গবেষণা

শব্দে শব্দে দীন শেখা : আজান


পরিভাষায় ‘আজান’ হলো- নির্ধারিত শব্দমালা দ্বারা নির্দিষ্ট সময়ে নামাজের জন্য আহ্বান জানানো। (আল মুজামুল ওয়াসীত, লিসানুল আরব) আজানের নাম এ জন্য আজান রাখা হয়েছে, যেহেতু মুয়াজ্জিন‎ সাহেব মানুষদেরকে সালাতের সময় জানিয়ে দেন বা ঘোষণা প্রদান করেন।


মাওলানা মিরাজ রহমান : ‘আজান’ আরবী শব্দ। এর অর্থ হলো- ঘোষণা করা, জানানো, শোনানো, নিদের্শ, আহ্বান করা ইত্যাদি। আজানের আভিধানিক অর্থ কোন জিনিস সম্পর্কে ঘোষণা দেওয়া, আল্লাহ তাআলা বলেন, আর আল্লাহ ও তার রাসূলের পক্ষ থেকে আজান। (সূরা তাওবা: আয়াত ৩) অর্থাৎ ঘোষণা। অন্যত্র তিনি আরো বলেন, আর আমি যথাযথভাবে তোমাদেরকে আজান দিয়ে দিয়েছি। (সূরা আম্বিয়া: আয়াত ১০৯) অর্থাৎ জানিয়ে দিয়েছি ফলে জ্ঞানের দিক দিয়ে আমরা সকলে সমান। [আন-নিহায়া  ফি গারিবিল হাদিস: (১/৩৪), মুগনি লি ইব্‌ন কুদামা: (২/৫৩)]

পরিভাষায় ‘আজান’ হলো- নির্ধারিত শব্দমালা দ্বারা নির্দিষ্ট সময়ে নামাজের জন্য আহ্বান জানানো। (আল মুজামুল ওয়াসীত, লিসানুল আরব) আজানের নাম এ জন্য আজান রাখা হয়েছে, যেহেতু মুয়াজ্জিন‎ সাহেব মানুষদেরকে সালাতের সময় জানিয়ে দেন বা ঘোষণা প্রদান করেন। আজানের আরেক নাম হচ্ছে ‘নিদা’ অর্থাৎ আহ্বান, কারণ মুয়াজ্জিন‎ সাহেব লোকদেরকে ডাকেন ও তাদেরকে সালাতের দিকে আহ্বান করেন।

আজানের ফজিলত : কোরআন হাদিসে আজানের অনেক ফজিলতের কথা উল্লেখিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, আর তার চেয়ে কার কথা উত্তম, যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলে, অবশ্যই আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত। (সূরা ফুসসিলাত : আয়াত ৩৩)

মানুষ যদি আজানের ফজিলত জানত, তাহলে তারা এর জন্য লটারি করত। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মানুষেরা যদি আজান ও প্রথম কাতারের নামাজ আদায় করার ফজিলত জানত, অতঃপর তারা লটারি ব্যতীত তার সুযোগ না পেত, তাহলে অবশ্যই তারা লটারিতে অংশ গ্রহণ করত। যদি তারা সালাতে দ্রুত যাওয়ার ফজিলত জানত, তাহলে তারা সে জন্যও প্রতিযোগিতা করত, যদি তারা এশা ও ফজর সালাতের ফজিলত জানত, তাহলে তারা হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তাতে অংশ গ্রহণ করত”। [বুখারি: (৬১৫), মুসলিম: (৪৩৭)]

আজানের হুকুম-আহকাম-বিধি-বিধান : জামাআতে নামাজ পড়ার জন্য আজান ও ইকামাত দেওয়া সুন্নাত। আজান দিতে অজু শর্ত না হলেও, অজু থাকা বাঞ্ছনীয়। সময়ের আগে আজান দিলে পুনরায় আজান দিতে হয়। উচ্চস্বরে নারীর আজান ও ইকামাত দেওয়া বৈধ নয়; নাবালেগ ও বিকৃত মস্তিষ্ক ব্যক্তি আজান ইকামাত দিলে তা পুনরায় সাবালক ও সুস্থ মস্তিষ্ক লোক দ্বারা দিতে হবে। ঝড় তুফাতের সময়, ভূমিকম্পের সময় আজান দেওয়া সুন্নাত। নবজাতককে আজান ও ইকামাত শুনানো সুন্নাত। নবাতকের আজান নারী-পুরুষ, সাবালক নাবালক নির্বিশেষে সবাই দিতে পারে। এটি উচ্চস্বরে দিতে হয় না। সাধারণত নিম্ন আওয়াজে ডান কানে আজান ও বাম কানে ইকামাত শুনাতে হয়। এই আজান ও ইকামাত নবজাতকের পাশে বসে বা কোলে নিয়ে বসে দেওয়া যায়; কারণ এতে দাড়াতে হয় না এবং কানে আঙ্গুলও দিতে হয় না।

