মাওলানা ইলিয়াস কান্দলভি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর সহপাঠী ছিলেন মাওলানা রিয়াজুল ইসলাম কান্দলভি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। ছোটবেলার স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি একদিন বলছিলেন, ‘মাওলানা ইলিয়াসের মাঝে ছোটবেলা থেকেই ইসলামি হুকুম-আহকাম পালনের প্রতি বিশেষ ভালোবাসা-আগ্রহ ছিল। ও একদিন আমাকে বললো, চলো, যারা নামাজ না পড়ে তাদের বিরুদ্ধে আমরা জিহাদ ঘোষণা করি। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেই বেনামাজিদের ঘর-বাড়ি।’
নাতি যেন আমার দীনের দায়ি হয়!
১৮৮৫ সালে ভারতের ‘কান্দালা’ নামক এক শহরে জন্ম গ্রহণ করেন মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। শহরের নাম অনুসারে তাই নামের শেষে ব্যবহৃত হয় ‘কান্দলভি’ শব্দটি। তাঁর ছোটবেলা কেটেছে নানিবাড়ি মেওয়াতে। মাওলানা ইলিয়াস যখন একটু বড় হলেন, পড়াশুনা করার তাগিদে বাবার কাছে নিজামুদ্দিন চলেন এলেন তিনি। বাবা মাওলানা ইসমাইলের [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] কাছেই ‘আলিফ-বা’র সবক শুরু করেন এবং খুব অল্পদিনের মাঝে পবিত্র কোরানের হিফজ সমাপ্ত করেন। প্রখর মেধাবী ছাত্র ছিলেন ইলিয়াস। মেধা-দক্ষতার পাশাপাশি পরিবারের সবার মুরুব্বি ‘আম্মিবি’র (মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর নানি) দোয়া ছিল তাঁর প্রতি। আম্মিবির আশা ছিল, ‘আমার নাতি যেন সাহাবা আজমাইনের মতো দীনের দায়ি থেকে পারে। মানুষের দ্বারে দ্বারে দীনের দাওয়াত নিয়ে পৌঁছার জন্য আল্লাহ যেন আমার নাতিকে কবুল করেন। আল্লাহ যেন আমার নাতিকে দায়ি হিসেবে কবুল করেন’। আম্মিবি আমাতুস সালামের দোয়া ও প্রার্থনাকে পূরণ করলেন আল্লাহ মহান। কেবল ভারত কিংবা দিল্লি এলাকায় নয়; গোটা পৃথিবীজুড়ে দীনি দাওয়াতের বর্তমান যে ধারা প্রচলিত রয়েছে, তাবলিগি কার্যক্রমের নবিওয়ালা যে পদ্ধতি চালু রয়েছে এর নেপথ্যে মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর চিন্তা-ফিকির, দোয়া-মোনাজাত ও চোখের পানি সবচেয়ে বড় নিয়ামক হিসেবে কবুল হয়েছে। এক কথায়, উম্মতে মুহাম্মাদির পরলৌকিক মুক্তিকামী এই নবিওয়ালা কাজের উদ্ভাবক, বর্তমান তাবলিগ জামাতের প্রাণপুরুষ-রূপকার একমাত্র তিনিই— হজরত মাওলানা ইলিয়াস কান্দলভি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]।
আধ্যাত্মিক সাধনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে…
পবিত্র কোরান হিফজ করার পর বড় ভাইয়ের সঙ্গে পড়াশুনা করার জন্য গাঙ্গুহ চলে আসেন ইলিয়াস। এখানে এসেই তিনি মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহির [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] সোহবত-সংস্পর্শ লাভ করেন। ইলমে অহির সফল ধারক; সুন্নাতে নববির পরিপূর্ণ সাধক এক মহাপুরুষের সংর্স্পশ-শুভ্রতায় আলোকিত হয়ে ওঠে মাওলানা ইলিয়াসের জীবন-সাধনা। কিছুকাল অসুস্থ থাকার কারণে ভালোভাবে পড়াশুনায় অংশ গ্রহণ করতে পারেননি তিনি। পুরোপুরি সুস্থতা লাভ করার পর পুনরায় মনোনিবেশ করেন পড়াশুনায় এবং খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে দাওরায়ে হাদিস জামাত সমাপ্ত করেন। পড়াশুনার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক সাধনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহির [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] কাছে বায়আত গ্রহণ করেন মাওলানা ইলিয়াস। কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, মোট বিশ বছর মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহির [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] সোহবাতে ছিলেন মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহির [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] ইনতিকালের পর দেওবন্দে চলে আসেন তিনি এবং মাওলানা মাহমুদ হাসানের [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] ছাত্রত্ব গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি মাওলানা মাহমুদ হাসানের [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] কাছে পুনরায় তিরমিজি শরিফসহ বিভিন্ন হাদিসের গ্রন্থ পাঠ করেন বলে জানা যায়।
মানুষের পশ্চাৎপদতায় মনের গভীরে চিন্তার জোয়ার উঠলো
ভারতের সাহরানপুরে অবস্থিত মাজাহিরুল উলূম মাদরাসায় শিক্ষকতা প্রাপ্তির মাধ্যমে মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর কর্মজীবনের সূচনা ঘটে। প্রথম শিক্ষকতা। প্রথম কর্মক্ষেত্র। একাধারে আট বছর এই মাদরাসায় শিক্ষকতা করেছেন তিনি। মাদরাসায় শিক্ষক থাকাকালীন ১৯১২ সালের ১৭ অক্টোবর মামাতো বোনের সঙ্গে শুভ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন মাওলানা ইলিয়াস। এরপর তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টির আগমন ঘটে। পরির্বতন আসে জীবনের কর্মে-চিন্তায় এবং বিশ্বাস-আমলে। যেখানে, যে অঞ্চলে থাকাকালীন এবং যে মানুষগুলোর পশ্চাৎপদতায় মনের গভীরে চিন্তার জোয়ার উঠেছিল, সেই এলাকায় যাওয়া হলো মাওলানার। পিতা ও বড় ভাইয়ের ইনতিকালের কারণে মেওয়াতি জনসাধারণ এবং পরিবারের বিশেষ অনুরোধে মাজাহিরুল উলূম মাদরাসা ছেড়ে মেওয়াত চলে এলেন মাওলানা ইলিয়াস। মেওয়াতে এসে বাবার প্রতিষ্ঠিত মক্তব দেখাশুনা শুরু করলেন এবং একই ধারাবাহিকতায় নিজ খরচে আরো বেশ কয়েকটি মক্তব প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। দীনি এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে গিয়ে মেওয়াতবাসীর মানসিক জাহেলিপনা ও জ্ঞানগত অন্ধত্ব ভীষণভাবে চিন্তিত করে তোলে তাঁকে। গভীর ভাবনায় নিমগ্ন ইলিয়াস ভাবতে থাকেন, কীভাবে এবং কোন পদ্ধতি অবলম্বন করে দীনহীন এই মানুষগুলোকে আল্লাহর পথে আনা যায়; জাহেলিপনায় মত্ত এই লোকগুলোকে কীভাবে আল্লাহওয়ালা বানানো যায়। চিন্তা-ভাবনার এক শুভক্ষণে নবিওয়ালা দাওয়াতি চিন্তা-পদ্ধতির কথা স্মরণ করেন এবং নিজ কওমের লোকজনকে নবিদের আদলে দীনের দাওয়াত দেওয়া শুরু করেন তিনি। তাদের বোঝাতে শুরু করেন যে, আমরা যেখানে আছি এটাই আমাদের চিরস্থায়ী নিবাস নয়; আমাদের চিরস্থায়ী নিবাস হলো জান্নাত। সেই চিরস্থায়ী নিবাসে বসবাস করার সামান জোগাড়ের জন্য পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে আমাদের। একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করাই আমাদের কাজ। এই কাজের জন্যই আমরা এই পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছি…
