসজিদে জামাতগুলোকে বিদায় বেলার ‘হেদায়েতি বয়ান’ করেছিলেন মাওলানা মাদানি। মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] আজ নেই, কিংবা আমাদের মাঝে নেই মাওলানা মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। কিন্তু দিল্লির সেই জামে মসজিদ এখনও আছে, মাওলানা মাদানির [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] হেদায়েতি বয়ানের অমূল্য সেই স্মৃতি বুকে নিয়ে ভারতের জমিনে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই মসজিদ। একটি নীরব স্মৃতিস্তম্ভ। কালের ইতিহাসের একটি নিস্তব্ধ সাক্ষী। আমরা মানুষ ইতিহাস ভুলে যাই। কখনো কখনো আমরা মানুষই আবার ইতিহাসের বুকে রচনা করি নতুন ইতিহাস। কিন্তু না, জড়পদার্থ কিংবা বস্তুজগত কখনো তাদের স্মৃতি হারায় না। রাগান্বিত হয়েও কখনও তারা বুক থেকে মুছে ফেলে না মানব ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন। দিল্লি জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে তাবলিগের কাজে সফরকারী জামাতগুলোকে হেদায়েতি বয়ান করতে গিয়ে মাওলানা মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] সেদিন বলেছিলেন, ‘তোমরা যে কাজের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছো, তাঁর ফলে বাতিল খতম হয়ে যাবে, ভারতবর্ষ থেকে বৃটিশ শাসন-শোষণের অবসান ঘটবে। লালকেল্লার উপর যে ইউনিয়ন জ্যাক পতাকা উড়ছে, সে পতাকা পড়ে যাবে।’ পরম আশ্চর্যের কথা হচ্ছে যে, মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর মুখ থেকে শেষোক্ত কথাটি বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে লালকেল্লার উপরে থাকা ইউনিয়ন জ্যাক পতাকাটি খসে পড়েছিল। সুবহানাল্লাহ।
তাবলিগে সময় লাগানোর জন্য আহবান-উপদেশ
এ-তো গেল দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর স্বশরীরে উপস্থিত থাকার আলোচিত এবং বহুল প্রচারিত কয়েকটি উদাহরণ। তাবলিগ জামাতের ইতিহাসে মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর অবদানের আলোচনা কেবল এখানেই সমাপ্ত নয়। বহুল প্রচারিত কয়েকটি উদাহরণেই সীমাবদ্ধ নয় তার তাবলিগি অবদাননামা। বেশ কিছু সময় এবং বেশ কয়েকজন আলিমসহ অনেক ভক্ত-মুরিদকে তাবলিগের কাজে অংশগ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এমনকি অনেককেই তিনি নিজ থেকে পত্র লিখে আদেশ করেছেন, অনুরোধ জানিয়েছেন, তাবলিগ জামাতের সফরে বের হওয়ার জন্য।
‘শুদ্ধি সংগঠন’ এবং তাবলিগি কাজ…
১৯২৪ সালে ভারতব্যাপী স্বামী শ্রদ্ধানন্দের ‘শুদ্ধি সংগঠন’ বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। মুসলমানদের বিপরীতে বেশ তৎপরতার সাথে কাজ শুরু করেছিল তারা। তখন এই আন্দোলনের মোকাবেলায় জমিয়ত উলামায়ে হিন্দসহ মাওলানা ইলিয়াসের তাবলিগ জামাত বেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। দারুল উলূম দেওবন্দ মাদরাসা মাসব্যাপী বন্ধ ঘোষণা করে ছাত্র-শিক্ষক সবাই তখন তাবলিগের কাজে লেগেছিলেন। মুফতি মাওলানা কিফায়েতুল্লাহ [রহমাতুল্লাহি আলাইহি], মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] এবং মাওলানা আহমদ সাঈদসহ [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের প্রায় সকল আলিম তখন তাবলিগের কাজে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এসময় মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর পরামর্শানুযায়ী জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের তাবলিগি বিভাগটির দায়িত্ব মাওলানা মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর ওপরই ন্যস্ত করা হয়। মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানিসহ [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] জমিয়তের নেতৃবৃন্দরা তখন ছিলেন তাবলিগি কাজ তথা তাবলিগ জামাতের একান্ত সহায়ক শক্তি।
