গবেষণা

শব্দে শব্দে দীন শেখা : আখিরাত


আখেরাতের কয়েকটি অধ্যায় বা স্তর রয়েছে। মৃত্যু পর সে অধ্যায়গুলো মানুষের জীবনে একটির পর আরেকটি আসে। অধ্যায়গুলো হলো- ১. মৃত্যু। ২. আলমে বরযখ বা কবরের জীবন। ৩. কিয়ামত। ৪. হাশর ও বিচার। ৫. জান্নাত বা জাহান্নাম।


মাওলানা মিরাজ রহমান : আখিরাত একটি আরবি শব্দ। একটি প্রসিদ্ধ ইসলামি পরিভাষা। শাব্দিকভাবে এর অর্থ মানুষের মৃত্যু পরবর্তী জীবন। আখিরাত বলতে মৃত্যুর পর থেকে অনন্তকালের জীবনকে বুঝায়। কবর, হাশর, হিসাব, পুলসিরাত ও জান্নাত-জাহান্নাম সবকিছুই এই একটি শব্দ বা পরিভাষার অন্তর্ভুক্ত।

কোরআন-হাদিসের আলোকে আখিরাত : মানুষের মৃত্যুর পরবর্তী জীবনকে বলা হয় আখিরাত। পবিত্র কোরআনে এই মর্মে বলা হয়েছে, সেদিন অবশ্যই আসবে যখন মুত্তাকি লোকদের আমি মেহমানের মতো রহমানের দরবারে উপস্থিত করব। আর পাপী অপরাধী লোকদের পিপাসু জানোয়ারের মতো জাহান্নামের দিকে তেড়ে নিয়ে যাবো। সেই সময় লোকেরা কোনো সুপারিশ করতে সক্ষম হবে না তাদের ব্যতীত যারা রহমানের দরবার থেকে প্রতিশ্রুতি লাভ করেছে। (সূরা মারিয়াম, আয়াত ৮৫-৮৭)

হাদিসে এসেছে, হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর নবিকে এ কথা বলতে শুনেছি যে, কিয়ামাতের দিন মানব জাতিকে খালি পায়ে, উলঙ্গ ও খাতনাবিহীন অবস্থায় একত্র করা হবে। আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এমতাবস্থায় তো নারী-পুরুষ পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকাবে। হুজুর (সা.) বললেন, হে আয়েশা! সেদিনকার অবস্থা এত ভয়াবহ হবে যে, পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকানোর কোনো কল্পনাই কেউ করবে না। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)

আখিরাতের স্তর বা অধ্যায় : পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে আখিরাতের জীবনকে দুভাগে বিন্যাস করা হয়েছে- ১. মৃত্যু থেকে কিয়ামত পর্যন্ত। ২. কিয়ামত থেকে অনন্তকাল অবধি। সেখানে মৃত্যু ও ধ্বংস নেই। প্রথম পর্যায়ের নাম আলমে বরযখ বা কবরের জীবন। মৃত্যুর পর মানব দেহ কবরস্থ করা হোক কিংবা না করা হোক কিংবা সাগরে ভাসিয়ে দেয়া হোক কিংবা আগুনে ভষ্মীভূত হয়ে যাক বা অন্যকোন ভাবে নিশেষ হয়ে যাক- সর্বাবস্থায় তারপর থেকে বরযখ জীবন শুরু হয়। আর দ্বিতীয় পর্যায় হল কিয়ামত, হাশর নশর বা অনন্তকালের জীবন।

আখেরাতের কয়েকটি অধ্যায় বা স্তর রয়েছে। মৃত্যু পর সে অধ্যায়গুলো মানুষের জীবনে একটির পর আরেকটি আসে। অধ্যায়গুলো হলো- ১. মৃত্যু। ২. আলমে বরযখ বা কবরের জীবন। ৩. কিয়ামত। ৪. হাশর ও বিচার। ৫. জান্নাত বা জাহান্নাম।

আখিরাত নাম কেন রাখা হলো : আখিরাত বা পরকালের নাম করণের কারণ হলো- যে এই দিনের পর আর কোনো দিন নেই, নেই কোনো কাল বা সময়। সে দিন থেকে জান্নাতিরা জান্নাতে এবং জাহান্নামিরা জাহান্নামে চিরকাল থাকবে।

