জীবনী ভিডিও স্কলারস

নোবেল পুরস্কার জিতেছেন যেসব মুসলিম

Featured Video Play Icon
লিখেছেন মিরাজ রহমান

নোবেল পুরস্কারের সূচনা ১৯০১ সালে। ১৮৯৫ সালে সুয়েডীয় বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের করে যাওয়া একটি উইলের মর্মানুসারে এ পুরস্কারের প্রচলন ঘটে। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সফল গবেষণা ও উদ্ভাবন এবং মানবকল্যাণমূলক বিভিন্ন কর্মকা-ের স্বীকৃতিস্বরূপ মূলত এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। নোবেল পুরস্কারের সুদীর্ঘ ইতিহাসে এখন পর্যন্ত মোট ১২ জন মুসলিম ব্যক্তিত্ব এ সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। আজ আমরা সেই ১২ জন মুসলিম নোবেল বিজয়ীর কথা জানবো, নোবেল পুরস্কার জিতে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন যারা।

১. মুহাম্মদ আনোয়ার সাদাত : মিসরের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রথম মুসলমান। ১৯৭৩ সালে মিসরের সিনাই উপদ্বীপ উদ্ধারের জন্য ইয়ম কিপুর যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন তিনি। এরপর ১৯৬৭ সালে ইসরাইল এই উপদ্বীপ দখল করে নেয়। আনোয়ার সাদাত ইসরাইলের সঙ্গে মিসর-ইসরাইল শান্তিচুক্তি সই করতে সক্ষম হন। এই চুক্তির কারণে আনোয়ার সাদাত ও ইসরাইলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মেনাহিম বেগিম ১৯৭৮ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। আনোয়ার সাদাতের জন্ম ১৯১৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর এবং মৃত্যু ১৯৮১ সালের ৬ অক্টোবর।

২. মুহাম্মদ আবদুস সালাম : প্রফেসর মুহাম্মদ আবদুস সালাম পাকিস্তানি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী। ১৯৭৯ সালে স্টিভেন ওয়াইনবার্গ ও শেল্ডন লি গ্যাশোর সঙ্গে যৌথভাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন তিনি। দুর্বল তড়িতত্ত্ব আবিষ্কারের জন্য তারা এ পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯২৬ সালের ২৯ জানুয়ারী আবদুস সালাম পাকিস্তানের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৯৬ সালের ২১ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। নোবেল পুরস্কার ছাড়াও আবদুস সালাম আরো বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও বিজ্ঞানের নানা উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন।

৩. নাজিব মাহফুজ : নোবেল বিজয়ী মিসরীয় সাহিত্যিক নাজিব মাহফুজ। ১৭ বছর বয়স থেকে লেখালেখি শুরু করেন তিনি। মোট ৩০টি উপন্যাসে রচয়িতা হলেও ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৫৭ সালের মধ্যে প্রকাশিত ‘কায়রো ট্রিলজি’ তাকে আরবি সাহিত্যের অনন্য উচ্চতায় সমাসীন করে। এতে তিনি মিসরের ঐতিহ্যবাহী শহুরে জীবনধারার চিত্রকে নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলেন। উচ্চমার্গীয় এ উপন্যাসের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৮ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ১৯১১ সালের ১১ ডিসেম্বর এক মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০০৬ সালের ৩০ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।

৪. ইয়াসির আরাফাত : ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী বিশ্বনন্দিত নেতা ছিলেন ইয়াসির আরাফাত। ১৯৯৪ সালে ঐতিহাসিক অসলো চুক্তি সইয়ের পর আইজাক রবিন, শিমন পেরেজের সঙ্গে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাত। শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার লাভকারী প্রথম ফিলিস্তিনি নাগরিক এবং দ্বিতীয় মুসলমান তিনি। তার বাবার নাম আবদেল রউফ আল কুদওয়া আল হুসাইনি। ১৯২৯ সালের ২৪ আগস্ট জন্ম গ্রহণ করেন তিনি এবং মৃত্যুবরণ করেন ২০০৪ সালের ১১ নভেম্বর।

৫. আহমদ হাসান জুয়েইল : ফেমটোসেকেন্ড স্পেকট্রোস্কোপি ব্যবহার করে মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কারের জন্য রাসায়নিক ক্ষেত্রে গবেষণা করে ১৯৯৯ সালে তিনি রসায়নে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনি প্রথম মুসলিম রসায়নবিদ ও দ্বিতীয় মুসলিম বিজ্ঞানী হিসেবে নোবেল পুরস্কার জয় করেছেন। ১৯৪৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী মিশরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আহমদ হাসান জুয়েইল। তার মৃত্যু হয় ২০১৬ সালের ২ আগস্ট। তিনিই মিশরের প্রথম ব্যক্তি যিনি বিজ্ঞানের কোনো শাখায় নোবেল পুরস্কর লাভ করেছেন। গোটা বিশ্বের মুসলিম রসায়সবিদদের তালিকায় তিনি অন্যতম ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত।

