দিবস বিধান

প্রসঙ্গ : ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’

‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’- শ্লোগানটি বেশ আগে থেকে আমাদের দেশে শোনা গেলেও গত ২০১৬ সালের দূর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে কেন যেন বিভিন্ন প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে বিষয়টিকে ঢালাওভাবে প্রচার করা হয়েছিল বেশি। তাছাড়াও এবারের হিন্দুদের হোলি নিয়েও যুবক যুবতিদের অতি মাতামাতিও সবার নজর কেড়েছে। সামাজিক মিডিয়াগুলোতেও তার প্রভাব লক্ষণীয়। অনেক যুবকই খুব উৎসাহের সাথে বিভিন্ন পূজামন্ডপগুলোতে যায়, হোলিতে অংশগ্রহণ করে এবং তার কিছু ছবি ফেসবুকে শেয়ার করেছে। এ সংক্রান্ত বিভিন্নজনের দেয়া ফেসবুক স্টাটাসগুলো বিজ্ঞজনদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে। কলেজ পড়ুয়া মেয়েরা বাসায় ফেরার পথে তাকে হলির নামে হেনস্থা করাটা বেশ গুরুত্বের সাথে বিভিন্ন টিভি মিডিয়াতে প্রচার হয়েছে। তাছাড়া কিছুদিন আগে আমাদের পাশের দেশ ভারতে কুমারী পূজাতে একজন মুসলিম মেয়ের অংশগ্রহণও গুরুত্বের সাথে বিভিন্ন মিডিয়াতে স্থান পেয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো একজন মুসলিমের পক্ষে কি এ ধরণের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়া কিংবা অংশগ্রহণ করা শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ? এসব পূজাতে যে ‘প্রসাদ’ বিতরণ করা হয় তা কি খাওয়া বৈধ?


এই বিষয়ক যমুনা টিভির একটি নিউজ…

https://youtube.com/watch?v=mRo3beQWeX0


উপরের এ দু’টি প্রশ্নের উত্তরই হলো- না। এগুলো শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ (হালাল) নয় বরং নিষিদ্ধ (হারাম)। প্রথম বিষয়টি হারাম হওয়ার কারণ হলো, পূজাতে কিংবা হলি নামের অনুষ্ঠানে যেসব দেব-দেবীর উপাসানা করা হয় কিংবা যে স্মৃতির স্মরণ করা হয় সেগুলোর কোনো স্থান ইসলাম ধর্মে যেমন নেই তেমনি এসবের মধ্য দিয়ে দ্বিধাহীনভাবে আল্লাহর সাথে শরিক করা, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে উপাস্য মনে করা হয়। ইসলামী আকীদায় এটা একেবারেই হারাম কারণ তা ‘তাওহীদের’ (আল্লাহর একত্ববাদের) পরিপন্থী। ইসলামে ‘শিরক’ (আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে সমকক্ষ মনে করা) একটি বড় গুনাহ (কবীরাহ গুনাহ)।

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘… নিশ্চয় শিরক এক মহাঅন্যায়’(সূরা লুকমান: ১৩)। এ ধরণের গুনাহের কারণে জাহান্নাম অনিবার্য। এরকম একটি ‘কবীরাহ’ গুনাহে লিপ্ত কোন অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে, তাতে অংশগ্রহণ করে আনন্দ-উপভোগ করা কেনোভাবেই বৈধ নয়। এটাকে ‘শিরকে আকবার’ বা ‘বড় শিরক’ বলা হয়। এমন কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদেরকে অবশ্যই ‘তওবাহ’ করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। তা না হলে জাহান্নামের কঠিন আযাব তাদের জন্য চিরস্থায়ীভাবে অপেক্ষা করছে।

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সঙ্গে কউকে শরিক করাকে ক্ষমা করেন না। এ ছাড়া অন্যান্য অপরাধ ক্ষমা করেন। কিন্তু যে আল্লাহর শরিক করে, সে এক মহাপাপ করে’ (সূরা নিসা: ৪৮)।

উপোরোন্ত, এসব পূজা-পার্বনে তাদের দেবদেবীদের নামে উৎসর্গকৃত বিভিন্ন মিষ্টি-খাদ্য পূজায় কিংবা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে পূণ্য হাছিলের জন্য বিতরণ করা হয়। শরীয়তের দৃষ্টিতে কোন খাদ্যই আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গকৃত হলে তা খাওয়া হারাম বা নিষিদ্ধ। সুতরাং একজন মু’মিনের ও মুসলিমের পক্ষ্যে এহেন গর্হিত কাজ কীভাবে করা সম্ভব? কখনই সম্ভব নয়।


প্রত্যেক ধর্মই নির্ভর করে কিছু মৌলিক বিশ্বাসের উপর। এ বিশ্বাসগুলোই ব্যক্তিকে ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান পালনে উদ্বুদ্ধ করে। আর প্রত্যেক ধর্মেরই নিজস্ব স্বকীয়তার মাধম্যে বিশ্বাস ও কাজের মাঝে কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করে। এসবের মধ্য দিয়েই সেই ধর্ম যেমন পরিপূর্ণতা লাভ করে, তেমনি অনুসারীরা খুঁজে পায় প্রকৃত শান্তি।


