ইসলামী জীবন বিধানে যে কয়টি ফজিলতপূর্ণ রাতের আলোচনা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়েছে; শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাত তার মাঝে অন্যতম। হাদিসে রাসুলে যে রাতটিকে লাইলাতুন নিসফ মিন শাবান বা শাবান মাসের মধ্য রজনী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। লাইলাতুন নিসফ মিন শাবান বা শাবান মাসের মধ্য রজনী অথবা শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাত— যাই বলি না কেন, এ রাতটিকে নিয়ে মুসলিম সমাজে বিধানগত কিছু মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
একটি গ্রুপ বা কিছু কিছু মুসলিমদের দাবী শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাত বলতে ইসলামী বিধানে কোনো রাত নেই এবং এ রাতকে কেন্দ্র করে কোনো নামাজ বা কোনো রোজা পালনের কোনো নিদের্শনাই ইসলামে নেই। আবার অন্য কিছু কিছু মুসলিমদের দাবী শবে বরাত খুবই ফজিলতপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ একটি রাত। এ রাতে গুরুত্ব সহকারে ইবাদত করা উচিত এবং এ রাতে আগের ও পরের দিন রোজা রাখা উত্তম।
শবে বরাতকেন্দ্রিক এহেন মতপার্থক্য থেকে বেঁচে সঠিকভাবে ইসলাম পালন করতে হলে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। শব অর্থ রাত বরাত অর্থ ভাগ্য-অতএব এর সমষ্টিগত অর্থ হলো ভাগ্যের রাত বা ভাগ্য নির্ধারণের রাত। এ ছাড়া শবে বরাত মুক্ত হওয়া বা বিচ্ছেদের রাত অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেহেতু, অপরাধীরা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত থাকে। এ ক্ষেত্রে বান্দার বন্দেগির সম্পর্ক বিচ্ছেদ হয়। আর আল্লাহর ওলিগণ পার্থিব অপমান-লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত হয়ে যায় (ইবনে মাজাহ)। শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতই শবে বরাতের রাত।
শবে বরাতের গুরুত্ব ও ফজিলত : হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রা.) বর্ণনা করেন, আমি একদিন রাসূল (সা.)-এর খেদমতে আরজ করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি আপনাকে শাবান মাস ব্যতীত অন্য কোনো মাসে এতো অধিক পরিমাণে রোজা রাখতে দেখিনি। রাসূল (সা.) বললেন, এটা ওই মাস যে মাস সম্পর্কে অধিকাংশ লোকই গাফেল থাকে। এটা রজব ও রমজান মাসের মধ্যবর্তী মাস। এটা এমন মাস, যে মাসে মানুষের আমলসমূহ আল্লাহপাকের দরবারে পেশ করা হয়। আমার আকাক্সক্ষা যে, আমার আমল আল্লাহর দরবারে এ অবস্থায় পেশ হোক যে, আমি রোজাদার। (নাসায়ী, শুআবুল ঈমান) অন্য একটি হাদিসে এসেছে, হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা.) কে রমজান মাস ব্যতীত অন্য কোনো মাসে পূর্ণ রোজা রাখতে দেখিনি এবং শাবান মাসের চেয়ে অন্য কোনো মাসে এতো বেশি রোযা রাখতে দেখিনি। (বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী)।
শবে বরাতে করণীয় : বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায়-এ রাতে আমাদের করণীয় কী। ইবাদত করা। এ রাতে গোসল করা মোস্তাহাব, গোসলের পর দুরাকাত তাহিয়াতুল অজুর নামাজ, অতঃপর দুরাকাতের নিয়তে প্রত্যেক রাকাতে আলহামদু (সুরা ফাতিহা) সুরা ইখলাছ সহকারে ৮ রাকাত নামাজ পড়তে হয় বলে বর্ণিত আছে। রোজা রাখা। রোজা রেখে ইবাদত করা, ইবাদত করে রোজা রাখা-দুটোই উত্তম। কেন না, সারা দিন রোজা রেখে ইবাদত করলে ইবাদতে মন বসে। যাবতীয় গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। কোরআন তিলাওয়াত করতে হবে। রিজিকের জন্য দোয়া করতে হবে। তওবা করতে হবে। তওবা তিনটির সমন্বয়ে হয়- ক. কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হতে হবে খ. পাপ সম্পূর্ণভাবে পরিহার করতে হবে এবং গ. ভবিষ্যতে পাপ না-করার অঙ্গীকার করতে হবে। উভয় জাহানের কল্যাণ কামনা করতে হবে। নফল নামাজ পড়তে হবে। কবর জিয়ারত করতে হবে। আল্লাহর রহমত কামনা করতে হবে। কেননা, আল্লাহর রহমত না-হলে এ রাতে কোনো ইবাদতই করতে পারব না। আর ইবাদত করার পর কবুল হবে না কারণ, আল্লাহর রহমত না-হলে ইবাদত কবুল হবে না। এ জন্য ইবাদতের বড়াই বা অহংকার করা যাবে না।
শবে বরাতে বর্জনীয় কাজ : আতশবাজি, অপ্রয়োজনীয় আলোকসজ্জা, হালুয়া রুটি এ রাতেই বানাতে হবে-এমন ধারণা দূর করতে হবে। শিরনি বা জিয়াফতের নিয়মে খাদ্য পাকানো বা অন্য যেকোনো খাদ্যোপকরণ শুধু এ রাতেই নয়, অন্য যেকোনো দিনও তা করা যেতে পারে। মসুর ডাল পাকাতে হবে এ ধারণাও দূর করতে হবে। শবে বরাতে প্রচুর শিরনি বানাতে গিয়ে মহিলাদের ইবাদত থেকে বঞ্চিত রাখার প্রথা বর্জন করতে হবে।