আমরা অনেকেই হয়তো জানি না, পবিত্র কুরআনে ব্ল্যাকহোলের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। ব্যাপারটি জেনে অনেক বিজ্ঞানী-ই অবাক হয়েছিলেন। আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে কীভাবে ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে এতো তথ্য কুরআনে এসেছে- সেটা জানার পর বিজ্ঞানীরা দারুণভাবে চমকে গিয়েছিলেন।
ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে নিখুঁত তথ্যগুলো আল-কুরআনে কিভাবে এলো? তা সত্যিই বিস্ময়কর! মহাজগতের অসীম বিস্তৃতিতে আবিষ্কৃত এক বিষ্ময়কর নাম ব্ল্যাকহোল। বাংলায় বলা হয় ‘কৃষ্ঞগহ্বর’। যে নামেই ডাকা হোক না কেন- বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের মধ্য দিয়েই এটির আসল পরিচয় ফুটে ওঠে। আল-কুরআনে সরাসরি এটির নাম উল্লেখ করা হয়নি বটে। কিন্তু স্বয়ং স্রষ্টা মহান আল্লাহ ই তাঁর কিতাবে এমন একটি বিশেষ সৃষ্টি সম্পর্কে শপৎ করেছেন এবং এমন কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা ব্যক্ত করেছেন যার সাথে ব্ল্যাকহোল এর বৈশিষ্ট্যের মিল দেখলে সত্যিই বিস্মিত হতে হয়। সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ‘হাবল টেলিস্কোপ’- এর সহায়তায় মহাকাশের যে সমস্ত চমকপ্রদ তথ্য উদঘাটিত হচ্ছে সেগুলোর সাথে প্রায় ১৪৫০ বছর পূর্বে নাযিলকৃত আল-কোরআনে প্রদত্ত বিজ্ঞান বিষয়ক ঐশী তথ্যগুলোর যে অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায় তা প্রতিটি চিন্তাশীল মানুষকে ভাবিু ও অভিভূত না করে পারে না। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ প্রদত্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য ও ইংগিতের সাথে এগুলোর সমন্বয় সৃষ্টির সাথে সাথে আমার নিজস্ব কিছু বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা-ভাবনার বহিঃপ্রকাশই এই আলোচনার মূল বিষয়বস্তু। প্রকৃত খবর মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহ-ই ভাল জানেন।
একসময় এই ব্ল্যাকহোকে অদৃশ্য মনে করা হতো। কিন্তু ইভেন্ট হোরাইজন টেলিস্কোপ (ইএইচটি) এর কল্যাণে এটি আজ সহজ হয়ে গেছে। এটির মাধ্যমে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা চাইলেই এখন ব্ল্যাকহোল দেখতে পারেন। ব্ল্যাকহোলের অবস্থান আসলে কোথায়? নাসা কর্তৃক প্রকাশিত ছবি অনুসারে, গ্যালাক্সি এম৮৭ এর ঠিক কেন্দ্রে ব্ল্যাকহোলের অবস্থান। সম্প্রতি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাকহোলের সেই বহুল প্রতিক্ষিত ছবিটি খুঁজে পেতে সক্ষম হন। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, ব্ল্যাকহোলের তলদেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। আর সেটির চারপাশে রয়েছে গ্যাস এবং প্লাজমার জ্যোতিশ্চক্র।
ব্ল্যাকহোল কী? ন্যাশনাল অ্যারোনটিকস স্পেস এডমিনিস্ট্রেশন (নাসা) এর মতে, ব্ল্যাকহোল হলো মহাশূন্যের এমন একটি জায়গা যেখানে মধ্যাকর্ষণশক্তি এতটা প্রবল থাকে যে, আলোও সেটিকে এড়াতে সক্ষম হয় না। সমস্তকিছু এটিতে ধরা পড়ে।