আজানের সূচনা ইতিহাস : একটি হাদিসে এসেছে, মুসলমানগণ যখন মদীনায় আগমন করে জড়ো হতেন, সালাতের সময়ের প্রতীক্ষা করতেন। তখন সালাতের জন্য ডাকাডাকি হতো না। একদিন তারা এ নিয়ে আলোচনা করলেন। কেউ বলল, তোমরা নাসারাদের মতো ঘণ্টার অনুসরণ কর। কেউ বলল না, বরং হর্ন গ্রহণ করো, ইহুদিদের শিঙ্গার মতো। হজরত ওমর রাদিআলাহু আনহু বললেন, একজন লোক পাঠান, সে সালাত সালাত বলে ঘোষণা দেবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : হে বেলাল, তুমি দাঁড়াও, অতঃপর সালাতের ঘোষণা দাও। [বোখারি : (৫৭৯), মুসলিম : (৩৭৭)]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক মহান চিন্তায় ছিলেন, মানুষদের কিভাবে সালাতের জন্য উপস্থিত করা হবে? অবশেষে আল্লাহর বিধান চলে আসে। আবু উমাইর বিন আনাস তার কোন আনসারী চাচা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালাতের জন্য মানুষকে ডাকার বিষয় নিয়ে খুব চিন্তি ছিলেন। তাকে বলা হলো, যখন নামাজের সময় হবে একটি পতাকা উত্তোলন করবেন, এ পতাকা দেখে একে অপরকে আহবান করবে। এ উত্তরে তিনি সন্তুষ্ট হলেন না। অতঃপর তার কাছে হর্ন বাজানোর কথা বলা হলো। জিয়াদ বললেন, ইহুদিদের হর্ন। এ উত্তরেও তিনি সন্তুষ্ট হলেন না এবং বললেন, এটা ইহুদিদের কর্ম । অতঃপর তাকে ঘণ্টার কথা বলা হলো। তিনি বললেন, এটা নাসারাদের কর্ম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ চিন্তায় গভীরভাবে চিন্তিত হয়ে আব্দুল্লাহ বিন জায়েদ বিন আবদে রাব্বিহি বাড়ি ফিরলেন, তাকে স্বপ্নে আজান দেখানো হলো। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গমন করলেন এবং তাকে আজান বিষয়ে স্বপ্ন সম্পর্কে সংবাদ দিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, অর্ধ ঘুম ও নিদ্রাবস্থায় ছিলাম, আমার কাছে এক আগমনকারী আসল অতঃপর আমাকে আজান দেখালো। তিনি বলেন : ওমরও তার পূর্বে এ স্বপ্ন দেখেছে, তিনি তা বিশ দিন গোপন রাখেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানান। তিনি বললেন, তুমি আমাকে কেন সংবাদ দাওনি? তিনি বললেন, আব্দুল্লাহ বিন জায়েদ আমার আগে বলে ফেলেছে, তাই আমার বলতে লজ্জা বোধ হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে বেলাল, দাঁড়াও, দেখ আব্দুল্লাহ বিন জায়েদ কি বলে, তুমি তার অনুসরণ কর। তিনি বললেন, অতঃপর বেলাল আজান দিল। আবু বিশর বলেন, আবু উমাইর আমাকে বলেছে, আনসারগণের ধারণা, সেদিন যদি আব্দুলাহ বিন জায়েদ অসুস্থ না হতেন, তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম তাকেই মুয়াজ্জিনন বানাতেন। [আবু দাউদ : (৪৯৮), সহীহ আবু দাউদ লিল আলবানী: (৪৬৮)]

আজানের কিছু শর্ত ও আদব : ধারাবাহিকভাবে আজান দেওয়া। আজানের শব্দগুলো পরপর বলা। সালাতের সময় হলে আজান দেওয়া। আজানে এমন সূর গ্রহণ করা যাবে না, যা শব্দ ও অর্থ বিকৃতি করে দেয় এবং যা আরবি ব্যাকরণের বিপরীত। উচ্চ স্বরে আজান দেয়া। সুন্নত অনুযায়ী নির্দিষ্ট সংখ্যা মোতাবেক আজান দিবে, তাতে কম বা বেশী করবে না। এক ব্যক্তির আজান দিতে হবে, দুই জনের আজান শুদ্ধ নয়। যদি এক ব্যক্তি আজান আরম্ভ করে, অতঃপর অপর ব্যক্তি তা পুরো করে, তাহলে আজান শুদ্ধ হবে না। মুয়াজ্জিন পবিত্র অবস্থায় আজান দেবে, আজানের শব্দ ধীরে ধীরে বলবে, ইকামত দ্রুত বলবে, সব বাক্যের শেষে জযম বলবে, উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে কিবলা মুখী হয়ে আজান দেবে। মুয়াজ্জিন তার দুই কানে হাতের আঙুল রাখবে। হাইয়া আলাস সালাহ বলার সময় ডানে এবং হাইয়া আলাস ফালাহ বলার সময় বামে চেহারা ঘুরাবে। [আহমদ: (৪/৩০৮), তিরমিযি: (১৯৭), ইব্‌ন মাজাহ: (৭১১)]

উত্তম হচ্ছে সালাতের প্রথম ওয়াক্তে আজান দেয়া। মুয়াজ্জিনের উঁচু আওয়াজ সম্পন্ন হওয়া সুন্নত। মুয়াজ্জিনের আওয়াজ সুন্দর হওয়া মুস্তাহাব। মুয়াজ্জিনের আজানের সময় সম্পর্কে অবগত থাকা উত্তম, যেন ওয়াক্তের শুরুতে আজান দিতে সক্ষম হয়। [দেখুন: সুবুলুস সালাম লি সানআনি: (২/৭০)]

Comment

লেখক পরিচিতি

আবদুল্লাহ মারুফ

আমি আবদুল্লাহ মারুফ। বর্তমানে অধ্যয়নরত আছি আল বায়ান অ্যারাবিক লানিং সেন্টারে। পাশাপাশি নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি হেরার জ্যোতি ও মাসিক ঘাসফড়িঙ -এর। পড়াশুনা, লেখালেখি আর ঘুরে বেড়ানো এই আমার ছোট্ট জীবন। ইসলাম প্রতিদিনের সাথে আছি কন্ট্রিবিউটিং রাইটার হিসেবে।

কমেন্টস করুন