একে একে দুই, দুইয়ে দুইয়ে চার এবং বিশ্বময়…
একে একে দুই। দুইয়ে দুইয়ে চার। এভাবেই ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলো মাওলানা ইলিয়াসের [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] দাওয়াত শোনা মানুষের সংখ্যা। আরো বেশি পরিমাণে মানুষের আগমন ঘটতে লাগলো তাঁর দীনি হালকায়। মানুষ তাঁর কথা শুনে ফিরে এলো দীনের পথে এবং ছেড়ে দিলো অতীত জীবনের নানান কু-কর্ম। দিন, সপ্তাহ, মাস এবং বছরের সীমানা পেরিয়েই আজকের এই সফলতার শীর্ষমিনারের স্থান দখল করেছে মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] প্রবর্তিত নবিওয়ালা দাওয়াতি মিশন- তাবলিগ। মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর তাবলিগ জামাতের সফলতা সম্পর্কে মাওলানা সাইয়িদ সুলাইমান নদভি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] বলেন, ‘হজরত মাওলানা অত্যন্ত মৌনতার সাথে নিজের ইখলাস এবং সাদাসিধা পদ্ধতিতে দীনি দাওয়াতের সঠিক উসূল প্রণয়ন করার মাধ্যমে সুদীর্ঘ ২৫ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের দ্বারা গোটা মেওয়াতবাসীকে খাঁটি মুসলমানে পরিণত করেছেন। মেওয়াতবাসী এইসব মুসলমানের ভেতর-বাহিরের অবস্থা দেখে খানদানি মুসলমনারাও ঈর্ষান্বিত হয়’। মাওলানা ইলিয়াসের মেহনতে গোটা মেওয়াতে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল আর সেই আমূল পরিবর্তনের ব্যাপ্তি আজ বিশ্বময়…
জায়নামাজেই কেটে যেতো অনেক রাত
‘তাবলিগ জামাত’ নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে যে মহান মনীষীর কল্পরূপ আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে তিনিই হলেন হজরত মাওলানা ইলিয়াস কান্দলভি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। নবিওয়ালা আদর্শের অনুসারী তাবলিগি কার্যক্রম নামক বিশ্বব্যাপী সমাদৃত একটি দীনি মিশনের প্রতিষ্ঠাতা যিনি। তাঁর ইখলাস-অনুপ্রেরণা এবং চিন্তা-সাধনা ও চোখের পানি যে সফলতার সবচেয়ে বড় নিয়ামক। তাঁর অন্তরে দীনের যে জ্বলন ছিল তা ছড়িয়ে পড়েছে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে, পরিবার থেকে পরিবারে; এক এলাকা ছাপিয়ে অন্য এলাকায়; এক দেশ পাড়ি দিয়ে অন্য দেশে। তাবলিগ জামাত নামক নববি ধারার এক দাওয়াতি আন্দোলন জয় লাভ করেছে সারা দুনিয়ায়। সৃষ্টি হয়েছে সুন্নাতে নববি জিন্দা রাখার সর্ববৃহৎ গণজমায়েত। খালেস দীনি ধারার এ দাওয়াতি কার্যক্রম যতদিন থাকবে; ততদিন এর সঙ্গে মিশে থাকবে মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর নাম। তাঁর বংশধররা ছিলেন দিল্লির ধর্মীয় ও সামাজিক নেতৃত্বের অগ্রগামী সেনা। ঐতিহ্যম-িত এক দীনি পরিবারের সদস্য হিসেবে ছোটবেলা থেকেইে নববি আদর্শগত সহিহ একটি পাঠশালার ছাত্র ছিলেন ইলিয়াস। নববি গুণ ও আদর্শ ছিল তাঁর পরিবার-পূর্বপুরুষদের বৈশিষ্ট্য। নববি গুণ ও বৈশিষ্ট্যে পূর্বপুরুষদের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিলেন মাওলানা ইলিয়াস।
মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর মৃত্যুর পর খুব কাছের এক বন্ধু মাওলানার বিবি সাহেবার কাছে তাঁর জীবনের বিশেষ কোনো ঘটনা জানতে চাইলেন। অন্দরমহল থেকে মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর স্ত্রী বলে পাঠালেন, ‘বিয়ের পর উনার ঘরে এসে আমি দেখলাম- রাতে খুবই কম ঘুমাতেন তিনি। বেশির ভাগ রাতই কেবল কান্না-কাটিতে কাটাতেন। জায়নামাজেই কেটে যেতো তাঁর অনেক রাত। ঘুমানোর জন্য বিছানায় এলেও কিসের অস্থিরতায় যেন বারবার তিনি পার্শ্ব পাল্টাতেন। প্রচ- বেচাইনিযুক্ত ছিল তাঁর রাত-যাপন। আমি জানতে চাইলাম— রাতে আপনার ঘুম হয় না কেন? একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন, কি বলবো! আমার রাত জাগরণের কথা তোমাকে বললে রাত জাগরণকারী তখন আর আমি একা থাকবো না, দুইজন হয়ে যাবে। নিজের বা পরিবারের জন্য নয়; উম্মতে মুহাম্মাদির পরলৌকিক মুক্তির চিন্তায় এভাবেই ঘুমাতে পারতেন না তিনি।’
একটি দরদি হৃদয়ের জ্বলন ও আত্মদহনের এক আকাশ সফলতা
হজরত মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] বংশীয় সূত্রেই মানবতাবাদী ও দরদি একটি অন্তরের অধিকারী ছিলেন। মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী হওয়া এবং মানুষের কল্যাণকামিতায় অগ্রবর্তী অবদান রাখাই ছিল তাঁর জীবনের মহানব্রত। তাঁর প্রতিষ্ঠিত তাবলিগ জামাতের মূল শিক্ষাও মানবতার কল্যাণকামিতা। সমস্যাসঙ্কুল, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এই বিশ্বে সব ধরনের বৈষিয়কতার উর্ধ্বে উঠে সর্বোচ্চ ত্যাগ ও সাধনার মাধ্যমে জীবনের মূল-কাক্সিক্ষত সফলতার পথে এগিয়ে চলাই তাবলিগ জামাতের মূল উদ্দেশ্য। আনেওয়ালা সকল উম্মতে মুহাম্মাদি যেন জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি এবং জান্নাত লাভের পথের সন্ধান লাভ করতে পারে— তাবলিগি মিশনের এটাই একমাত্র লক্ষ। মানুষের মূল গন্তব্য ও অনিবার্য পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করার মাধ্যমে মানবতার উত্তরণের এই প্রয়াসের সূচনা দরদমাখা একটি হৃদয় থেকেই। হজরত মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর একটি দরদি অন্তরের জ্বলন একটি সফল আন্দোলনরূপে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়।
উম্মতে মুহাম্মাদির পরলৌকিক মুক্তির চিন্তায় মাওলানা ইলিয়াসের [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর অন্তরে চিন্তাগত যে জ্বলন উঠেছিল; সে জ্বলন ও আত্মদহনের এক আকাশ সফলতার নাম বর্তমান তাবলিগ জামাত। আনেওয়ালা উম্মতে মুহাম্মাদির মাঝে দাওয়াতি মেহনত জারি রাখার নবিওয়ালা এক পথ ও পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন তিনি। পৃথিবীব্যাপী দীনি দাওয়াতের প্রচার-প্রসারগত যে ধারা প্রচলিত রয়েছে, তাবলিগি কার্যক্রম নামে নবিওয়ালা যে মিশন চালু রয়েছে- মাওলানা ইলিয়াস [রহমতুল্লাহি আলাইহি]-এর চিন্তা-ফিকির, দোয়া-মোনাজাত ও রোনা-জারিসহ আরো সব অবদান-আয়োজনই সবচেয়ে বড় নিয়ামক হিসেবে কবুল হয়েছে— এটাই একমাত্র আল্লাহ মহানের ইচ্ছা।
ভালো লাগলে থেকে যেয়ো, নইলে চলে এসো
মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর কর্মজীবন শুরু হয় ১৩২৮ হিজরিতে, সাহরানপুর মাজাহিরুল উলূম মাদরাসায় শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। একাধারে আট বছর তিনি এই মাদরাসায় ইলমি দীনের দরস দানে নিয়োজিত ছিলেন। পিতা ও ভাইয়ের ইনতিকালের পর মেওয়াতবাসী তাঁকে অনুরোধ জানান, তিনি যেন মেওয়াতে ফিরে আসেন। তাদের অনুরোধ রাখলেন না মাওলানা ইলিয়াস। পেরেশান হয়ে এলাকাবাসী মাওলানা ইলয়াসের পীরের শরনাপন্ন হলেন। মাওলানা খলিল আহমদ সাহরানপুরির [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] কাছে কাঁদতে কাঁদতে হাজির হলেন মেওয়াতবাসী। এলাকাবাসীর কথা শুনে মাওলানা সাহরানপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] মাওলানা ইলিয়াসকে নিজামুদ্দিন চলে যাওয়ার কথা বললেন। মাওলানা ইলিয়াস তখন [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] বললেন, ‘কিন্তু আমি তো হজরতকে ছেড়ে যাওয়াকে ভালো মনে করি না।’ হজরত মাওলানা খলিল আহমদ সাহরানপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] বললেন, ‘তুমি এক বছরের জন্য ছুটি নিয়ে যাও। ভালো লাগলে থেকে যেয়ো, নইলে চলে এসো।’
মেওয়াতবাসী মুসলমানদের অবস্থা খুবই করুণ ছিল তখন। তারা বংশসূত্রে মুসলমান ছিল কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে ইসলামের কোনো চিহ্নই বাকি ছিল না তাদের মধ্যে। এমনকি নামে পর্যন্ত তাদের মুসলিম স্বকীয়তা বিলীন হয়ে গিয়েছিল। হিন্দুদের কিছু পূজা-পার্বণও তারা নিয়মিত পালন করতো। পিতার চালু করা মক্তবটিকে কেন্দ্র করেই মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] দীনি শিক্ষার আলো ছড়ানোর চেষ্টা শুরু করেন। এলাকার লোকদের কাছ থেকে শিশুদের চেয়ে চেয়ে আনতেন তিনি। নিজের পয়সায় শিক্ষক নিয়োগ করেছেন এবং মক্তবের সকল খরচ বহন করতেন তিনি নিজেই। এভাবে বেশ কিছু মক্তব চালু হয়। বেশ কিছু এলাকায় ছড়িয়ে পরে মাওলানা ইলিয়াসের ইলমি কার্যক্রমগত নূরানি আওয়াজ। মক্তব প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর দাওয়াতি কর্মসূচীর প্রথম ধাপ।
স্বপ্নযোগে নবিজির সা. মনোনায়ন লাভ এবং…
১৩৪৪ হিজরি সনে মুর্শিদ হজরত মাওলানা খলিল আহমদ সাহারপুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর সাথে দ্বিতীয়বার পবিত্র হজব্রত পালন করতে যান মাওলানা ইলিয়াস। পবিত্র মদিনায় অবস্থাকালে হজরত মুহাম্মাদকে [সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম] স্বপ্নে দেখেন তিনি। স্বপ্নযোগে তাঁকে জানানো হয়, ‘তোমার দ্বারা দীনের কাজ নেওয়া হবে।’ এই স্বপ্ন দেখার পর খুব পেরেশান হয়ে ওঠেন মাওলানা ইলিয়াস। শুধু একটি কথাই ভাবেন তিনি— ‘আমি তো কোনো কিছুরই যোগ্য নই। আমার মতো এমন একজন নগন্য মানুষের দ্বারা কী কাজ নেবেন। কীভাবে কী করবো আমি।’ পেরেশান অবস্থায় পরিচিত এক বুজুর্গের কাছে ব্যক্ত করলেন তাঁর স্বপ্নের কথা। অভয় দিয়ে সেই বুজুর্গ বললেন, ‘এতো পেরেশান হওয়ার কী আছে বেটা? এটা তো বলা হয়নি যে, তোমাকে কাজ করতে হবে। বলা হয়েছে, তোমার দ্বারা কাজ নেওয়া হবে। তো যিনি তোমার দ্বারা কাজ নেবেন; কাজ করিয়ে নেওয়া তো তাঁরই দায়িত্ব।’ মহামান্য বুজুর্গের ব্যাখ্যায় স্বস্তি ফিরে পেলেন মাওলানা ইলিয়াস; সাথে সাথে মনের কোণে সঞ্চিত হলো নতুন আলো…
