নবি শব্দের পারিভাষিক অর্থ বা সংজ্ঞা হলো- আল্লাহ মনোনীত ব্যক্তিত্ব, আল্লাহর পক্ষ থেকে লোকালয়ে সংবাদ (আল্লাহর বাণী) পরিবেশনের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন যাঁরা; তারাই নবি। [সংক্ষিপ্ত ইসলামি বিশ্বকোষ, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা : ২৬]
মাওলানা মিরাজ রহমান : নবি আরবি শব্দ। আরবি ‘নাবায়ূন’ মূলধাতু থেকে নির্গত। বাংলা অর্থ সংবাদবাহক বা বার্তাবাহক। আর নবি শব্দটিকে আরবি ‘নাবওয়াতুন’ শব্দমূল থেকে নির্গত ধরা হলে এর অর্থ হবে সমগ্র মানব সমাজের উচ্চ মর্যাদায় আসিন ব্যক্তিত্ব। বহুবচন ‘নাবিয়্যূন’ ও ‘আনবিয়া’। [আল মুফরাদাত ফি গারিবিল কুরআন, পৃষ্ঠা : ৪৮২]
নবি শব্দের পারিভাষিক অর্থ বা সংজ্ঞা হলো- আল্লাহ মনোনীত ব্যক্তিত্ব, আল্লাহর পক্ষ থেকে লোকালয়ে সংবাদ (আল্লাহর বাণী) পরিবেশনের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন যাঁরা; তারাই নবি। [সংক্ষিপ্ত ইসলামি বিশ্বকোষ, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা : ২৬] হজরত আবু উমামা থেকে বর্ণিত সাহাবি হজরত আবু জর (রা.) বলেছেন, আমি রাসুলকে (সা.) জিজ্ঞাসা করলাম যে, নবিগণের সংখ্যা কত? রাসুল (সা.) উত্তরে বললেন, তাঁদের (নবিদের) সংখ্যা এক লাখ চব্বিশ হাজার, তন্মধ্যে রাসুল ছিলেন ৩১৫ (মতান্তরে ৩১৩ জন) জন। [মুসনাদে আহমদ, মিশকাত]
ইংরেজিতে Prophet বলতে সেসব ব্যক্তিকে বোঝানো হয়- যারা দাবি করেন যে, ঈশ্বর বা দেবতাদের সাথে তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যোগাযোগ বা বার্তা বিনিময় হয়েছে। তারা নিজেরা যে সকল শিক্ষা লাভ করেন তা নিঃস্বার্থভাবে অন্যান্য লোকদের মাঝে বিলিয়ে দেন। নবিদের অধিকাংশই মানুষকে সুসংবাদ অথবা সতর্কবার্তা প্রদান করেন। নবীগণ যে বার্তা লাভ করেন তাকে অহি বলা হয়। [[Muhammad, the Prophet of Allah]]
ইহুদি ধর্ম খ্রিস্টধর্মসহ সকল ধর্মে নবিগণের কথা উল্লেখ রয়েছে। আব্রাহামিক ধর্মসমুহে, দুই ধরনের নবির কথা উল্লেখ আছে। এরা হলেন প্রধান নবী এবং অ-প্রধান নবী। প্রধান নবীগণ মানুষকে বিভিন্ন রকমের শিক্ষা প্রদান করে থাকেন। অপরদিকে, অ-প্রধান নবীগণ পূর্বের নবীগণের শিক্ষাকেই সমাজে পুনঃবাস্তবায়ন করেন।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক আমাদের নবি সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন, (হে লোকেরা!) মুহাম্মাদ তোমাদের পুরুষদের মধ্য থেকে কারোর পিতা নয় কিন্তু সে আল্লাহর রসূল এবং শেষ নবী আর আল্লাহ সব জিনিসের জ্ঞান রাখেন। [আল আহজাব : ৪০]
এছাড়াও কুরআনে সূরা আস সফের ৬নং আয়াতে আল্লাহপাক শেষ নবি সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন। নবি-রাসুলদের মাঝে হজরত আদম (আ.) প্রথম মানব ও নবি [মিশকাত]। আর হজরত মুহাম্মাদ (সা.) সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি। যাঁরা উভয়ই নবি ও রাসুল ছিলেন।
