এম আযীযুল হক। একজন ব্যক্তিত্ব। জীবন্ত একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের ইসলামিক ব্যাংকিং জগতে সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশে ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন, অথচ এম আযীযুল হকের নাম জানেন না বা তার কর্ম সম্পর্কে ধারণা রাখেন না- এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। আযীযুল হককে ফাদার অব ইসলামিক ব্যাংকিং ইন বাংলাদেশ উপাধিতেও অভিহিত করা হয়। বাংলাদেশে ইসলামিক ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্সের ক্ষেত্রে অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিনি ইসলামী ব্যাংকিং অ্যাওয়ার্ড-২০০৫ লাভ করেন। আযীযুল হক সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজে দীর্ঘ ১২ বছর প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তা ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদে ১০ বছর খন্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতাও করেছেন। বাংলাদেশে ইসলামিক ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্স জগতের পুরোধা এম আযীযুল হক ছিলেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও। এ ছাড়া এম আযীযুল হক সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ও বাংলাদেশের প্রথম ইসলামিক ফাইন্যান্স কোম্পানি ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালকও ছিলেন। বর্তমানে তিনি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ইসলামিক ব্যাংকিং কনসালট্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ব্যাংক এশিয়া, ঢাকা ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, সিটি ব্যাংক ও ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটির চেয়ারম্যান এবং সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ডের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিরাজ রহমান
ইসলামী ব্যাংক বা ইসলামিক ব্যাংকিং ও জেনারেল ব্যাংক বা জেনারেল ব্যাংকিং বলতে কী বোঝায় এবং এর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কী কী?
এম আযীযুল হক : সাধারণত ব্যাংক বলা হয় এক ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যা সাধারণ মানুষের সঞ্চয় সংগ্রহ করে পুঁজি গড়ে তোলে এবং সেই পুঁজি উদ্যোক্তাদের ধার দিয়ে বিনিয়োগে সাহায্য করে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যাংক দায়িত্ব পালন করে থাকে। আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাংক একটি দেশের প্রধান অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি। দেশ-বিদেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-কে সচল ও কার্যকর রাখতে এর ভূমিকা অপরিসীম। ব্যক্তি কিংবা রাষ্ট্রীয় সঞ্চয়, লেনদেন ইত্যাদির গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে থাকে এ প্রতিষ্ঠানটি। ব্যাংক ব্যক্তি কর্তৃক প্রদেয় সঞ্চিত অর্থ জমা রাখে এবং ওই অর্থ ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান ঋণ গ্রহণ করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। নির্দিষ্ট সময় বা মেয়াদান্তে গ্রাহকের জমাকৃত অর্থের ওপর সুদ বা মুনাফা প্রদান করা হয়।
