হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে যাবতীয় সিদ্ধান্তেরর চূড়ান্ত ফয়সালা করেন। আর শবেকদরে তা নির্দিষ্ট দায়িত্বশীলদের অর্পণ করেন। (তাফসিরে কুরতুবি ১২৬)।
বৃহস্পতিবার ৯ এপ্রিল দিবাগত রাতে বাংলাদেশে পবিত্র শবে বরাত পালিত হবে। তবে এবছর শবে বরাতটি কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই পালিত হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের বিস্তৃতি রোধকল্পে সংকটকালীন পরিস্থিতিতে দেশের নাগরিকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার স্বার্থে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ঘোষিত নির্দেশনা মান্য করে শবে বরাতে নিজ নিজ বাসস্থানে বসেই পবিত্র শবে বরাতের ইবাদত যথাযথ মর্যাদায় আদায় করার জন্য গত ৪ এপ্রিল আহ্বান জানিয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
শবেবরাত মহিমান্বিত একটি রজনী। শবে বরাতের ফজিলতকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলা ঠিক নয়। শবে বরাত নিয়েও আমাদের সমাজ বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়িতে লিপ্ত। সমাজের এক শ্রেণির মানুষ পূণ্যময় রজনীকে এমনভাবে উদযাপন করেন, যা সম্পূর্ণ ইসলাম বহির্ভূত। তারা এই পবিত্র রাতে এমনসব কাজ-কর্ম করে যা সুস্পষ্ট বিদআত ও নাজায়েজ। অপর একটি শ্রেণির মানুষ এ রাতের ফজিলতকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন প্রচার করে নিজেরা যেমন নফল ইবাদত থেকে দুরে থাকেন, অপরকেও ইবাদতের প্রতি দুরে রাখার চেষ্টায় থাকেন। শবে বরাত নিয়ে যেমন বাড়াবাড়ি ঠিক নয়, তেমনি ছাড়াছাড়িও সমীচীন নয়। সমাজের কিছু সংখ্যক আলেমও দাবি করেন যে, শবেবরাতের কোনো ফজিলত প্রমাণিত নয়। কিন্তু একথ মারাত্মক ভুল। কারণ ১০ জন সাহাবি থেকে শবেবরাতের ফজিলত সম্পর্কিত হাদিসগুলো বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং শবে বরাতের ফজিলত ও রাতের ইবাদতকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন তথা বিদয়াত বলা কোনোক্রমেই সঙ্গত নয়। বরং বাস্তবতার আলোকে স্বীকার করতেই হবে, শবে বরাত একটি মহিমান্বিত রাত।
শবেবরাত শব্দটি ফারসি। শব অর্থ রাত, বরাত অর্থ মুক্তি; শবেবরাত অর্থ মুক্তির রজনী। এর আরবি হলো ‘লাইলাতুল বরাত’। হাদিসে শবেবরাতকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্যরাত বলা হয়েছে। আমাদের দেশে এ রাতটি শবেবরাত নামে অধিক পরিচিত। শবেবরাত একটি পুণ্যময় রজনী। ইবাদতে প্রশান্ত হওয়ার রাত। ভেজা চোখে মোনাজাতে কাটানোর রাত। জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার রাত। চাওয়া-পাওয়ার রাত।
মহিমান্বিত এ রাত অশেষ ফজিলতের। হজরত রাসূল (সা.) এরশাদ করেন শবেবরাত হলো-‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’। অর্থাৎ শাবান মাসের ১৫তম রজনী। বিখ্যাত সাহাবি হজরত মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) সূত্রে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, অর্ধ শাবানের রাতে অর্থাৎ শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে মহান আল্লাহ তায়ালা সমগ্র সৃষ্টিকুলের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও হিংসুক-বিদ্বেষী লোক ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৩৯০, সহিহ ইবনে হিব্বান : ৫৬৬৫)।