স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে কিংবা ইলহামিভাবে প্রাপ্ত দায়িত্বের সন্ধানে অনুসন্ধানী মাওলানা ভাবলেন, লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে আমাকে এমন কর্মপন্থা অবলম্বন করতে হবে, যে পন্থা চালু ছিল সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে। এমন পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত যা প্রবর্তিত হয়েছে রাসুল [সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম]-এর মাধ্যমে। ইখলাস ও আত্মনিবেদনে ভরপুর হবে যে মিশন। স্বেচ্ছাশ্রম-আত্মোৎসর্গ এবং কল্যাণ মানসিকতা হবে যে জামাতের একমাত্র পুঁজি। সর্বসাধারণের মধ্যে সহিহ দীনের তলব সৃষ্টি করার জন্য দায়িকে থেকে হবে সহিহ দীনের ধারক। মাওলানা ইলিয়াস তাঁর এই চিন্তাধারাকে একটা মিশনি আন্দোলনের রূপ দান করলেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো তাঁর দরদমাখা আহ্বান। বিশ্ব তাবলিগ জামাতের গোড়াপত্তন হলো ভুবনে। মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর পাশে এসে দাঁড়ালেন তাঁর মতো দরদি কিছু আলিম; মুখলিস মুসলিম ভাইয়েরা। দরদ ও চেতনার সেই ¯পৃহা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়লো দিক-বিদিক। দীনি আন্দোলনের সেই আলোকশিখায় আলোকিত হলো পাক-ভারত; আলোড়িত হলো ভুবনব্যাপি লক্ষ-কোটি পিপাসিত হৃদয়-আত্মা।
তামুরুনা বিল মারুফি ওয়াতানহাওনা আনিল মুনকার…
‘আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও’- নবিজি [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম]-এর এই বাণী শোনার পর পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছিলেন সাহাবা আজমাইন। যাঁর ঘোড়া বা বাহনের মুখ যেদিকে ছিল, সেদিকে বেড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। রাসুল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম]-এর বাণীকে আনেওয়ালা উম্মতের কাছে পৌছানোর গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন যাঁরা। আমাদের সোনালি পূর্বসূরী— সাহাবা আজমাইনরা।
সাহাবা আজমাইনের মতো করে, ঠিক তাঁদের পদ্ধতি-আঙ্গিকে এবং সাহাবিওয়ালা নমুনায় উম্মতের কাছে রাসুল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম]-এর বাণী পৌঁছানোর দরদ উঠলো একটি হৃদয়ে। আনেওয়ালা উম্মতে মুহাম্মাদির পরলৌকিক মুক্তির কথা ভেবে ভেবে একজন মানুষ, একটি মানব আত্মায় কান্নার জোয়ার উঠলো। কখনো নামাজরত অবস্থায়, কখনো আবার জায়নামাজে লুটিয়ে পড়া প্রার্থনার সিজদায় রোনা-জারি করতেন তিনি। নিঘুর্ম মোরাকাবায় কেটে যেতো রাতের পর রাত। উম্মতের মুক্তির চিন্তায় পাড় হয়ে যেত দিনের পর দিন। ‘কুনতুম খইরা উম্মাতিন উখরিজাত লিন নাসি তা’মুরুনা বিল মারুফি ওয়াতানহওনা আনিল মুনকার ওয়া তু’মিনুনা বিল্লাহ’— পবিত্র কোরানের এই বাণীর মমার্থ-দর্শনকে মূলনীতি মেনে আল্লাহ মহান ও রাসুল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম]-এর বাণীকে উম্মতে মুহাম্মাদির কাছে পৌঁছানোর শুদ্ধতম এক পদ্ধতির নাম তাবলিগ জামাত। সহিহ একটি দাওয়াতি মিশন। কোনো ভেদাভেদ, কোনো মতানৈক্য-ইখতিলাফকে ভয় পায় না যে জামাত-মিশন। মাওলানা ইলিয়াস কান্দলভিই যে জামাত বা কাফেলার প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ।
মানুষকে কী দিয়েছে এই তাবলিগি মিশন