মারেফুল কুরআনের, ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৪২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে, সকল রাসুলই নবি ছিলেন কিন্তু সকল নবি রাসুল ছিলেন না। আল্লাহ মনোনীত পৃথিবীতে প্রেরিত সকল পয়গম্বরই নবি অভিধাভুক্ত ছিলেন কিন্তু সব নবিই রাসুল ছিলেন না। নবি শব্দটি ব্যাপক। আর রাসুল শব্দটি বিশেষভাবে কিছু নবির জন্য নির্দিষ্ট। আল্লামা মুফতি আহমদ শফি (র.) লিখেছেন, নবি বলতে ঐ সত্তাকে বুঝতে হবে, যিনি তাঁর পূববর্তী শরিয়তের প্রচার-প্রসার চলিছেন।
নবি-রাসুলদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ইমানের মৌলিক বিষয়। প্রত্যেকজন মুমিন-মুসলিমের মাঝে দৃঢ়ভাবে এই বিশ্বাস থাকতে হবে, আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জাতির জন্য তাদের মধ্য থেকে এক একজনকে নবি-রাসুল বানিয়ে পাঠিয়েছেন। আর নবি-রাসুলদের কাজই ছিলো মানুষের কাছে এক আল্লাহর ইবাদত করা এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছুর ইবাদতকে অস্বীকার করার দাওয়াত পৌছানো। আল্লাহ বলেন পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, রাসুলদের দায়িত্ব তো শুধু সুস্পষ্ট বাণী পৌঁছে দেয়া (সূরা নাহল: আয়াত ৩৫)।
নবি-রাসুলদের মধ্যে যাদের নাম জানা যায় আর যাদের নাম জানা যায়নি সবার প্রতি যৌথভাবে ইমান আনতে হবে। যে ব্যক্তি কোনো একজন নবি-রাসুলকে এবং তাদের নবুয়াত বা রিসালাতকে অস্বীকার করল, সে যেন সব নবি-রাসুলকে এবং তাদের নবুয়াত বা রিসালাতকে অস্বীকার করল।
আল্লাহ বলেন, আপনার পূর্বে আমি যে রাসুলই পাঠিয়েছি, তাকে এ আদেশই করেছি, নেই কোনো উপাস্য আমি ব্যতীত; সুতরাং আমারই ইবাদত কর (সূরা আম্বিয়া: ২৫)। এই মর্মে আরো বিশ্বাস করা, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব নবি-রাসুলের দাওয়াতের মূল বিষয় ছিল যাবতীয় ইবাদত শুধু এক আল্লাহর জন্য পালন করা এবং অন্য সব উপাস্যকে অস্বীকার করা।
নবি-রাসুলদের প্রতি ইমান স্থাপন করার বিশেষ একটি দিক রয়েছে, আর সেটি হলো- বিশ্বাস রাখা যে, সর্বশেষ রাসুল হচ্ছেন হজরত মুহম্মদ (সা.)। তার পরে আর কোনো নবী আসবেন না।
নবুওয়াত বলতে আমরা কী বুঝি? নবুওয়াত হলো- সৃষ্টজীবের (বান্দার) মাঝে স্রষ্টার (আল্লাহ) শরিয়াত প্রচারের মাধ্যম বা উপায়-পদ্ধতি। আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা নবুওয়াতের জন্য মনোনীত করেন এবং নবুওয়াত দিয়ে সম্মানিত করেন। এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আল্লাহ ছাড়া কারো কোনো প্রকার আধিপত্য বা সিন্ধান্ত গ্রহণের অংশীদারিত্ব নেই।
আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ ফিরিশতা ও মানুষের মধ্য থেকে রাসূল মনোনীত করেন, নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (সূরা হাজ : ৭৫)
নবুওয়াত হলো আল্লাহ কতৃর্ক প্রদত্ত একটি সম্মান। কারো কায়িক বা শক্তিবলে অর্জিত কোনো বিষয় নয়। অধিক ইবাদাত বা আনুগত্যের মাধ্যমেও নবুয়াত পাওয়া যায় না। কোনো নবির নবুয়াতই তার ইচ্ছায় বা চাওয়ার মাধ্যমে অর্জিত হয়নি।
নবি-রাসুলের প্রতি বিশ্বাস না থাকলে, কোনো মুসলমানের ইমান পরিপূর্ণতা লাভ করবে না এবং নবি-রাসুলের প্রতি এই বিশ্বাস রাখাই তাদের হক বা অধিকার। নবি-রাসুলের হক বলতে তাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপণ করাকেই বোঝানো হয়। মানুষের দায়িত্বে থাকা নবি-রাসুলের হক আদায় করা আবশ্যক।
আল্লাহ মহান প্রেরিত এক লক্ষ চব্বিশ হাজার নবি-রাসুলদের মধ্য থেকে পবিত্র কুরআনে ২৫ জন নবি-রাসুলদের নাম আলোচিত হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেছেন পবিত্র কোআরনের মোট ২৬ জন নবি-রাসুলের নাম উল্লেখ রয়েছে। পবিত্র কুরআনে আলোচিত নবি-রাসুলগণের নামগুলো হলো- ১. হজরত আদম (আ.)। ২. হজরত ইদরিস (আ.)। ৩. হজরত নুহ (আ.)। ৪. হজরত হুদ (আ.)। ৫. হজরত সালিহ (আ.)। ৬. হজরত ইবরাহিম (আ.)। ৭. হজরত ইসমাইল (আ.)। ৮. হজরত ইসহাক (আ.)। ৯. হজরত লূত (আ.)। ১০. হজরত ইয়াকুব (আ.)। ১১. হজরত ইউসুফ (আ.)। ১২. হজরত শুয়াইব (আ.)। ১৩. হজরত মুসা (আ.)। ১৪. হজরত ইলিয়াস (আ.)। ১৫. হজরত ইয়াশা (আ.)। ১৬. হজরত দাউদ (আ.)। ১৭. হজরত সুলায়মান [আ.]। ১৮. হজরত আই্য়ূব (আ.)। ১৯. হজরত ইউনুস (আ.)। ২০. হজরত জুল-কিফল (আ.)। ২১. হজরত জাকারিয়া (আ.)। ২২. হজরত ইয়াহইয়া (আ.)। ২৩. হজরত শোয়াইব (আ.)। ২৪. হজরত ইসা (আ.)। ২৫. হজরত মুহাম্মাদ [সা.]। এই হলো পবিত্র কোরআনে বর্ণিত ২৫জন নবি-রাসুলের নাম। আর যারা বলেন যে পবিত্র কোরআনের ২৬জন নবি-রাসুলের আলোচনা এসেছে তারা হজরত লোকমান (আ.) -এর নাম যুক্ত করেছেন।
এছাড়া আরো রয়েছেন হজরত শীস (আ.), হজরত হারুন (আ.), হজরত শামুইল (আ.), হজরত খিজির (আ.), হজরত হিজকিল (আ.), হজরত উজায়ির (আ.), হজরত ইউশা ইবনে নুন (আ.)। আলোচ্য নামগুলির বাহিরেও আরো কিছু নবিদের নাম ইতিহাসের বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া যায়। সেগুলো হলো- হজরত শাহ সেকান্দার (আ.), হজরত হরকিল (আ.), হজরত কালুত (আ.), হজরত দানিয়াল (আ.), হজরত আরমিয়া (আ.), ও হজরত আজির (আ.)। [সিরাত বিশ্বকোষ, ইসলামি ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ; তাজকেরাতুল আম্বিয়া, রশিদ আহমদ; নবি সমগ্র, শাহানা ফেরদাউস; কসাসুল নাবিয়্যিন, আবুল হাসান আলি নদভি, সংক্ষিপ্ত ইসলামি বিশ্বকোষ, ইসলামি ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ]
সৌজন্যে : প্রিয়.কম
কমেন্টস করুন