নবীজি (সা.)

রাসুল (সা.) কি কখনো ঘরের কাজ করতেন?

লিখেছেন মনযূরুল হক

আসওয়াদ (রা.) বলেন আমি আয়েশাকে (রা.) জিজ্ঞেস করলাম, রাসুল (সা.) ঘরে কী করেন? আয়েশা (রা.) বললেন, তিনি ঘরোয়া কাজ-কর্মে ব্যস্ত থাকেন। নামাজের সময় হলে নামাজ পড়তে যান। (বুখারী, হাদিস ৬৭২)
হজরত আয়েশা (রা.) এর মাধ্যমে বুঝিয়েছেন যে, ঘরের যাবতীয় কাজ-কর্মে নবীজি অংশগ্রহণ করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, নবীজি নিজ হাতে জুতা সেলাই করতেন, জামা সেলাই করতেন। তোমাদের মতো তিনি ঘরের যাবতীয় কাজ নিজ হাতে করতেন। (ফাতহুর রব্বানি, খন্ড- ২২, পৃষ্ঠা ২৩) হজরত আয়েশা (রা.)-কে প্রশ্ন করা হলো, রাসুল (সা.) সারাদিন ঘরে কী করেন? আয়েশা (রা.) বলেন, তিনি তো তোমাদের মতো মানুষ। তিনি নিজ কাপড়ে তালি লাগান। বকরির দুধ দোহন করেন এবং নিজের যত্ন নেন। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২২)
তিনি নিজের কাজ নিজেই করতেন। কারো সহযোগিতা নিতেন না। যে কাজ নিজে করতে পারবেন তা কখনো অন্যকে করে দিতে বলেন নি। একবার তিনি একদল সাহাবীকে বাইয়াত করলেন; যার সারাংশ হলো, মানুষের কাছে কিছু চেয়ো না।
বর্ণনাকারী বলেন, যারা রাসুল (সা.)-এর হাতে বাইয়াত নিয়েছে তাদের একজনকে দেখেছি তার ঘোড়ার চাবুক মাটিতে পড়ে গেলো, তিনি চাবুক উঠানোর জন্য কাউকে বললেন না। নিজেই তুলে নিলেন।
নবীজি চাইলে জুতা মেরামত ও জামা সেলাইয়ের জন্য অবশ্যই লোকজন পেতেন। তার স্ত্রীরাও করে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা চান নি। নিজের কাজ নিজেই করেছেন। বোঝা যায়, তিনি তার ব্যক্তিগত কাজ করে দেওয়াকে স্ত্রীদের দায়িত্ব মনে করতেন না। স্ত্রীরা নিজেদের পক্ষ থেকে যতটুকু করতেন মুস্তাহাব হিসেবে করতেন। এটা শুধু তার কাজ থেকে বোঝা যায় এরকম নয়। রাসুল (সা.)-এর মৌখিক হাদিস থেকেও এটা স্পষ্ট হয়। স্ত্রীর ওপর স্বামীর অধিকার সম্পর্কে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোথাও স্ত্রীর ওপর স্বামীর খেদমত ওয়াজিব বলা হয় নি। বা এমন কোনো ইশারাও করা হয় নি যা থেকে বোঝা যায় স্বামীর খেদমত করা স্ত্রীর ওপর ওয়াজিব।
ইমাম মালেক (রহ.), আবু হানিফা (রহ.) ও শাফেয়ী (রহ.) বলেন, স্ত্রীর ওপর স্বামীর খেদমত করা ওয়াজিব নয়। (ফিকহুস সুন্নাহ, খন্ড- ২, পৃষ্ঠা ১৮৪) ফুকাহায়ে কেরামের অনেকে বলেন, ওয়াজিব। সমাজে প্রচলিত রেওয়াজ অনুযায়ী তারা এ-কথা বলে থাকেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহ.) তাদের সাথে একমত পোষণ করেছেন। তিনি প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন, আলী (রা.)-এর বাড়িতে সব কাজ ফাতেমা (রা.) করতেন এবং আসমা (রা.) যুবায়ের (রা.)-এর ঘরের সব কাজ করতেন। আসমা (রা.) বলেন, আমি আমার স্বামী যোবায়েরের ঘরের সব কাজ করতাম। (যাদুল মায়াদ, খন্ড- ৫, পৃষ্ঠা ১৮৭)