হজরত মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] তাঁর দাওয়াতি কাজের মাধ্যমে মানুষকে কী দিয়েছিলেন, যা পরবর্তীকালে এতোসব বিপ্লব সাধন করলো? তাঁর ছিল পরকালের স্মরণ। একমাত্র আল্লাহর সাহায্যের ওপর পূর্ণ আস্থাবান ও দৃঢ়বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। মানুষের অন্তরে তিনি এই বাস্তব সত্যকে দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল করে দিতে পেরেছিলেন যে, এই সৃষ্টি জগতের একজন মালিক আছেন। আর তাঁর কাছেই আমাদের সবাইকে ফিরে যেতে হবে। সৃষ্টি জগতের কোনো অণু-পরমাণুই তাঁর ইচ্ছার বাইরে নড়াচড়া করতে পারে না। তিনিই সবার মালিক। একমাত্র তাঁর কাছেই হবে আমাদের অনিবার্য প্রত্যাবর্তন। যা কিছু হয় একমাত্র তাঁর হুকুমেই হয়। দাওয়াতি এ কথা-কাজকে রাসুল [সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম]-এর তরিকা ও আদর্শ অনুসারে জীবিত করার মেহনত ছিল মাওলানা ইলিয়াসের। তাঁর মূল শ্লোগানই ছিল ‘অ্যায় মুসলমান! মুসলমান বনো!’ (হে মুসলমানেরা! তোমরা খাঁটি মুসলমান হও!) দ্রুততম সময়ে ব্যাপক পরিবর্তন সাধনের ক্ষেত্রে তাবলিগ জামাত তুলনাহীন। হজরত মাওলানা আবুল হাসান আলি মিয়া নদভি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] লিখেছেন, ‘তাবিলিগি কার্যক্রমের মাধ্যমে মেওয়াতে দীনদারির বেশ কিছু নমুনাগত পরিবর্তিত পরিবেশ লক্ষ করা যাচ্ছে; যার কোনো একটি নমুনা প্রতিষ্ঠার জন্য ইতোপূর্বে বছরকে বছর মেহনত করেও সফলতা অর্জিত হয়নি। মেওয়াতে এখন দীনের ব্যাপারে মানুষের মাঝে উৎসাহ সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত কোনো মসজিদ-মাদরাসা চোখে পড়তো না; সেখানে এখন গ্রামে গ্রামে মসজিদ ও দীনি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’
কেবল মেওয়াত কিংবা ভারত-পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশে নয়; তাবলিগি মেহনতের দ্বারা গোটা বিশ্বের লক্ষ-কোটি আল্লাহভোলা মানুষ দীনের পথে এসেছে। পাপের কালিমায় পিষ্ট অসংখ্য-অগণিত হৃদয়ে প্রজ্জ্বলিত হয়েছে ইমানি আলো। মানুষকে মানুষ; মুসলমানকে মুসলমান হিসেবে চেনার অনুভূতি-শক্তি অর্জনের জাদুকরি এক আমলি মিশন মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] প্রবর্তিত তাবলিগ জামাত।
সবার মতো তিনিও চলে গেলেন…
পৃথিবীতে এলে বিদায় নিতেই হবে। জন্ম যার ঘটেছে মৃত্যুর স্বাদ তিনি আস্বাদন করবেনই। কুল্লু নাফসিন যা-ইকাতুল মাউত। এক কবি লিখেছেন মৃত্যু এমন এক পেয়ালা শরবত; যে শরবত সবাইকেই পান করতেই হবে এবং কবর এমন এক ঘর যে ঘরে সবাইকে প্রবেশ করতেই হবে। চলে যেতে হয়, চলে যেতে হবে- মুসলিম জাতির জীবনের একটি অমোঘ সত্য এই মৃত্যু। একজন মুমিন বান্দা হিসেবে; আল্লাহ মহানের একজন খাঁটি গোলাম হিসেবে মাওলানা ইলিয়াসও একদিন চলে গেলেন। প্রিয়তম প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন তিনি। ইহলৌকিক মায়া-মহব্বত আর ভালোবাসাকে বিদায় জানিয়ে মহান প্রভুর সান্নিধ্য-সুখ অর্জন করলেন একজন মাওলানা ইলিয়াস কান্দলভি। কাজ রয়ে গেল, জারি রইলো একটি আন্দোলন; কাজের সফলতার ব্যাপ্তি ঘটলো, আলোকিত-আলোড়িত হলো লক্ষ-কোটি হৃদয়-আত্মা। কিন্তু যিনি এই কাজটি শিখিয়েছিলেন তিনিই আর রইলেন না। চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। নবিওয়ালা কাজের জিম্মাদারি কাঁধে চড়িয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন তিনি। ১৯৪৪ সালেল ১২ জুলাই প্রিয়তম প্রভুর সান্নিধ্যে চলে গেলেন মাওলানা ইলিয়াস। ###