আর Organisation of Islamic Cooperation (OIC) কর্তৃক প্রদত্ত ইসলামী ব্যাংকের একটি সংজ্ঞা রয়েছে, যেটি সবচেয়ে সামগ্রিক ও বিশ্বজনীন। ইসলামী ব্যাংক এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যা তার মৌলিক বিধান ও কর্মপদ্ধতির সব স্তরেই ইসলামী শরিয়াহ নীতিমালা মেনে চলতে বদ্ধপরিকর এবং কর্মকান্ডের সব পর্যায়ে সুদকে বর্জন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই সংজ্ঞার আলোকে ইসলামী ব্যাংকের মৌলিক অবকাঠামো নির্ধারিত হয়- এক. আর্থিক প্রতিষ্ঠান হওয়া। দুই. মৌলিক বিধান ও কর্মপদ্ধতির সব স্তর ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক পরিচালিত হওয়া। তিন. শরিয়াহ নীতিমালা মেনে চলার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর থাকা। চার. কর্মকান্ডের সব পর্যায়ে সুদকে বর্জন করার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হওয়া।
পার্থক্য : উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরুর মাঝে যেমন বা যতটুকু পার্থক্য রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বা ইসলামিক ব্যাংকিং এবং জেনারেল ব্যাংক বা জেনারেল ব্যাংকিংয়ের মধ্যে তেমন পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে- এখন যেভাবে ইসলামিক ব্যাংকিং চর্চা হচ্ছে বা চলছে তাতে এই পার্থক্য জনসম্মুখে প্রকাশিত হচ্ছে না। মূল বিষয় হলো, মানি অ্যান্ড কমোডিটি- দুটি দুই জিনিস। অর্থনীতির ভাষায় কমোডিটি হলো যার ইউটিলিটি আছে। যা আমাদের প্রয়োজন মেটাতে পারে তা-ই হলো কমোডিটি। যেমন- ধান, চাল ইত্যাদি। এগুলো সরাসরি মানুষের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। আর মানি হলো- সে নিজে কোনো চাহিদা মেটানোর ক্ষমতা রাখে না, কিন্তু পরিবর্তিত ও অন্য জিনিসে রূপান্তরিত হয়ে চাহিদা মেটাতে সক্ষম। টাকা দিয়ে অন্য জিনিস এনে চাহিদা মেটানো সম্ভব, কিন্তু টাকা নিজে সরাসরি কোনো চাহিদা মেটাতে সক্ষম নয়।
কনভেনশনাল ব্যাংক বা সাধারণ ব্যাংক টাকার ব্যবসা করে এবং ইসলামী ব্যাংক কমোডিটির ব্যবসা করে। সাধারণ ব্যাংকের ব্যবসা হচ্ছে মানি টু মানি। ক্লায়েন্ট টাকা দিচ্ছে আর ব্যাংক তাকেও টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। টাকার বিনিময়ে কোনো বস্তু বা জিনিস ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে না। প্রেজেন্ট মানি টু ফিউচার মানির কনট্রাক্ট হচ্ছে। আবার ব্যাংক ব্যবসায়ীকে টাকা দিচ্ছে, ব্যবসায়ীও ব্যাংককে টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। ব্যবসায়ী কিন্তু ব্যাংককে ব্যবসায়িক পণ্য ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে না। এখানেও পুরাটাই মানি টু মানির লেনদেন হচ্ছে। মানি টু মানির ব্যবসা- এটাকে ইসলামী পরিভাষায় করদ বলা হয়। এই মানি টু মানির ট্রানজেকশনে প্রিন্সিপালের বাইরে অতিরিক্ত কিছু নেওয়া হারাম। ইসলাম তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে। আর প্রতিটি কনভেনশনাল বা সাধারণ ব্যাংক এই কাজটি করছে। অপরদিকে ইসলামিক ব্যাংক করছে বাইয়া। বাইয়া মানে হলো মানি থেকে কমোডিটিতে যাওয়া এবং কমোডিটি থেকে মানিতে আসা। অর্থাৎ টাকা দিয়ে পণ্য গ্রহণের প্রতিশ্রুতি বা পণ্য দিয়ে টাকা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা।
