জীবন বিধান বিধান হালাল-হারাম

টাখনুর নিচে পোশাক পরিধান নিষিদ্ধ কেন?

পুরুষের পোশাক যখন টাখনু বা পায়ের গোড়ালির হাড় অতিক্রম করে, ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় এটাকে ‘ইসবাল’ বলা হয়। পুরুষের পোশাকের দৈর্ঘ্যের ব্যাপারে এটা তো স্বতঃসিদ্ধ বিষয় যে গোড়ালির ওপরের হাড়ের নিচে কোনো পোশাক পরিধান করা যাবে না। প্রশ্ন হলো, গোড়ালির কতটুকু ওপরে পোশাক পরিধান করতে হবে? এখানে তিনটি বিধান রয়েছে। এক. গোড়ালির হাড়ের নিচে পোশাক পরিধান করা মাকরুহে তাহরিমি। দুই. গোড়ালির হাড়ের ওপরে (হাঁটুর নিচে) যেকোনো স্থানে পোশাক পরিধান করা বৈধ হলেও নিসফ সাক তথা পায়ের গোছার মধ্যভাগের ওপরে পরিধান করা উত্তম নয়। তিন. নিসফে সাক বা পায়ের গোছার মধ্যভাগ পর্যন্ত পোশাক পরিধান করা মুস্তাহাব। (বজলুল মাজহুদ : ১৬/৪১১; আওজজুুল মাসালিক : ১৬/১৯১)

টাখনুর নিচে পোশাক পরিধানের পরকালীন শাস্তি : টাখনুর নিচে পোশাক পরিধানকারীর দিকে মহান আল্লাহ দৃষ্টিপাত করবেন না। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি অহংকারবশত নিজের পোশাক (টাখনুর নিচে) ঝুলিয়ে রাখে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দিকে (রহমতের দৃষ্টিতে) তাকাবেন না।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৭৮৮)

টাখনুর নিচে পোশাক পরিধানকারী পরকালে বেদনাদায়ক শাস্তির সম্মুখীন হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তিন ধরনের লোক এমন আছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না। তাদের দিকে তাকাবেন না। গোনাহ থেকে পবিত্র করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। বর্ণনাকারী জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল! সেসব লোক কারা, তারা তো চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অপদস্থ হয়েছে। মহানবী (সা.) আগের কথাগুলো তিনবার পুনরাবৃত্তি করেন। বর্ণনাকারী আবার একই প্রশ্ন করার পর মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ওই তিন ব্যক্তি হলো—এক. টাখনুর নিচে পোশাক পরিধানকারী। দুই. উপকার করে খোঁটা দানকারী। তিন. ওই ব্যবসায়ী, যে মিথ্যা শপথ করে নিজ পণ্য বিক্রয় করে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪০৮৭)

টাখনুর নিচে পোশাক পরিধান বিষয়ে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও বিশুদ্ধ হাদিস হলো, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘পোশাকের যে অংশ টাখনুর নিচে থাকবে, পায়ের ততটুকু অংশ জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৭৮৭)

টাখনুর নিচে পোশাক পরিধানের ইহকালীন ক্ষতি : মুমিন-মুত্তাকিদের আল্লাহ ভালোবাসেন, এ কথা কোরআন ও হাদিসের অসংখ্য স্থানে বিবৃত হয়েছে; কিন্তু টাখনুর নিচে পোশাক পরিধানকারী ঈমানদার হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত থাকে। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তুমি তোমার পোশাক টাখনুর ওপরে উঠিয়ে নাও। কেননা আল্লাহ টাখনুর নিচে পোশাক পরিধানকারীদের পছন্দ করেন না।’ (শুআবুল ঈমান : ৫৭২০)

টাখনুর নিচে পোশাক পরিধান করলে নামাজ কবুল হয় না। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ টাখনুর নিচে পোশাক পরিধানকারীর নামাজ কবুল করেন না।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪০৮৬)