প্রথম মাজহাবের ইমামগণ তাদের উত্তরে বলেন, ফাতেমা ও আসমা (রা.)-এর কাজ করাটা দয়া ও উত্তম হিসেবে। বিষয়টি ফিকহী উসুলের ভিত্তিতে যাচাই করা যাক। ফাতেমা (রা.)-কে যে-সকল কাজ করার জন্য রাসুল (সা.) বলেছিলেন, তার দ্বারা এরকম কাজ করা জায়েয সাব্যস্ত হয়। ওয়াজিব হওয়াটা কিছুতেই প্রমাণিত হয় না। অতএব, স্বামীর খেদমত করা জায়েয। কিছুতেই ওয়াজিব হতে পারে না।
তদুপরি ফিকহী মতানৈক্য ব্যতীতই নবীজির চরিত্র মাধুরী থেকে প্রমাণিত হয়, ১. স্ত্রীরা ঘরের খাদেমা বা খাদেমার মতোও নয়। ২. ঘরোয়া কাজ-কর্ম তারা ভালোবাসা ও উত্তম চরিত্রের দাবিতে করে থাকে। যেহেতু বিষয়টা এমনই। তাই স্বামীর জন্য এটা কখনোই সমীচীন নয় যে, সকল কাজ স্ত্রীর জন্য বোঝা স্বরূপ রেখে দেবে। বরং পারিবারিক সকল কাজে স্ত্রীর সাথে মিলেমিশে করা উচিত। যেমন নবীজি (সা.) করতেন। ৩. সংখ্যাগরিষ্ঠ ফকীহ যে ওয়াজিব না হওয়ার পক্ষে, সেটা প্রত্যেক স্বামীর অন্তরে থাকা উচিত। তারা যেনো জানে, স্ত্রী ঘরের কাজ করছে নিজের ইচ্ছায়।
সুতরাং প্রত্যেক স্বামী থেকে দুটি বিষয় কাম্য, এক. সর্বদা স্ত্রীর কৃতজ্ঞতা আদায় করা, তার সাথে সুন্দর ভাষায় কথা বলা। স্ত্রীর সাথে খোশগল্প করাটাও সদকা।দুই. স্ত্রী যদি কখনো শারীরিক অসুস্থতা কিংবা অন্যকোনো কারণে কাজ না করে, তাহলে সেদিন স্ত্রীর প্রতি অসন্তুষ্ট বা রাগানি¦ত না হওয়া। কারণ এটা তো স্ত্রীর দায়িত্ব নয়, বরং এহসান।
উল্লেখিত আলোচনার সারাংশ হলো, প্রথমত : প্রত্যেকের উচিত তার ব্যক্তিগত কাজ নিজে করা, যেমনটি রাসুল (সা.)-এর অভ্যাস ছিলো। দ্বিতীয়ত : ঘরোয়া কাজে স্ত্রীর সাথে শরিক হওয়া, যেমনটি নবীজি করতেন।

মূল— সালেহ আহমদ শামী। ভাষান্তর— মনযূরুল হক। সূত্র— আকিক পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত মুহাম্মদ (সা.) ব্যক্তি ও নবী নামক গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত।

Comment

লেখক পরিচিতি

মনযূরুল হক

আমি মনযূরুল হক। সার্টিফিকেটে নাম মো. মনযূরুল হক মোর্শেদ। পেশা ও নেশা লেখালেখি। পড়াশুনার পাশাপাশি কাজ করছি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা নিতান্তই কম না- ৭টি। ২০১৫ সালে সামওয়্যারইনব্লগে সেরা লেখা নির্বাচিত হয়ে পুরুস্কৃত হয়েছি।