ইতিহাস বিবিধ ইতিহাস

কোন সালে কি কারণে মোট কতবার হজ পালন বন্ধ হয়েছে?

লিখেছেন মিরাজ রহমান

করোনাভাইরাসের মরণঘাতি আতঙ্কে এ বছর পবিত্র হজ পালন করা সম্ভব হবে নাকি হবে না— এমন চিন্তায় উদ্বিগ্ন আজ গোটা বিশ্বের মুসলিমসমাজ। প্রতিনিয়ত-ই চরিত্র বদলাচ্ছে মহামারি এই ভাইরাস এবং অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পরছে বিশ্বময়। আর এ কারণেই সৌদি আরবের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সম্প্রতি জানিয়েছেন, হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে এ বছর হয়তো পবিত্র স্থানদ্বয় খোলা নাও হতে পারে। তবে এখনই ঠিক স্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। পরিস্থিতি স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত হজের কোনো চুক্তিতে না যেতে সব দেশের মুসলিমদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন সৌদি আরবের হজ ও উমরাহবিষয়ক মন্ত্রী মোহাম্মদ সালেহ বিন তাহের।

হজ বা উমরাহ পালন বন্ধ হওয়ার ঘটনা একেবারেই নতুন কিংবা পৃথিবীর ইতিহাসে এবারই প্রথম ঘটবে— এমনটা নয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাসুল (সা.)-এর জন্মসাল এবং তার ইনতিকালের পরও প্লেগ ও কলেরা রোগের মহামারি, রাজনৈতিক দূর্দশা বা বিরোধ এবং যুদ্ধ-হামলার কারণে বহুবার সম্পূর্ণরূপে কিংবা সময়িকভাবে পবিত্র হজব্রত পালন বাতিল হয়েছে। তবে ১৯৩২ সালে আধুনিক সৌদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত কোনো বছর হজ পালন বাতিল হয়নি এমনকি ১৯১৭-১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারির সময়ও জারি ছিল হজ পালন। চলুন আমরা জেনে আসি, কোন সালে কি কারণে এখন পর্যন্ত মোট কতবার পবিত্র হজব্রত পালন বাতিল হয়েছিল।

১. একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫৭০ সালে আবরাহা বাদশাহ যখন হস্তিবাহিনী দ্বারা কাবা ঘর ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে এসেছিল, তখনও হজ পালন বন্ধ হয়েছিল। ইতিহাসবিদরা বলছেন, মূলত হজরত ইবরাহিম ও হজরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামের যুগ থেকে পবিত্র হজব্রত পালনের প্রথা চালু হয়েছে সুতরাং বাদশাহ আবরাহার আক্রমণে হজ পালন বন্ধ হওয়ার ঘটনাটি ইতিহাসের অধ্যায়ে সংযুক্ত রাখা আবশ্যক। সেই হিসেব মতে ৫৭০ সালেই প্রথম হজ পালন বাধাগ্রস্ত হয়।

২. ৮৬৫ সালে আরাফায় সংঘঠিত হয়েছিল একটি গণহত্যা। বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফত ও ইসমাঈল বিন ইউসুফের মধ্যকার বিরোধে মক্কার আরাফাতের ময়দানে সংঘঠিত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে সেখানে উপস্থিত বহু হাজী নিহত হয়েছিল, যার কারণে সে বছর পবিত্র হজব্রত পালন বাতিল হয়েছিল। রাসুল (সা.)-এর ইনতিকালের পর পবিত্র হজ পালন বাতিলের ইতিহাসের সূচনা এখান থেকেই।