৬. শিরীন এবাদি : শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রথম মুসলিম নারী তিনি। এ ছাড়া তিনি প্রথম ও একমাত্র ইরানি নাগরিক বিশ্ব শান্তিতে অবদান রাখায় এ সম্মান দেওয়া হয়েছে যাকে। শিরীন এবাদি ব্যক্তিগত জীবনে একজন আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় অবদান রাখার জন্য তিনি ২০০৩ সালে এ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৪৭ সালের ২১ জুন এবাদি ইরানের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মোহাম্মাদ আলী এবাদি। তিনি ছিলেন বিখ্যাত লেখক ও শিক্ষাবীদ। শিরীনের মায়ের নাম মিনু ইয়ামিনী।

৭. মুহাম্মেদ আল বারাদেই : মুহাম্মেদ আল বারাদেই মিসরের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন। তিনি দ্বিতীয় মিসরীয়, যাকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধে ভূমিকা পালনের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৫ সালে তিনি এবং তার তত্ত্বাবধানের প্রতিষ্ঠান আইএইএ নোবেল পুরস্কার লাভ করে। আল বারাদেই ১৯৪২ সালের ১৭ জুন মিশরের এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পেশাগত জীবনে তিনি একজন আইন বিশেষজ্ঞ এবং দক্ষ কুটনীতিক।

৮. ড. মুহাম্মদ ইউনূস : ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। তিনিই একমাত্র ও প্রথম বাংলাদেশি মুসলিম, যাকে শান্তির জন্য এ সম্মান দেওয়া হয়। এছাড়া তিনি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী তৃতীয় বাঙালি। মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। ড. মুহাম্মদ ইউনুস ১৯৪০ সালের ২৮ জুন বাংলাদেশের এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হাজী দুলা মিয়া সওদাগর এবং মাতার নাম সুফিয়া খাতুন। এ পুরস্কার ছাড়াও বিশ্ব খাদ্য পুরস্কারসহ আন্তর্জাতিক বহু পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি।

৯. ওরহান পামুক : ওরহান পামুক একজন তুর্কি ঔপন্যাসিক, চিত্রনাট্য সম্পাদক ও শিক্ষক। ২০০৬ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হন। ওরহান পামুকের বই বিশ্বের ৬০টির বেশি ভাষায় ও ১০০টির বেশি দেশে এবং এক কোটি ৪০ লাখ কপির বেশি বিক্রি হয়েছে। তুরস্কের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ কথাসাহিত্যিক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। তার সর্বাধিক প্রসিদ্ধ উপন্যাসের নাম ‘নিউ লাইফ’। ১৯৫২ সালের ৭ জুন তুরস্কেও এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। নিজেকে একজন সাংস্কৃতিক মুসলিম পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন ওরহান পামুক।

১০. তাওয়াক্কোল কারমান : তাওয়াক্কোল কারমান একজন ইয়েমেনি সাংবাদিক ও ইয়েমেনের আল ইসলাহ রাজনৈতিক দলের প্রবীণ সদস্য। ‘উইমেন জার্নালিস্ট উইদাউট চেঞ্জ’ নামের নারী সাংবাদিকদের একটি দলকে নেতৃত্ব দেন তিনি। ২০১১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করেন তাওয়াক্কুল কারামান। তিনিই প্রথম ইয়েমেনি ও প্রথম আরব নারী হিসেবে এ পুরস্কার জয় করেন। এ ছাড়া তিনি দ্বিতীয় মুসলিম নারী ও দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে নোবেল শান্তি পদক লাভ করেন। ১৯৭৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ইয়েমেনে জন্ম গ্রহণ করেন কারামান। তার পিতার নাম আব্দেস সালাম। তিনি একজন মন্ত্রী ছিলেন।