হজরত আসিম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবি বকর তার পিতার সনদে দাদা হজরত আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা শাবানের ১৫তম রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং সব পাপীকে (যারা ক্ষমা প্রাার্থনা করে) ক্ষমা করে দেন। তবে মুশরিক (আল্লাহর সঙ্গে সমকক্ষ সাব্যস্তকারী) ও মুশহিন (হিংসুক) ছাড়া। (বায়হাকি : ৩৮৩৫)।
হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.), আবু সালাম আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা), আবু মুসা আশআরী (রা.), আবু হুরায়রা (রা.), আবু বকর (রা.), আউফ ইবনে মালিক (রা.) ও হজরত আয়েশা (রা.) সবাই এ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। হাদিস বিশারদরা উক্ত হাদিসের রাবিদেরকে ছেক্বাহ তথা বিশ্বস্ত বলেছেন। মূল কথা হাদিসটি ‘সহিহ’। (আত তারগিব ওয়াত তারহিব : ২ খণ্ড,পৃষ্ঠা : ১১৮)।
এ রাতে করণীয় সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে, হজরত আলী বিন আবু তালীব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন-অর্ধ শাবানের রাত যখন হয়, তোমরা রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে পালন করো এবং দিনের বেলা রোজা রাখো। কেননা, এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে এসে বলেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছো কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোনো রিজিক অন্বেষণকারী আছো কি? আমি তাকে রিজিক প্রদান করবো। আছো কি কোনো রোগাক্রান্ত? আমি তাকে আরোগ্য দান করবো। এভাবে সুবহে সাদেক পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে তাদের ডাকতে থাকেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৩৮৮)।
হজরত আলা ইবনুল হারিস (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (স.) রাতে নামাজে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হল তিনি হয়ত মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না-ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার এই আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা। তখন নবী (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসূলই ভালো জানেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তখন এরশাদ করলেন, ‘এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত (শবে বরাত)। আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তার বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রাার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই। (বায়হাকি : ৩৮২, তাবরানি : ১৯৪)।
শবে বরাতের আলাদা কোনো নামাজ নেই। নির্দিষ্ট সূরা দিয়ে নির্দিষ্ট রাকাত নামাজ পড়ার রীতি ভুল প্রচলন। এটা থেকে বেঁচে থাকা দরকার। পারলে সারা রাত ইবাদত-বন্দেগি করা। সেটা হতে পারে কোরআন তেলাওয়াত, জিকির, নফল নামাজ, দোয়া-দরুদ, তওবা-ইস্তেগফার, দান-সদকা, উমরি ক্বাজা নামাজ, কবর জিয়ারত ইত্যাদি। তবে দলবদ্ধ ছাড়া একাকীভাবে কবর জিয়ারতে কোনো সমস্যা নেই।