আখিরাতের প্রতি ঈমান : এই মর্মে দৃঢ় বিশ্বাস করা, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কিয়ামতের দিনে যা কিছু সংগঠিত হওয়ার সংবাদ প্রদান করেছেন তা সবই সত্য। যেমন, পূনরুত্থান, একত্রিত হওয়া, হিসাব প্রদান করা, পুলসিরাত, দাঁড়িপাল্লা, জান্নাত, জাহান্নাম, কিয়ামত সংক্রা আরো অন্যান্য বিষয় সবই সত্য। পরকালের আলোচনায় মৃত্যুর পূর্বের অবস্থা অর্থাৎ কিয়ামতের নিদর্শন এবং মৃত্যুর পরের অবস্থা, কবরের যন্ত্রণা, কবরের সুখ, শান্তি ইত্যাদি সবই সত্য- মহাসত্য।

আখিরাতের গুরুত্ব : আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ রোকন। দুনিয়া ও পরকালের যতবীয় সফলতা এই উল্লেখিত দুটি বিশ্বাসের প্রতি নির্ভরশীল। আখিরাতের বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, মহান আল্লাহ তাঁর প্রতি বিশ্বাসের কথা পবিত্র কোরআনের বহু স্থানে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমাদের মধ্যে যে আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান আনে এটি দ্বারা তাকে উপদেশ দেয়া হচ্ছে। (সূরা তালাক: ২)

অন্যত্র আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই। অবশ্যই তিনি তোমাদেরকে একত্র করবেন কিয়ামতের দিনে। এতে কোন সন্দেহ নেই। (সূরা নিসা: ৮৭)

আখিরাতের প্রথম ঘাটি কবর : হজরত বারা ইবনে আযেব সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা একদা রাসূল (সা.)-এর সাথে জানাজার নামাজ পড়ার জন্য বের হলাম। এ সময় রাসূল (সা.) বললেন, মৃত বক্তিকে কবরস্থ করার পর, তার কাছে দুজন ফেরেশতা আসেন, তারা তাকে প্রশ্ন করেন, তোমরা রব কে? তখন তিনি বলেন, আল্লাহ আমার রব, অতঃপর তারা প্রশ্ন করেন, তোমার দীন কি ছিল? তখন তিনি বলেন, ইসলাম আমার দীন, আরো প্রশ্ন করা হয়, এই ব্যক্তি সম্পর্কে তোমার কি ধারণা যাকে তোমার নিকট পাঠানো হয়েছিল? তখন তিনি জবাব দেন, তিনি হলেন, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাাহ। (আহমদ: ১৮৭৩৩ ও আবু দাউদ)

মৃত্যু থেকে কিয়ামত পর্যন্ত রূহ কোথায় থাকবে? আলমে বরযখ তথা কবর জগতে কিয়ামত পর্যন্ত রূহসমূহ বিশাল ব্যবধানে থাকবে। কিছু রূহ থাকবে ইল্লিয়্যিন সুমহান উঁচু স্থানে, আর তা হলো, আম্বিয়ায়ে কেরামগণের রূহ, তাদের মধ্যে কিছুটা মর্যাদার ব্যবধান থাকবে। আবার কিছু রূহ পাখির আকৃতিতে জান্নাতের গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকবে। আর তা হলো, মুমিনদের রূহ। আর কিছু রূহ সবুজ পাখির অভ্যন্তরে জান্নাতে উড়ে বেড়াবে। আর তা হলো শহীদদের রূহ। আবার কিছু রূহ কবরেই আটক থাকে, গনীমতের তালার মতো। কিছু রূহ জান্নাতের দরজা পর্যন্ত গিয়ে আটক থাকে, ঋণের কারণে। আর কিছু পৃথিবীতে আটকে থাকে, উপরে যাওয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলার কারণে। কিছু রূহ ব্যভিচারের চুলায় উত্তপ্ত হতে থাকবে। আবার কিছু রূহ রক্তের নদীতে সাতার কাঁটতে থাকবে এবং তাদের পাথর নিক্ষেপ করা হবে। আর তারা হলো সুদ খোর।