৩. ৯৩০ থেকে ৯৪০ সাল পর্যন্ত মোট ১০ বছর স্থগিত ছিল হজ পালন। কট্টরপন্থী শিয়া গ্রুপ কার্মাতিয়রা হজের সময় মক্কায় আক্রমণ করে। ইতিহাসবিদদের দাবি, এ হামলার মূল হোতা আবু তাহিরের নেতৃত্বে তখন ৩০ হাজার হাজীকে হত্যা করা হয় এবং তাদের লাশ জমজম কূপে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর তারা ‘হাজরে আসওয়াত’ পাথর নিয়ে যায়। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ বলেছেন, কার্মাতিয়দের কাছ থেকে হাজরে আসওয়াত ফিরিয়ে আনতে ১০ বছর সময় লেগেছিল, ঐ দশ বছর হজ পালন বন্ধ ছিল। আবার কোনো কোনো ইতিহাসবিদ বলেছেন, ১০ বছর হজ পালন বন্ধ ছিল না বরং হাজরে আসওয়াদে চুম্বন করা ছাড়া চালু ছিল হজের অন্য সব কার্যক্রম।

৪. ৩৫৭ হিজরি মোতাবেক ৯৬৭ সালে মহামারি প্লেগ রোগ আঘাত হেনেছিল মক্কায়। প্লেগে আক্রান্ত হয়ে তখন প্রাণ হারিয়েছিল হাজার হাজার মানুষ ও প্রাণী। আর এ কারণে হজ পালন বাতিল হয়েছিল সে বছর। ইতিহাসের বিখ্যাত গ্রন্থ আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াতে বলা হয়েছে, এ ঘটনাটি ঘটেছিল ৯৬৮ সালে। ৯৬৭ হোক কিংবা হোক ৯৬৮— প্লেগের মহামারির কারণে এ বছর হজ পালন বাতিল হয়েছিল।

৫. ৯৮৩ সালে ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক আব্বাসীয় খেলাফত এবং মিশরভিত্তিক ফাতেমীয় খেলাফতের মধ্যকার দ্বন্ধের কারণে হজ পালন বাতিল হয় এবং এই দুই গ্রুপের রাজনৈতিক দূর্দশা ও বিরোধিতার কারণে ৯৯১ সাল পর্যন্ত মোট ৮ বছর পবিত্র হজব্রত পালন বন্ধ ছিল।



৬. কোনো কোনো ইতিহাসবিদ জানিয়েছেন, ১০০০ সালে ভ্রমণের সাথে যুক্ত ক্রমবর্ধমান ব্যয় নিয়ন্ত্রণসহ প্রাসঙ্গিক আরো কিছু কারণে মিসর, ইরাক, মধ্য এশিয়া ও উত্তর আরব অঞ্চলের মুসলিমরা হজ পালনে আসেননি। এ বছরের হজ পালন বাতিল হওয়াকে গবেষকগণ ঢালাওভাবে হজ বন্ধ হওয়া বলে স্বীকৃতি দিতে নারাজ।

৭. একইভাবে যুদ্ধের কারণে মুসলিম বিশ্বজুড়ে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে ১০৩৭ সালে  ইরাক এবং মিসর থেকে হজ পালন বন্ধ ছিল এবং ১০৯৯ সালেও বহু দেশের মুসলিমরা হজ পালন করেননি। সুতরাং ১০৩৭ ও ১০৯৯ সালেও সাময়িকভাবে হজ পালন বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

৮. ১২৫৬ থেকে ১২৬০ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক বিরোধের কারণে ৫ বছর হজ পালন বন্ধ ছিল।  তবে কোনো কোনো ইতিহাসবিদ জানিয়েছেন, এই পাঁচ বছর সামগ্রিকভাবে হজ পালন বন্ধ ছিল না। এ বছরগুলোতে হিজাজে অবস্থানরত মুসলিমরা হজব্রত পালন করেছেন।

৯. ১৭৯৮ সালে রোগ-মহামারি এবং রাজনৈতিক বিরোধের কারণে হজ পালন বাতিল হওয়া কথা কোনো কোনো প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। তবে এ বছর হজ বাতিল হওয়ার গ্রহণযোগ্য কোনো কারণের বর্ণনা কোনো প্রতিবেদনেই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