রাসূল (সা.) চুপিসারে একাকী জান্নাতুল বাকিতে কবর জিয়ারত করেছেন। আয়েশা সিদ্দিকাকে (রা.) নিদ্রা থেকে জাগ্রত করেননি। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন-এক রাতে হজরত রাসূল (সা.) কে না পেয়ে খুঁজতে বের হলাম। খুঁজতে খুঁজতে জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে আমি তাঁকে দেখতে পেলাম। তিনি বললেন-কি ব্যাপার আয়েশা? তোমার কি মনে হয় আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল তোমার উপর কোন অবিচার করবেন? হজরত আয়েশা (রা.) বললেন আমার ধারণা হয়েছিল আপনি অন্য কোন বিবির ঘরে গিয়েছেন। রাসূল (সা.) তখন বললেন যখন শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত আসে, তখন আল্লাহ তায়ালা এ রাতে প্রথম আসমানে নেমে আসেন। তারপর বনু কালব গোত্রের বকরীর পশমে চেয়ে বেশি সংখ্যক বান্দাদেরকে ক্ষমা করে দেন। (সুনানে তিরমিজি : ৭৩৯)।
শবেবরাত মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বান্দাদের জন্য বিশেষ উপহার। তাই এ রাত সম্পর্কে আমাদের বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। রাতটি ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে কাটাতে হবে। এ রাতের নির্ধারিত কোনো আমল না থাকলেও বিশেষ কিছু আমল করা যেতে পারে। যেমন নিজের যাবতীয় গোনাহের জন্য তওবা করে রাব্বুল আলামিনের দরবারে ক্ষমা প্রাার্থনা করা।
এ রাতের নফল নামাজের নির্ধারিত কোনো নিয়ম নেই, বরং অন্যান্য নফল নামাজের মতো দুই রাকাতের নিয়ত করে সূরা ফাতেহার পর যে কোনো সূরা মিলিয়ে যত ইচ্ছা পড়া যেতে পারে। সম্ভব হলে পরদিন অর্থাৎ ১৫তম দিনে একটি নফল রোজা রাখা।
কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিকতা ও জামাত ছাড়া একাকীভাবে সামর্থ্য অনুযায়ী নফল ইবাদত-বন্দেগি করা। তবে হ্যাঁ, কোনো প্রকার ঘোষণা ছাড়া, প্রস্তুতি ছাড়া কিছু মানুষ একত্রিত হয়ে গেলে সমস্যা নেই। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে, যেসব ইবাদত সমবেতভাবে আদায় করার প্রচলন রাসূল (সা.) থেকে প্রমাণিত, তা সমবেতভাবে আদায় করা। বাকিগুলো একাকী করা।
ইসলামি স্কলারদের মতে, আল্লাহতায়ালা নফল ইবাদতকে নিরবে পালনকারীকে বেশি ভালোবাসেন। আর ইখলাসের সঙ্গে স্বল্প আমল ঐকান্তিকতাহীন অধিক আমল থেকে উত্তম।
শবে বরাত উপলক্ষে হালুয়া-রুটির ব্যবস্থা, মসজিদে তাবারুকের আয়োজন, রাস্তাঘাটে আতশবাজি, পটকাবাজি, ঘর আলোকসজ্জা, রাতে মসজিদে অতিরিক্ত আলোকসজ্জা করা, মরিচলাইট, তারাবাতি, আধুনিক নয়ানাভিরাম বর্ণিল বাতির ঝাড়ে দিগদিগন্ত পল্লাবিত করা, আগরবাতি, মোমবাতি, গোলাপজল, কবরে পুষ্প অর্পণ, রাস্তা-হাটবাজারে যুবকদের আড্ডা, রাস্তাঘাটে অযথা ঘোরাঘুরি করা, চায়ের দোকানে আড্ডা এসব কর্মকাণ্ড এ রাতের আধ্যাত্মিক আবহকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। শরিয়তে এসব কাজের কোনো ভিত্তি নেই। এসব কাজ গর্হিত ও শরিয়ত পরিপন্থী। একারণ কিছু কাজ অপচয়ের শামিল, আবার কিছু কাজ ইবাদতের একাগ্রতা বিনষ্ট করে।
মনে রাখা দরকার, সারারাত জাগ্রত থেকে ইবাদত করা সুন্নত, ওয়াজিব, ফরজ কোনো আমল নয়। তবে ফজরের নামাজ পড়া ফরজ এবং জামাতে পড়া অপরিহার্য। অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে যে, রাতভর নফল ইবাদত করে ফজরের নামাজ যেন কাজা না হয়। মহিমান্বিত রজনীতে সবার উচিত নিজের যাবতীয় গোনাহের জন্য তাওবা করে রাব্বুল আলামিনের দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করা। মনের নেক আশা-আকাঙ্খা পূরণে ও মৃতদের মাগফেরাতের জন্য বেশি বেশি দোয়া করা। দান সদকাসহ নফল আমলের মাধ্যমে ভেজা চোখে মোনাজাতে রাত কাটানো। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।
Comment