১১. মালালা ইউসুফ জাই : মালালা একজন পাকিস্তানি শিক্ষা আন্দোলনকর্মী। এছাড়া মানবাধিকারকর্মী হিসেবেও তার প্রসিদ্ধি রয়েছে। ২০১৬ সালে সবচেয়ে কম বয়সে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন তিনি। উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের সোয়াত উপত্যকা অঞ্চলে শিক্ষা এবং নারী অধিকারের নিয়ে আন্দোলনের জন্য তিনি বিশ্বময় পরিচিত। মালালা ১৯৯৭ সালের ১২ জুলাই পাকিস্তানের এক সুন্নী মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম জিয়াউদ্দিন ইউসুফ জাই। জাতিসত্তা হিসেবে মালালাকে পশতুন বংশদ্ভুত ধরা হয়।

১২. আজিজ সানজার : তুর্কি বংশোদ্ভূত একজন আমেরিকান প্রাণরসায়নবিদ ও কোষবৈজ্ঞানিক তিনি। ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএ পুনরায় উৎপাদন সংক্রান্ত গবেষণার জন্য ২০১৫ সালে থমাস লিন্ডাল ও পল মড্রিকের সঙ্গে যৌথভাবে রসায়নে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন আজিজ। তিনি প্রথম তুর্কি রসায়নবিদ ও দ্বিতীয় তুর্কি এবং তৃতীয় মুসলিম বিজ্ঞানী হিসেবে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৪৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর তুরস্কের মারদিন প্রদেশে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বর্তমানে তিনি আজিজ এন্ড গুয়েন সানজার নামক একটি প্রতিষ্ঠানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেব কাজ করছেন।

Comment

লেখক পরিচিতি

মিরাজ রহমান

গতানুগতিক ধারার বাইরে থেকে কাজ করে ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন মিরাজ রহমান। পেশায় পুরোদস্তুর একজন সাংবাদিক হলেও কেবল ইসলামকে ঘিরেই আবর্তিত তার ধ্যান-জ্ঞান। দৈনিক পত্রিকার ইসলাম পাতায় লেখালেখি থেকে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন বটে, কিন্তু একসময় শিল্প চর্চায়ও ছিলেন বেশ মনোযোগী।
মিডিয়ায় সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেছেন যখন, তখনও তিনি ছাত্র। মাদানিনগর মাদরাসার কাফিয়া জামাতের (শ্রেণি) শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় কণ্ট্রিবিউটর হিসেবে প্রথম কাজ শুরু করেন দৈনিক যুগান্তরে। ধারালো লিখনী শক্তি অল্পদিনের মধ্যে পরিচিত করে তোলে তাকে। দেশের জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রায় সবগুলোতেই ইসলামবিষয়ক কলাম ও ফিচার লিখেছেন দীর্ঘ সময়। জাতীয় প্রিন্ট মিডিয়াগুলোতে তার অন্তত দুই সহস্রাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
মিরাজ মূলত পড়াশুনা করেছেন কওমি শিক্ষাধারায়, এর পাশাপাশি তিনি জেনারেল শিক্ষাধারায়ও পড়াশুনা করছেন। সহ-সম্পাদক হিসেবে প্রথম যোগদান করেন দৈনিক ডেসটিনি পত্রিকায়। সেখান থেকে দৈনিক কালের কণ্ঠে। দেশে-বিদেশে অনলাইন গণমাধ্যমের জয়যাত্রা শুরু হলে মিরাজ ইন্টারনেট জগতকে ইসলাম প্রচারের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র বিবেচনা করে অনলাইনেই গাঁটছাড়া বাঁধেন। দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইসলামবিষয়ক অনলাইন পোর্টাল প্রিয়.কমের ‘প্রিয় ইসলাম’-এর সৃষ্টি ও পথচলার সূচনা তারই হাতে। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন প্রিয়.কমের প্রিয় ইসলাম বিভাগের এডিটর ইনচার্জ। সর্বশেষ কর্মরত ছিলেন দৈনিক বাংলাদেশের খবরের ফিচার ইনচার্জ হিসেবে।
টেলিভেশনে অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা ও আলোচনার সঙ্গেও ইতিমধ্যে যুক্ত হয়েছেন মিরাজ রহমান। পরিচালনা করেছেন বেশ কিছু অনুষ্ঠানও। এসো কলম মেরামত করি, ছোটদের নবী-রাসূল সিরিজ, তাবলিগী জামাতের পৃষ্ঠপোষক-মুরুব্বি ছিলেন যাঁরা, শরয়ী পর্দার বিধান, আশিক মিন ফিলিস্তিন, নারী তুমি সৌভাগ্যবতী ও হালাল ব্যবসা ও হালাল অর্থনীতির কথকতাসহ বেশ কিছু আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থেও জনক তিনি। বর্তমান তিনি ইসলাম প্রতিদিনের সম্পাদক ও প্রকাশক এবং দ্য সুলতান প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।