১০. ১৮১৪ সালে হেজাজ প্রদেশে প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে ৮,০০০ মানুষ মারা যাওয়ায় সে বছর হজ বাতিল করা হয়। এরপর ১৮২১ সালে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ইনতিকাল করে ২০ হাজার হাজী এবং হজ পালন বাধাগ্রস্ত হয়। ১৮৩১ সালে প্লেগ রোগের মহামারিতে আবারও বন্ধ ছিল হজ পালন। ভারত থেকে ছড়িয়ে পরা এই প্লেগ অন্যান্য দেশের মতো মক্কায়ও আঘাত হানে এবং এতে অনেক হাজী ইনতিকাল করেন। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনের সূত্র থেকে জানা যায়, ১৮৩৭ থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মহামারি আঘাত হেনেছে মক্কা-মদীনায়। ১৮৪০, ১৮৪৬ ও ১৮৫০ সালসহ এই ২০ বছরে ৩ বারে ৭ বছর পবিত্র হজ পালন বাতিল হয়েছিল। এরপরও কালেরা ও প্লেগ রোগের মহামারিতে ১৮৬৫ এবং ১৮৮৩ সালে বন্ধ ছিল হজ পালন। কারো কারো মতে, ১৮৯২ সালেও এ সমস্যা দেখা দিয়েছিল এবং বন্ধ ছিল হজব্রত পালন।

৫৭০ সালে ১ বছর + ৮৬৫ সালে ১ বছর + ৯৩০ থেকে ৯৪০ সাল পর্যন্ত ১০ বছর + ৯৬৭ সালে ১ বছর + ৯৮৩  থেকে ৯৯১ সাল পর্যন্ত ৮ বছর + ১০০০ সালে ১ বছর + ১০৩৭ সালে ১ বছর + ১০৯৯ সালে ১ বছর + ১২৫৬ থেকে ১২৬০ সাল পর্যন্ত ৫ বছর + ১৭৯৮ সালে ১ বছর + ১৮১৪ সালে ১ বছর + ১৮২১ সালে ১ বছর + ১৮৩১ সালে ১ বছর + ১৮৩৭ থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত তিনবারে ৭ বছর + ১৮৬৫ সালে ১ বছর + ১৮৮৩ সালে ১ বছর + এবং ১৮৯২ সালে ১ বছর = মোট ৪৩ বছরে ৪৩ বার। ৫৭০ সাল থেকে ১৮৯২ সাল পর্যন্ত মোট ৪৩ বার সম্পূর্ণরূপে অথবা সাময়িকভাবে পবিত্র হজব্রত পালন বন্ধ বা বাধাগ্রস্থ হয়েছে। সুতরাং বিভিন্ন মিডিয়াতে ৪০ বার হজ বন্ধ থাকার যে তথ্য প্রদান করা হয়েছে তা সঠিক নয়।

এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন বিখ্যাত মিডিয়া হাউজের রেফারেন্স দিয়ে ছোট-বড় বহু মিডিয়াতে ঢালাওভাবে প্রচার করা হচ্ছে, এবার অর্থ্যাৎ ২০২০ সালে যদি হজ পালন বন্ধ ঘোষণা করা হয়; তাহলে ২২২ বছর পর হজ বাতিলের নজির দেখবে বিশ্ববাসী। এই তথ্যটি একেবারেই অসত্য। বলা হয়, ১৭৯৮ সালের পর এবারই প্রথম বাতিল হতে পারে হজ। কিন্তু ১৭৯৮ সালের পর ১৮১৪ থেকে ১৮৯২ সাল পর্যন্ত ১৩ বার হজ পালন সম্পূর্ণরূপে অথবা সাময়িকভাবে বন্ধ হয়েছিল।  সুতরাং ২২২ বছর পর হজ বাতিলের ইতিহাসের পূণরাবৃত্তির তথ্যটি সংশোধনযোগ্য।