কীভাবে ব্ল্যাকহোলের ছবি তোলা হয়েছিল? ব্ল্যাকহোলের ছবি তোলার জন্য ইএইচটি বিশ্বব্যাপী অনেকগুলো টেলিস্কোপ স্থাপন করেছিলো। এটি স্থাপনের মাধ্যমে তারা মূলত হাই রেজুলেশনের একটি ভার্টিকেল টেলিস্কোপ তৈরি করার চেষ্টা করেছিল। ব্ল্যাকহোলের আকৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে ইএইচটির প্রফেসর হেনো ফ্ল্যাক সংবাদ সম্মিলনে বলেন, ব্ল্যাকহোল দেখতে অনেকটা গোয়িং গ্যাসের ডিস্কের মত।
কেবলমাত্র কেটি বৌম্যানই ব্ল্যাকহোলের ছবিকে বাস্তব বানাতে পেরেছিলেন। বৌম্যান এমআইটিতে পড়াশোনা করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় ২০০ বিজ্ঞানী নিয়ে ড. কেটি অ্যালগরিদমের একটি সিরিজ ডেভেলপ করেছিলেন, যে অ্যালগরিদম সমস্ত ডাটা একত্র করে একটি ছবি নির্মাণ করেছিলো। ছবিটি বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়।
পবিত্র কুরআনে ব্ল্যাকহোল প্রসঙ্গ ? ব্ল্যাকহোলের এ বিষয়গুলো ১৪০০ বছর আগে কুরআনে উল্লিখিত হয়েছে। ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে কুরআনে যতটুকু বর্ণনা পাওয়া যায় তার সবই হজরত মুহাম্মদ (সা.) -এর মিরাজ সংক্রান্ত আয়াতে বর্ণিত। সুরা নাজমের ১২ থেকে ১৮ আয়াত পর্যন্ত এ সম্পর্কে বর্ণনা পাওয়া যায়। আমরা বিজ্ঞানের সহায়তায় জানতে পেরেছি যে, কোন তারকা কৃষ্ণগহ্বরের খুব কাছাকাছি এলে তার নিকটতর ও দূরতর অংশে মহাকর্ষীয় আকর্ষণের পার্থক্যের জন্য তারকাটি ছিন্ন হয়ে যায়। এর অবশিষ্টাংশ এবং অন্যান্য তারকা থেকে যে সমস্ত বায়বীয় পদার্থ নির্গত হয় সবই গিয়ে পড়ে ঐ কৃষ্ণগহ্বরে। সুতরাং আল কোরআনের সুরা ওয়াকিয়াহর এর ৭৫ নং আয়াতে নক্ষত্রসমূহের পতিত হওয়ার স্থান বলতে যে ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরকেই বোঝানো হয়েছে তা সহজেই বুঝে নেয়া যায়। তাছাড়া, কুরআনের ৫৬:৭৬ নং আয়াতে যেহেতু কৃষ্ণগহ্বরের বৈশিষ্ট্যধারী স্থান অর্থাৎ নক্ষত্রসমূহের পতিত হওয়ার স্থানকে নিয়ে মহাকাশপথ করা হয়েছে সেহেতু বুঝা যায়, ‘আদিম কৃষ্ণগহবরগুলো’ আল্লাহ তায়ালার আদেশে অনেক আগেই সৃষ্টি হয়ে গেছে।
কুরআনের ৮১:১৫ নং আয়াতে প্রদত্ত বক্তব্যে যে খান্নাছুন শব্দটি উল্লেখ রয়েছে তা দ্বারা যেসব তারকা গোপন হয়ে যায় সেগুলো বুঝানো হয়েছে। এটি দ্বারা সম্ভবু দুটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে: প্রথমত কোন নক্ষত্র যখন কৃষ্ণগহ্বরে রূপান্তরিত হয় তখন তা থেকে বিপরীত কনিকা উৎসর্জনের ফলে এর ভর হ্রাস পায় এবং অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে ক্ষুদ্রতর অবস্থায় বিরাজ করে অর্থাৎ আমাদের দৃষ্টির আড়ালে চলে যায় বা গোপন হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত কোন নক্ষত্র কৃষ্ণগহ্বরের আওতায় এলে তা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় এবং এর সমূদয় পদার্থ সহ নক্ষত্রটি কৃষ্ণগহ্বরে পতিত হয়। ফলে এটিও দৃষ্টির আড়ালে চলে যায় অর্থাৎ গোপন হয়ে যায়। আল কুরআনের ৮১:১৬ নং আয়াতে সম্ভবত এই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, যেহেতু কৃষ্ণগহ্বর থেকে কণিকা নির্গমনের ফলে অবশেষে এর ভর শুন্য হয়ে যায় অর্থাৎ এটি সম্পূণরূপে মিলিয়ে যায় বা এর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়, সুতরাং যে নক্ষত্রটি (সূর্যের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি ভরসম্পন্ন) কৃষ্ণগহবরে রূপান্তরিত হয় এবং যে নক্ষত্রটি কৃষ্ণগহবরে পতিত হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, এরা উভয়েই অবশেষে অদৃশ্য শক্তিরূপে এই মহাবিশ্বের কোন অজ্ঞাত অঞ্চলে প্রত্যাগম করে।