এ ছাড়া সম্পদ সৃষ্টির যত মৌলিক মেকানিজম আছে, তার মধ্যে বাইয়া বা ব্যবসা ছাড়া কোনো রিয়েল সম্পদ সৃষ্টি হয় না। মনে করুন, আপনার কাছে টাকা আছে। এখন টাকাকে যদি সিন্দুকে আটকে রাখেন, তাহলে কিন্তু ব্যবসা হবে না এবং সম্পদ সৃষ্টি হবে না। আপনাকে কী করতে হবে? ব্যবসা করতে হবে। টাকা দিয়ে গুডস বা পণ্য কিনতে হবে। মানে টাকাকে গুডস বা পণ্যে রূপান্তর করতে হবে। এরপর ব্যবসা করে সেই গুডসকে আবার টাকায় রূপান্তর করতে হবে। এভাবে টাকাকে গুডসে এবং গুডসকে টাকায় রূপান্তরের মাধ্যমে ব্যবসা হবে। আর ব্যবসার মাধ্যমে সম্পদ সৃষ্টি হবে। পৃথিবীতে সম্পদ সৃষ্টির সব মেকানিজমের মৌলিক উপাদান হলো বাইয়া বা ব্যবসা। আর ইসলামিক ব্যাংকিং হলো বেইজড অন বাইয়া বা ব্যবসা। এখানে মানি টু মানির ব্যবসার কোনো অপশন নেই। আল্লাহ মহান পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, আমি ব্যবসাকে হালাল করেছি আর সুদকে করেছি হারাম।
আল্লাহ মহান করদ বা মানি টু মানি ব্যবসা বা ম্যাথডের ফল হিসেবে সুদকে হারাম ঘোষণা করেছেন। তিনি রিবা বা সুদকে হারাম করেছেন, কিন্তু করদ বা ম্যাথডকে হারাম করেননি। বরং করদের ব্যাপারে বলা হয়েছে- করদ ইজ বেটার দেন চ্যারিটি। বিপরীতে আবার বলেছেন বাইয়া বা ব্যবসাকে হালাল করলাম। এখানে কিন্তু আল্লাহ মহান প্রফিট বা লাভকে হালাল করার কথা বলতে পারতেন। কিন্তু তিনি এখানে প্রফিটের কথা এই জন্য বলেননি, কারণ সব ব্যবসায়ীকে করদ বা মানি টু মানি প্রফিটের ব্যবসা থেকে বাস্তবিক ব্যবসায় ফিরিয়ে আনাই হচ্ছে আল্লাহ মহানের মূল উদ্দেশ্য। এই জন্য তিনি আয়াতে প্রফিট বা লাভকে হালাল করার কথা না বলে সরাসরি ব্যবসার কথা বলেছেন।
ইকোনমিক্স বা অর্থনীতির দুটি ধারা বা দিক রয়েছে। একটি হচ্ছে ফাইন্যান্সিয়াল ট্রানজেকশন বা মানি টু মানি ট্রানজেকশন। আরেকটি হচ্ছে রিয়েল ইকোনমিক ট্রানজেকশন। আল্লাহ মহান চান সব উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী রিয়েল ইকোনমিক ট্রানজেকশন বা অ্যাক্টিভিটিতে অভ্যস্ত হোক। কারণ, করদের মাধ্যমে কোনো সম্পদ সৃষ্টি হয় না। মূলত সম্পদ সৃষ্টি হয় বাইয়া বা ব্যবসার মাধ্যমে। মূল কথা হলো, ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের যত মেকানিজম আছে সব বাইয়া বা রিয়েল ব্যবসাভিত্তিক আর কনভেনশনাল বা সাধারণ ব্যাংকিংয়ের সব মেকানিজম মানি টু মানির প্রফিট মেকিং ব্যবসাকেন্দ্রিক।
বিভিন্ন নবী-রাসুলের জীবনের ইকোনমিক অ্যাক্টিভিটিস বা অর্থনৈতিক চর্চা এবং আমাদের রসুল (সা.)-এর অর্থনৈতিক জীবন সম্পর্কে কিছু বলুন…