আল্লাহ বলেন, ‘বলূন, নিশ্চয় আমার সালাত, আমার কুরবাণী, আমার জীবন ও আমার মৃত একমাত্র আল্লাহর জন্য। আমি এ ব্যাপারে আদিষ্ট হয়েছি যে, তাঁর কোন শরিক নেই। এবং আমি এও ঘোষণা দিচ্ছি যে, আমি আত্মসমার্পণকারীদের মধ্যে প্রথম’। (সূরা আল-আন’আম: ১৬২-১৬৩)

এখানে আরো একটি বিষয় হলো, ৯০ শতাংশ মুসলিম অধ্যুসিত এদেশে ‘শিরক’ সম্বলিত এসকল শ্লোগান কীভাবে ঢালাওভাবে প্রচার করা হচ্ছে? কে বা কারাই এসব শ্লোগানের ইন্দন যোগাচ্ছে? একজন মুসলিম হিসেবে এ বিষয়গুলো নিয়ে সর্বদা সতর্ক থাকা অত্যন্ত জরুরী। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে একথা প্রমাণিত হয় যে, যারা ধর্ম নিরোপেক্ষতার কথা বলে, যারা ইসলাম ধর্মেল মূল স্প্রিট (রুহানিয়্যাত) নষ্ট করতে চায়, যারা মুমিনের আকীদাহ নষ্ট করতে চায় কিংবা যারা মুসলিমের আমলগুলোকে শিকরকে সাথে মিশ্রণ ঘটিয়ে কুলষিত করতে চায় তারাই এ ধরণের শ্লোগানের ইন্ধন যোগাচ্ছে।

ধর্মীয় শান্তিপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করতে কোরআনের মূলনীতি হলো- ‘তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্য, আর আমাদের ধর্ম আমাদের জন্য’ (সূরা আল-কাফিরুন: ৬)। এখানে ধর্ম আলাদা হয়ে উৎসব এক হবার কিংবা তাতে অংশগ্রহণ করে, প্রসাদ খেয়ে আত্মতৃপ্তিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ হওয়ার কোনো সুযোগ ইসলাম ধর্মে নেই। বরং এক্ষেত্রে অন্যান্য ধর্মের লোকদেরকে ‘তাওহীদের’ (আল্লাহর একত্ববাদের) দিকে আহবান করতে বলা হয়েছে। (সূরা আলে ইমরান: ৬৪)

প্রত্যেক ধর্মই নির্ভর করে কিছু মৌলিক বিশ্বাসের উপর। এ বিশ্বাসগুলোই ব্যক্তিকে ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান পালনে উদ্বুদ্ধ করে। আর প্রত্যেক ধর্মেরই নিজস্ব স্বকীয়তার মাধম্যে বিশ্বাস ও কাজের মাঝে কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করে। এসবের মধ্য দিয়েই সেই ধর্ম যেমন পরিপূর্ণতা লাভ করে, তেমনি অনুসারীরা খুঁজে পায় প্রকৃত শান্তি। এসবে অন্য ধর্মের কেউ অংশগ্রহণ করলেও কোনো পূণ্য নেই, না করলেও কোন ক্ষতি নেই। আর ইসলাম এমন একটি ধর্ম যার মধ্যদিয়ে সকল আসমানী ধর্মের পূর্ণতা লাভ করেছে।

ইসলাম ধর্মের মূল আচার, নীতি, কার্যাবলী সব ‘তাওহীদ’ (আল্লাহর একত্ববাদ) নির্ভর। সুতরাং কোন বিশ্বাস ও কাজের মাধ্যমে যদি ‘তাওহীদ’ তথা আল্লাহর একত্ববাদের বিশ্বাসে ঘুণ ধরায় তাহলে তার সকল ‘আমলই নষ্ট হয়ে যাবে। যে কারণ, একজন মুমিন-মুসলিমের প্রাথমিক কাজ হলো ঈমানের এ বিষয়টিকে সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে যথাযথভাবে রক্ষা এবং সেভাবে নিজেকে পরিচালনা করা।

Comment

লেখক পরিচিতি

ড. মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ

ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়া থেকে উসূলুদ্দিন ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের উপর পি.এইচ-ডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বর্তমানে তিনি সহকারী অধ্যাপক (ইসলামি শিক্ষা) হিসাবে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত আছেন। তাঁর পিতা অধ্যক্ষ মাওলানা মোঃ আমিন উদ্দীন গাজী এবং মাতা মরহুমা সুফিয়া আমিন।
ড. ওবায়দুল্লাহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনার এবং কনফারেন্সে ২৫ টি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। ইতিমধ্যে তিনি তুরস্ক, নাইজেরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদিআরব, বাহরাইন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও ইন্ডিয়া ভ্রমন করেছেন। তাঁর একটি অনুবাদগ্রন্থ ইতিমধ্যেই পাঠক সমাজে সাড়া জাগিয়েছে এবং বেশ কয়েকটি মৌলিকগ্রন্থ প্রকাশের অপেক্ষায়। তাঁর লেখা ২৩ টি গবেষণা প্রবন্ধ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রিসার্স জার্ণালে প্রকাশিত হয়েছে। ইসলাম প্রতিদিনে লিখছেন অতিথি লেখক হিসেবে ।

কমেন্টস করুন