এছাড়া, আল কুরআনের ৫৬:৭৫ নং আয়াতে নক্ষত্রসমূহের পতিত হওয়ার স্থান হিসেবে যে স্থানের ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল, ৭৯:১ ও ৭৯:২ নং আয়াতে এসে সেই স্থানের প্রকৃতি অর্থাৎ তা চেনার উপায় সম্পর্কে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এই আয়াত দুটিতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর এমন ধরনের বিশেষ সৃষ্টিকে নিয়ে শপথ করেছেন যার সাথে ব্ল্যাকহোলগুলোর প্রচন্ড শক্তি ও ধ্বংসাত্মক প্রকৃতির মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বিজ্ঞানের বর্ণনায় আমরা দেখেছি যে, ব্ল্যাকহোলগুলোই বিশালকায় কোন নক্ষত্র সহ গ্রহ, উপগ্রহ ইত্যাদি সব কিছুকে তাদের আওতায় পেলে প্রচন্ড আকর্ষণে টেনে নিয়ে গতানুগতিক কক্ষপথের বাঁধন থেকে মুক্ত করে দেয় অর্থাৎ নির্দিষ্ট কক্ষপথ থেকে পদচ্যুত বা উৎপাটন করে নির্মমভাবে নামিয়ে আনে। এর ফলে অবশেষে সেগুলো সূরা ওয়াকিয়ার (৫৬:৭৫) নং আয়াতে বর্ণিত নক্ষত্রসমূহের পতিত হওয়ার স্থানে পতিত হয়। বিজ্ঞানীরা যে স্থানের নাম দিয়েছেন ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর।
বিবিসি সাংবাদিক ক্ল্যার ফরেস্টার এটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কিভাবে কুরআনে ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে বলা হয়েছ এবং কিভাবে এটি মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মিরাজের সাথে সম্পৃক্ত। তিনি বলেন, ‘মহাশূন্য অন্ধকারে ঘেরা। আর এ ব্ল্যাকহোলগুলো আরও গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন। যেটা প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষ তাদের সাধারণ চোখ দিয়ে দেখতে পারে না। ভিডিওটিতে ফরেস্টার আরও বলেন, ‘শুধু মুহাম্মদই (সা.) তাঁর মিরাজের সময় ব্ল্যাকহোল প্রতীকগুলো দেখতে পেরেছিলেন।’
কুরআন ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে বলেছে, এটা বদরিকা গাছ (Lote tree)। অর্থাৎ, কুরআন ব্ল্যাকহোলকে বদরিকা গাছের সাথে তুলনা করেছে। আর আমরা যদি একটি বদরিকা গাছের আকৃতি চিন্তা করি তাহলে এটা ২০১৯ সালে বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত ব্ল্যাকহোলের মতই দেখতে হয়ে থাকে।
সবশেষে বলা যায়, পবিত্র কোরআনে এমন কোন বৈজ্ঞানিক তথ্য নেই যা ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে কিছুদিন পূর্বেও মানুষ যে সমস্ত তথ্য সম্পর্কে বিভ্রান্তিতে ছিল, জ্ঞান সাধনার ফলে তার অনেকটাই আজ সত্যের আলোয় উদ্ভাসিু হয়েছে। এভাবে আল্লাহ তায়ালা বার বার প্রমাণ করে দেখান যে, আল কোরআনে প্রদত্ত বৈজ্ঞানিক ঐশী তথ্যগুলো যেমন সত্য ঐশী আইন-কানুনগুলোও তেমনই অকাট্য ও সত্য এবং সর্বকালেই কল্যাণকর। মহান স্রষ্টা চান, বিশ্বাসী মানুষেরা যেন এইসব ঐশী তথ্য সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণাব মধ্য দিয়ে আধুনিক আবিষ্কারগুলোকে যাঁচাই করে নিয়ে প্রকৃত সত্যের সন্ধান লাভ করতে পারে এবং আল্লহর মহত্ব ও করুণার কথা স্মরণ করার সাথে সাথে একমাত্র তাঁরই কাছে মাথা নত করে
সূত্র : দ্য ইসলামিক ইনফরমেশন