সাময়িকভাবে হোক কিংবা হোক সম্পূর্ণরূপে পবিত্র হজব্রত পালন বন্ধ হওয়ার বিষয়টি কখনোই কাম্য নয়। পবিত্র এ ইবাদতটি পালনের মধ্যে প্রভুর দরবারে বান্দার গোলামি প্রকাশ এবং রাসুলের রওজায় প্রেমময় হাজিরি প্রদানে মতো মায়াময় আমল জড়িত। আর এ কারণেই হজব্রত পালন বন্ধ হওয়ার সন্দেহ জাগা মাত্রই কেঁদে উঠে কোটি কোটি মুমিন-মুসলিমের মন। দয়াময় প্রভুর দরবারে আরজি রইলো, হে আমার প্রভু! হে কাবার বর!! হে আমার মালিক!!! হে রাসুলের বন্ধু!!!! তোমার ঘরে গিয়ে গোলামি প্রকাশ করার; রাসুলের রওজায় গিয়ে হাজিরি দেওয়ার এই প্রেমময় আমলকে আর তুমি বন্ধ করো না। কেয়ামত পর্যন্ত কোনো কারণেই যেন আর মক্কা-মদীনার জিয়ারাহ বাতিল না হয়। আমিন। ছুম্মা আমিন ইয়া রাব্বাল আলামীন।

 

Comment

লেখক পরিচিতি

মিরাজ রহমান

গতানুগতিক ধারার বাইরে থেকে কাজ করে ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন মিরাজ রহমান। পেশায় পুরোদস্তুর একজন সাংবাদিক হলেও কেবল ইসলামকে ঘিরেই আবর্তিত তার ধ্যান-জ্ঞান। দৈনিক পত্রিকার ইসলাম পাতায় লেখালেখি থেকে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন বটে, কিন্তু একসময় শিল্প চর্চায়ও ছিলেন বেশ মনোযোগী।
মিডিয়ায় সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেছেন যখন, তখনও তিনি ছাত্র। মাদানিনগর মাদরাসার কাফিয়া জামাতের (শ্রেণি) শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় কণ্ট্রিবিউটর হিসেবে প্রথম কাজ শুরু করেন দৈনিক যুগান্তরে। ধারালো লিখনী শক্তি অল্পদিনের মধ্যে পরিচিত করে তোলে তাকে। দেশের জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রায় সবগুলোতেই ইসলামবিষয়ক কলাম ও ফিচার লিখেছেন দীর্ঘ সময়। জাতীয় প্রিন্ট মিডিয়াগুলোতে তার অন্তত দুই সহস্রাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
মিরাজ মূলত পড়াশুনা করেছেন কওমি শিক্ষাধারায়, এর পাশাপাশি তিনি জেনারেল শিক্ষাধারায়ও পড়াশুনা করছেন। সহ-সম্পাদক হিসেবে প্রথম যোগদান করেন দৈনিক ডেসটিনি পত্রিকায়। সেখান থেকে দৈনিক কালের কণ্ঠে। দেশে-বিদেশে অনলাইন গণমাধ্যমের জয়যাত্রা শুরু হলে মিরাজ ইন্টারনেট জগতকে ইসলাম প্রচারের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র বিবেচনা করে অনলাইনেই গাঁটছাড়া বাঁধেন। দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইসলামবিষয়ক অনলাইন পোর্টাল প্রিয়.কমের ‘প্রিয় ইসলাম’-এর সৃষ্টি ও পথচলার সূচনা তারই হাতে। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন প্রিয়.কমের প্রিয় ইসলাম বিভাগের এডিটর ইনচার্জ। সর্বশেষ কর্মরত ছিলেন দৈনিক বাংলাদেশের খবরের ফিচার ইনচার্জ হিসেবে।
টেলিভেশনে অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা ও আলোচনার সঙ্গেও ইতিমধ্যে যুক্ত হয়েছেন মিরাজ রহমান। পরিচালনা করেছেন বেশ কিছু অনুষ্ঠানও। এসো কলম মেরামত করি, ছোটদের নবী-রাসূল সিরিজ, তাবলিগী জামাতের পৃষ্ঠপোষক-মুরুব্বি ছিলেন যাঁরা, শরয়ী পর্দার বিধান, আশিক মিন ফিলিস্তিন, নারী তুমি সৌভাগ্যবতী ও হালাল ব্যবসা ও হালাল অর্থনীতির কথকতাসহ বেশ কিছু আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থেও জনক তিনি। বর্তমান তিনি ইসলাম প্রতিদিনের সম্পাদক ও প্রকাশক এবং দ্য সুলতান প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।