একজন আধ্যাত্মিক সাধক-পুরুষ ছিলেন তিনি
আধ্যাত্মিক জগতের একজন সাধক-পুরুষ ছিলেন মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। তৎকালীন ভারতের স্বনামধন্য বেশ কয়েকজন কামেল পীরের কাছ থেকে খেলাফত লাভ করেছিলেন তিনি। পিতা সাইয়িদ মাওলানা হাবিবুল্লাহর [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] কাছ থেকে খেলাফত পাওয়ার মাধ্যমে হজরত মাওলানা ফজলুর রহমান গঞ্জে মুরাদাবাদি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর এবং শায়খ মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহির [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] কাছ থেকে খেলাফত লাভ করার নেসবতে হজরত মাওলানা হাজি ইমদাদুল্লাহ মুজাহিরে মক্কি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর আধ্যাত্মিক ‘ফয়েজধন্য’ ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। এককথায়, সুফিজগতের একজন উঁচুমার্গের অলিআল্লাহ এবং হক্কানি পীর ছিলেন মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। আধ্যাত্মিক জগতের সাধক ছিলেন কিন্তু আধ্যাত্মিক সাধনা এবং তাবলিগি মেহনতকে কখনো আলাদাভাবে মূল্যায়ন করেননি তিনি। অসংখ্য মুরিদ ছিল তাঁর। অনেক মুরিদকে নিজে থেকে তাবলিগে যাওয়ার আহবান জানিয়েছেন; অনেকে তাবলিগে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে সম্মতি দিয়েছেন মাওলানা মাদানি।
একবার এক মুরিদ তাবলিগের কাজে এক চিল্লা সময় লাগানোর ওয়াদা করলেন কিন্তু পরক্ষণে তাঁর মনে হলো যে, শায়খের অনুমতি ছাড়া তাবলিগের কাজে বের হওয়াটা আমার জন্য সমীচীন হবে না। এই ভেবে শায়খ হজরত মাদানির কাছ থেকে তাবলিগের কাজে এক চিল্লায় যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর মতামত জানতে চেয়ে পত্র লিখলেন যে, ‘যদি আপনার অনুমতি থাকে এবং আমার এ কাজে বের হওয়ার অনুমতি হয়, মাওলানা ইলিয়াসের কাছে আমার জন্য একটি সুপারিশপত্র দানের আবেদন রইলো।’ মুরিদের এই পত্র পেয়ে মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] তাঁর মুরিদকে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করেছিলেন। মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] তাঁর মুরিদকে উত্তর লিখলেন, ‘তাবলিগের খেদমত আঞ্জাম দেওয়ার উদ্দেশ্যে মাওলানা ইলিয়াসের সান্নিধ্যে উপস্থিত হওয়ার বাসনাটি অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আল্লাহ কবুল করুন এবং শক্তি দান করুন! আপনি যেন মহান এই কাজ সুষ্ঠ ও সুন্দরভাবে সম্পাদনা করতে পারেন। মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর কাছে আলাদাভাবে পত্র লেখার কোনো প্রয়োজন নেই। কোনো সুপারিশ ছাড়াই আগ্রহভরে তিনি আপনাকে সহায়তা করবেন। এরপরও যদি মনে করেন যে, সুপারিশের প্রয়োজন আছে, তবে আমার এই পত্রখানা তাঁকে দেখাবেন এবং তাঁর কাছে আমার সালাম ও দোয়ার প্রার্থনা পৌঁছে দিবেন।’ হজরত মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর পত্রখানা পেয়ে অত্যন্ত খুশি হলেন এবং সমবেত লোকজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আল্লাহ মহানের দরবারে আমি অধমের এই কাজ কবুল হওয়ার জন্য মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর নেক দৃষ্টিই সবচেয়ে বড় দলিল।’ আজ যারা মাওলানা মাদানিকে তাবলিগি মুরুব্বি মানতে নারাজ, তাদের কি জানা আছে এই ইতিহাস? তারা কি বোঝেন তাবলিগি আমলে জুড়তে মাওলানা মাদানির এই সম্মতি প্রদানের অর্থই-বা কী?