পবিত্র কোরআনুল করিমে অসংখ্য বর্ণনা পাওয়া যায় আখিরাত সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে। সুরা যিলযাল ৭-৮, আনআম ৩২, আরাফ ১৮৭, বনী ইসরাঈল ২১, মরিয়ম ৮৫-৮৭, ত্বহা ১০৯, নামল ৪-৫, কাসাস ৮৩, ইয়াসীন ৫৪, আনকাবূত ৬৪, শু‘আরা ২০, ওয়াযযোহা ৪৬, গাশীয়া ১-৪, ইউসুফ ৫৭, আলে ইমরান ১৮৫, ইউনুস ৪৫, নাহল ১১১, যিলযাল ১-৫, যুমার ৭০ এবং আম্বিয়া ৩৫ নং আয়াতে আখিরাত সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা পেশ করা হয়েছে। এছাড়া আরো যেসব স্থানের আখিরাত বিষয়ে আলোচনা স্থান লাভ করেছে তা হলো-১. (সূরা. বাকারাহ ২ : আয়াত ৪)। ২. (সূরা. বাকারাহ ২ : আয়াত ৮৬)। ৩. (সূরা. বাকারাহ ২ : আয়াত ৯৪)। ৪. (সূরা. বাকারাহ ২ : আয়াত ১০২)। ৫. (সূরা. বাকারাহ ২ : আয়াত ১১৪)। ৬. (সূরা. বাকারাহ ২ : আয়াত ১৩০)। ৭. (সূরা. বাকারাহ ২ : আয়াত ২০০)। ৮. (সূরা. বাকারাহ ২ : আয়াত ২০১)। ৯. (সূরা. বাকারাহ ২ : আয়াত ২১৭)। ১০. (সূরা. বাকারাহ ২ : আয়াত ২২০)। ১১.  সূরা. আলে ইমরান ৩ : আয়াত. ২২)। ১২.  সূরা. আলে ইমরান ৩ : আয়াত. ৪৫)

মুমিনের আসল ঠিকানা : একজন সত্যিকারের মুমিন মনে করেন, তার আসল ঠিকানা হলো আখিরাত। তাই সে আখিরাতের ঘর বানানোর কাজে সদা থাকেন সচেষ্ট। আর আখিরাতের ঘর হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জান্নাত। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘সৎ কর্মশীল মুমিনদের জন্য রয়েছে নিয়ামতে ভরা জান্নাত। চিরকাল তারা তা উপভোগ করবে। এটা আল্লাহর ওয়াদা। আর তিনি মহাশক্তিশালী ও সুবিজ্ঞ।’ (সূরা লোকমান, আয়াত ৮-৯)

মুমিনের আখিরাত প্রস্তুতি : আখিরাতে চিরসুখ ভোগ করতে একজন মুমিন দুনিয়ার জীবনে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বিলিয়ে দেন আল্লাহর দ্বীনের পথে। দুনিয়ার কোনো বাধা, অর্থবিত্ত তার কাছে বড় মনে হয় না, বড় মনে হয় আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়ন করাকে। মুমিনের কর্মপ্রস্তুতি সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন (এর বিনিময়ে) যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে। অতএব তারা মারে ও মরে। তাওরাত, ইঞ্জিল ও কোরআনে এ সম্পর্কে সত্য ওয়াদা রয়েছে। আর নিজ ওয়াদা পূরণে আল্লাহর চেয়ে অধিক কে হতে পারে? সুতরাং তোমরা (আল্লাহর সাথে) যে সওদা করেছে, সে সওদার জন্য আনন্দিত হও এবং সেটাই মহাসাফল্য।’ (সূরা তাওবা, আয়াত ১১১)

Comment

লেখক পরিচিতি

আবদুল্লাহ মারুফ

আমি আবদুল্লাহ মারুফ। বর্তমানে অধ্যয়নরত আছি আল বায়ান অ্যারাবিক লানিং সেন্টারে। পাশাপাশি নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি হেরার জ্যোতি ও মাসিক ঘাসফড়িঙ -এর। পড়াশুনা, লেখালেখি আর ঘুরে বেড়ানো এই আমার ছোট্ট জীবন। ইসলাম প্রতিদিনের সাথে আছি কন্ট্রিবিউটিং রাইটার হিসেবে।

কমেন্টস করুন