এ হাদিস থেকে জানা যায়, টাখনুর নিচে পোশাক পরিধান এমন পাপ, যার ফলে সে তার পুণ্যের কাজ যেমন—নামাজ থেকেও সওয়াব পাওয়ার আশা করতে পারে না। শবেবরাতেও টাখনুর নিচে পোশাক পরিধানকারী আল্লাহর অবারিত ক্ষমা থেকে বঞ্চিত থাকে। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘এক রাতে জিবরাইল (আ.) আমার কাছে এসে বলেন, ‘এটি মধ্য শাবানের রাত বা শবেবরাত। এই রাতে আল্লাহ বনু কালব গোত্রের বকরির পশমের চেয়েও বেশিসংখ্যক মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুিক্ত দেন; কিন্তু এই রাতেও তিনি কয়েক ধরনের লোকদের ক্ষমা করেন না। তাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকান না। তারা হলো—মুশরিক, দুমুখী, আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্নকারী, টাখনুর নিচে পোশাক পরিধানকারী, পিতা-মাতার অবাধ্য ও মদ্যপ।’ (শুআবুল ঈমান : ৩৬২/৫)

ওপরের আলোচনা থেকে বিষয়টি পরিষ্কার যে টাখনুর নিচে পোশাক পরিধান করা গর্হিত অপরাধ। আর এটাও স্পষ্ট যে আল্লাহর অগণিত নিয়ামত ভোগ করে অব্যাহত অপরাধ করে কোনো ব্যক্তি নিরাপদ থাকতে পারে না। যেকোনো সময়ই এমন অপরাধী আসমানি আজাবের সম্মুখীন হতে পারে। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘এক ব্যক্তি টাখনুর নিচে পোশাক পরিধান করে চলতে ছিল, হঠাৎ সে মাটির নিচে দেবে যায়। কিয়ামত পর্যন্ত সে মাটির নিচে দাবতেই থাকবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৭৮৮) টাখনুর নিচে পোশাক পরিধান করলে পোশাকে ময়লা লাগতে পারে। অনেক সময় এর মাধ্যমে  পোশাকে নাপাকি লেগে যায়।

টাখনুর ওপরে পোশাক পরিধানের উপকারিতা : আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্যের পাশাপাশি টাখনুর ওপরে পোশাক পরিধানে বহুবিধ উপকারিতা রয়েছে। প্রথমত, এটি ব্যক্তির বিনয় ও ধর্মপ্রবণতা প্রকাশ করে।

দ্বিতীয়ত, এটি আদর্শ ব্যক্তিত্বের পরিচয় বহন করে। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘সামুরা কত ভালো মানুষ, যদি সে নিজের চুল কেটে নিত এবং পোশাক টাখনুর ওপরে রাখত! এটা শুনে হজরত সামুরা (রা.) ত্বরিত এর ওপর আমল করেন। তিনি নিজের চুল ছোট করেন এবং পোশাক টাখনুর ওপরে তুলে নেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৭৭৮৮) এ হাদিস থেকে জানা যায়, চুল ছোট রাখা, টাখনুর নিচে পোশাক পরিধান করা আদর্শ ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। তৃতীয়ত, টাখনুর ওপরে পোশাক পরিধান করার কারণে কাপড় টেকসই (লং লাস্টিং) হয়। চতুর্থত, টাখনুর ওপরে পোশাক পরিধান করলে পোশাক পরিচ্ছন্ন থাকে। অপবিত্রতা থেকে বাঁচা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, উবায়দা বিন খালফ (রা.)-কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তুমি যদি তোমার কাপড় উঠিয়ে নিতে, তাহলে তা অধিক স্থিতিশীল ও পরিচ্ছন্ন থাকত।’ (মুসনাদে আহমদ : ২৩০৮৭) পঞ্চমত, টাখনুর ওপরে পোশাক পরিধান করা তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জনের মাধ্যম। হাদিসে এসেছে, ‘তোমার পোশাক ওপরে তুলে নাও এবং তাকওয়া অর্জন করো।’ (তাবরানি কাবির, হাদিস : ৭২৪১)

সর্বোপরি সব যুগের সব দেশের নেককার, পরহেজগার ও খোদাভীরু বান্দারা টাখনুর ওপরে পোশাক পরিধান করেন। তাই পরিপূর্ণ ঈমানদার কিছুতেই টাখনুর নিচে পোশাক পরিধান করতে পারে না। অনেকেই এ ক্ষেত্রে পরিবেশগত কারণকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করান। স্মরণ রাখতে হবে, পরিবেশ এমনিতেই গড়ে ওঠে না, পরিবেশকে গড়ে তুলতে হয়। ঈমানের চেতনা ও অদম্য প্রেরণা যদি থাকে, তাহলে আমল করার জন্য পরিবেশ বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।

সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ

Comment

লেখক পরিচিতি

মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ

মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ। আলেম, গবেষক ও লেখক। বর্তমানে তিনি মাদরাসাতুল মদিনা, নবাবপুর, ঢাকায় শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

কমেন্টস করুন