বংশগতভাবে মাওলানা মাদানি ছিলেন ‘নাজিবুত তারফাইন’
ভারতের উত্তর প্রদেশের ‘বাঙ্গারমৌ’ নামক গ্রামে ১৮৭৯ সাল মোতাবিক ১২৯৬ হিজরি সনের ১৯ শাওয়াল সোমবার জন্ম গ্রহণ করেন মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি। পিতার নাম সাইয়িদ হাবিবুল্লাহ। মাতার নাম ছিল নূরুন্নিসা। জন্ম সন স্মরণ রাখার লক্ষে আরবি বর্ণমালার সংখ্যার মান হিসেবে তাঁর অপর নাম রাখা হয় চেরাগ মুহাম্মাদ। বংশগতভাবে তিনি ছিলেন হুসাইনি সাইয়িদ। বংশ পরম্পরায় তাঁর ৩৩তম পূর্বপুরুষ ছিলেন কারবালার শহীদ হজরত হুসাইন ইবনে আলি [রাজিআল্লাহু তায়ালা আনহু]। মাওলানা মাদানির ২৭তম পূর্বপুরুষ ছিলেন সাইয়িদ মুহাম্মাদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি মদিনা শরিফ থেকে প্রথমে তিরমিজে আসেন। এরপর সাইয়িদ মুহাম্মাদ মাদানির প্রপৌত্র সাইয়িদ আহমদ তুখনা তিরমিজ থেকে লাহোরে চলে আসেন এবং ইসলাম প্রচারের নিয়োজিত হন। ৬১২ হিজরি সনে সাইয়িদ আহমদ তুখনা ইনতিকাল করেন। তাঁর উত্তরপুরুষদের মাঝে বহু সুফি ও আলিম-মাশায়িখের আর্বিভাব ঘটে। লাহোর থেকে ভারতবর্ষের বিভিন্নস্থানে ইসলাম প্রচারের কাজে ছড়িয়ে পড়েন তাঁরা। বংশগতভাবে মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি ছিলেন ‘নাজিবুত তারফাইন’ বা পিতা ও মাতা উভয় দিক থেকে সাইয়িদ। মাওলানা মাদানির পিতা ও মাতার বংশপরম্পরা সাইয়িদ শাহ মুদন-এ গিয়ে মিলিত হয়েছে। নকশে হায়াত নামক গ্রন্থে মাওলানা মাদানি নিজ বংশলতিকা বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন, ‘বংশ নিয়ে অহংকার করা ইসলামে ভীষণ গর্হিত কাজ।’
মাওলানা মাদানি এবং মাওলানা ইলিয়াস…
একদিক থেকে মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর সহপাঠী ছিলেন। দীর্ঘ ১১ বছর পর মদিনা থেকে ফিরে এসে মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] যখন শায়খুল হিন্দ আল্লামা মাহমুদ হাসান [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর কাছে দ্বিতীয়বার বোখারি ও তিরমিজি শরিফের দরস গ্রহণ করেন, মাওলানা ইলিয়াসও [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] সেই বছর শায়খুল হিন্দের কাছে বোখারি ও তিরমিজি শরিফ অধ্যয়ন করেন। একসঙ্গে হাদিসের দরসে বসার সুবাদে দু’জনের মধ্যে স¤পর্কের হৃদ্যতা সৃষ্টি হয়। মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানিকে [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] শ্রদ্ধা-ভক্তি করতেন এবং তাঁকে নিজের মুরুব্বি ভাবতেন। একইভাবে মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-ও মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-কে সমীহের নজরে দেখতেন। এককথায়, উভয়েই উভয়কে শ্রদ্ধা করতেন, সম্মান করতেন।
তাবলিগ জামাতের সাহায্য-সহযোগিতার ক্ষেত্রে সক্রিয় থাকবেন
