প্রকৃতিতে শুরু হয়েছে শীতের প্রবাহ। সকালবেলা দরোজা খুলতেই একঝাঁক কুহেলিবিন্দু শীতলতার পরশ বুলিয়ে যায় গায়। ধবধবে কুয়াশা শুভ্রতার চাদর বিছিয়ে দেয় চারদিকে। শীতের এই ঋতুতে মহান আল্লাহর অনন্য নেয়ামত নতুন শাক-সবজি আর ফলমূলে ভরে যায় গ্রামের মাঠ। মেঠোপথ ধরে চলতে গিয়ে চোখ জুড়িয়ে যায় সবুজের সেই সমারোহ দেখে। শীতের আরেকটি অন্যতম নেয়ামত হলো খেজুর রস। শীতকালের সঙ্গে খেজুর রস ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। যেনো একে অন্যের পরম বন্ধু। কনকনে শীতের সকালে একগ্লাস ঠাণ্ডা রস শরীরে এনে দেয় সজীবতা। গ্রামে শীতকালের সকালটা খেজুর রস ছাড়া যেনো জমেই না। স্বাদে আর গন্ধে এককথায় অমৃত। পাখিরাও সে স্বাদ উপভোগ করা থেকে বাদ যায় না। মাটির হাঁড়িতে সরু ঠোঁট লাগিয়ে চুকচুক করে পান করে সুমিষ্ট রস। পবিত্র কোরআনে২৬ বার খেজুরের কথা বর্ণিত হয়েছে। আবার এই পবিত্র কোরআন প্রথম লেখা হয়েছিল খেজুরের পাতায়।
গ্রামের পিচঢালা সরু রাস্তার দুপাশে খেজুর বিথীকায় ঝুলে মাটির হাঁড়ি। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। ফজর নামাজ শেষে কুয়াশাঘেরা এমন সুন্দর পরিবেশে হাঁটতে বড্ডো ভালো লাগে। খেজুর রস আর গুড় দিয়ে গ্রামাঞ্চলের বাড়িতে বাড়িতে জমে ওঠে নানা পদের পিঠা বানানোর ধুম। ভাপা, পুলি, সিদ্ধপুলি, মালপোয়া, লালুয়া, রসের চিতইয়ের মতো বহু রকম পিঠা। পায়েশের ম ম ঘ্রাণে মোহিত হয় গ্রামের পরিবেশ। ঘরে ঘরে শুরু হয়ে যায় পৌষ পর্বণের এমন রকমারি আয়োজন। শহরের মানুষ খেজুর রসের পিঠা খেতে ছুটে আসে গ্রামে। সকালের মিঠা রোদে বসে শীতের পিঠা খাওয়া গ্রামের নিত্যকার দৃশ্য। কেউ আবার জামার কোচড়ে মুড়ি আর খেজুর গুড় নিয়ে বসে কোমল রোদে। শীতের মজাদার এই পিঠার কথা উঠে এসেছে সুফিয়া কামালের কবিতা ‘পৌষ পর্বণে পিঠে খেতে বসে/খুশিতে বিষম খেয়ে। বড় উল্লাস বাড়িয়াছে মনে/মায়ের বকুনি খেয়ে।
বাংলাদেশে আশ্বিন মাস থেকে সাধারণত রস সংগ্রহ শুরু হয়। তবে পৌষ ও মাঘ মাসে সবচেয়ে বেশি রস পাওয়া যায়। কারণ এই দুই মাসে শীতের প্রকোপ থাকে সবচেয়ে বেশি। আবহাওয়া যত ঠাণ্ডা থাকে, রসও তত বেশি পাওয়া যায়। তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে রসও কমতে শুরু করে। সকালবেলা সূর্য ওঠার আগেই গাছিরা গাছ থেকে রসের হাঁড়ি নামিয়ে ছুটে চলে দূরের হাট-বাজারে। টাটকা রসের ক্রেতাও হয় প্রচুর। কুয়াশাঘেরা সকালে গাছিদের কাঁধে করে হাঁড়ি ভরা রস নিয়ে যাওয়ার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য বাংলাদেশের পল্লীগ্রাম ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও হয়তো দেখা যায় না। এ যেনো প্রকৃতির ক্যানভাসে রঙতুলির পেলব স্পর্শে আঁকা দক্ষ শিল্পীর মনোরম চিত্রকর্মের অপূর্ব ছবি।
খেজুরের কাঁচা রসের মতো জ্বাল দেওয়া রসও বেশ সুস্বাদু আর পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। খেজুরের রসে প্রচুর এনার্জি, প্রোটিন, ফ্যাট, খনিজ ও মিনারেল রয়েছে। একে প্রাকৃতিক ‘এনার্জি ড্রিংক’ও বলা যেতে পারে। গ্লুকোজের চাহিদাও মেটায় বেশ। এতে ১৫-২০% দ্রবীভূত শর্করা থাকে বলে শারীরিক দুর্বলতা দূর হয় নিমিষেই।
খেজুর রস শরীরে পুষ্টি জোগান দেয়ার পাশাপাশি অর্থ উপার্জনেও সহায়তা করছে। প্রতিবছর খেজুর রস বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন শত শত কৃষক। গাছ তৈরি, রস সংগ্রহ, গুড় তৈরি, বাজারজাত আর পরিবহনসহ সব মিলিয়ে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে প্রতিবছর। শীত মৌসুমের এই সাড়ে চার মাসে একটি গাছ থেকে প্রায় ২০ থেকে ২৫ কেজি খেজুর গুড় উৎপাদন হয়। আর দৈনিক একটা গাছ থেকে ৮ থেকে ১৪ লিটার রস পাওয়া যায়। এগুলো রপ্তানী হয় বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা দেশে। এ কারণে শীতকালে জমজমাট হয়ে ওঠে ভ্যানচালক ও ট্রাক মালিকদের ব্যবসা।
মহান আল্লাহর এই অনন্য নেয়ামত পেয়ে সবার উচিৎ তাঁর যথাযথ শুকরিয়া আদায় করা। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যখন তোমাদের রব ঘোষণা দিলেন, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় করো, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেবো, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আজাব বড় কঠিন।’ (সুরা ইবরাহিম : ৭)
কমেন্টস করুন