ইসলামি রাজনীতি তথা জমিয়তে উলামায় হিন্দের সঙ্গে স¤পৃক্ত থাকার কারণে ভারতের বিভিন্ন এলাকার প্রভাবশালী আলিমদের সাথে মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর গভীর সম্পর্ক ছিল। তাঁর ভক্ত-পরিচিতি এবং এলাকায় প্রভাবশালী-ক্ষমতাধর একজন আলিম ছিলেন ‘মিরাঠ’ শহরের মাওলানা হাকিম মুহাম্মাদ ইসহাক [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। দেওবন্দ মাদরাসার মজলিসে শুরার অন্যতম সদস্যও ছিলেন তিনি। মিরাঠ এলাকায় সফরকারী তাবলিগ জামাতের প্রতি আলিমদের অনিহামূলক আচরণের কথা জানতে পেরে মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] মাওলানা হাকিম মুহাম্মাদ ইসহাক [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-কে একটি পত্র লিখলেন। সে পত্রে তিনি লিখেছেন, ‘জনাব! এই কথা শুনে আমি খুবই বিস্মিত হলাম যে, মিরাঠ এলাকার আলিম-ওলামা এবং স্বয়ং আপনিও সেখানে সফরকারী তাবলিগ জামাতের কোনো খবর গ্রহণ করেন না বরং সেখানকার সাধারণ মানুষগুলি তাদের সহানুভূতি প্রদর্শন করে। এর রহস্য ও কারণ বুঝতে আমি অক্ষম। সম্মানিত বুজূর্গ! তাবলিগ জামাত তাদের সাধ্যানুসারে দীনের জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব আঞ্জাম দিচ্ছে এবং বর্তমানে এই জামাতটির সাহায্য সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। সব মুসলমানদের মাঝে ঐক্য সাধিত হোক এবং তাদের ধর্মীয় অনুভূতি জাগিয়ে তোলা হোক। তাহলে ভবিষ্যতে সুদূরপ্রসারী ফলাফলের আশা করা যাবে। ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে পূর্ণ সচেষ্ট হবেন এবং তাবলিগ জামাতের সাহায্য-সহযোগিতার ক্ষেত্রে সক্রিয় থাকবেন বলে আপনার কাছে আমার আশা রইলো।’ এভাবেই, একের পর এক মাধ্যম অবলম্বন করে, বিভিন্ন পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী দাওয়াত ও তাবলিগ জামাতের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। কেবল সহযোগিতা কিংবা পরামর্শ নয়, মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর গোটা জীবনের একটি বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে ইসলামের প্রচার-প্রসার চিন্তা, যে চিন্তার সহায়ক শক্তি-পদ্ধতি হিসেবে মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] প্রতিষ্ঠিত দাওয়াত ও তাবলিগের কাজকে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। নববি নমুনায় প্রতিষ্ঠিত এ কাজের প্রতি মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানির [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] আস্থা ছিল শতভাগ।
৪৩ বছরের সীমিত সময়= তাঁর জীবন ও কর্ম
১৯৫৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর ৮১ বছর বয়সে মাওলানা মাদানি ইনতিকাল করেন। এই ৮১ বছরের মাঝে ২০ বছর শৈশব-শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনে অতিবাহিত হয়; ৭ বছর ৯ মাস জেলখানায় ছিলেন তিনি; বাকি ৫৩ বছর থেকে ব্যক্তিগত মানবীয় প্রয়োজন পূরণ বাবদ ১০ বছর বিয়োগ করলে অবশিষ্ট থাকে ৪৩ বছর। এই ৪৩ বছরের সীমিত সময়= তাঁর জীবন ও কর্ম। ###