এম আযীযুল হক : একজন নবীও পাবেন না যার জীবনে কোনো ইকোনমিক অ্যাক্টিভিটিস ছিল না। আমাদের রসুল (সা.)-এর জীবনের ইকোনমিক পার্ট ছিল আরো শক্তিশালী। তিনি উদ্যোক্তা ছিলেন, আবার ব্যবসায়ীও ছিলেন। তার ব্যবসায়িক জীবনের ইনভেস্টর ছিলেন হজরত খাদিজা (রা.)। তাকে বলা হতো নারী বণিক এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছিলেন তাহেরা বা পবিত্রা। পবিত্র কোরআনে যে ২৫ বা ২৪ নবী-রাসুলের কথা এসেছে- প্রত্যেক নবী-রাসুলের পরিচিতিতে তার অর্থনৈতিক জীবনের আলোচনা স্থান লাভ করেছে। যেমন- হজরত আদম (আ.)-এর অর্থনৈতিক জীবন ছিল কৃষিনির্ভর। কৃষিকাজের মাধ্যমে তিনি তার অর্থনৈতিক চাহিদা মেটাতেন। হজরত সোলাইমান (আ.)-এর অর্থনৈতিক জীবন ছিল কিছুটা প্রযুক্তিময়। আবার হজরত ঈসা (আ.)-এর ইকোনমিক জীবন ছিল চিকিৎসানির্ভর। এভাবে প্রায় সব নবী-রাসুলের জীবনেই অর্থনৈতিক একটি অংশ সংযুক্ত ছিল এবং তারা সেটাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। আর মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিশ্বমানবতার জন্য একটি পরিপূর্ণ আদর্শ জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন। জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে পূর্ণ নবুয়াতি জীবনে অর্থনৈতিক সেক্টরে তিনি অনুপম শিক্ষা ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছেন।
রসুলুল্লাহ (সা.) শিশুকাল কাটিয়েছিলেন পবিত্র নগরী মক্কায়। শীতকালে ইয়েমেন ও গ্রীষ্মে সিরিয়ায় ভ্রমণ করা ছিল কুরাইশদের দুটি অপরিহার্য বাণিজ্যিক ভ্রমণ। সর্দার হাশিম ইবনে আবদে মানাফ কুরাইশের ধনী-দরিদ্র সবার মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বন্ধন সৃষ্টি করার আহ্বান জানান। ঠিক এই সময়ে এসে পড়ে ইসলামের বাণী। রসুল (সা.)-এর আগমনে ধন্য হয় মরুপ্রান্তর এবং গোটা আরব জাহানে তার হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবন্ধন।
এ ছাড়াও কুরাইশদের আকাশে তখন ছিল ধনাঢ্যতা ও শৌর্য-বীর্যের ঝকঝকে রোদ। এমন খাঁটি বাণিজ্যিক পরিবেশেই বেড়ে ওঠেন মহানবী (সা.)। বারো বছর বয়সে রসুলুল্লাহ (সা.) চাচা আবু তালিবের সঙ্গে সিরিয়ার পথে একটি বাণিজ্যিক কাফেলায় অংশগ্রহণ করেন। যৌবনে উপনীত হওয়ার পর মেষ চরান এবং পরে ব্যবসার মাধ্যমে শুরু হয় মহানবী (সা.)-এর অর্থনৈতিক জীবন।
তার ব্যবসায়িক সুনাম ও আল-আমিন উপাধিতে ভূষিত হওয়ার কারণে খাদিজা (রা.) তাকে প্রথমত ব্যবসায়িক সঙ্গী ও দ্বিতীয়ত স্বামী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। স্বামী হিসেবে রসুলুল্লাহ (সা.) খাদিজা (রা)-এর ব্যবসার তত্ত্বাবধান করতেন। সঙ্গে সঙ্গে নিজেও খাদিজার পুঁজি নিয়ে পুরোদমে ব্যবসা করছিলেন। তিনি ছিলেন বাণিজ্য নগরী মক্কার সর্বাধিক পুঁজিবান ব্যবসায়ী। নিঃসন্দেহে এই দীর্ঘ ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতাই তার জন্য মদিনায় অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটাতে সহায়ক হয়েছিল। রসুলুল্লাহ (সা.)-এর অনাড়ম্বর জীবনচরিত দেখে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, তিনি ছিলেন মক্কার সবচেয়ে বলিষ্ঠ, বুদ্ধিমান ও অধিক পুঁজিবান ব্যবসায়ী।
নবী হওয়ার পূর্বে তিনি মানবসেবায় নিজের পুঁজি কী পরিমাণ খরচ করতেন তা খাদিজা (রা.)-এর ভাষায় ফুটে উঠেছে- নিশ্চয় আপনি আত্মীয়তার বন্ধন রচনা করেন, মেহমানদারি করেন ও অনাথকে বহন করেন এবং নিঃস্বদের জন্য উপার্জন করেন।
রসুলুল্লাহ (সা.) পুঁজিবাদী সর্বস্ব ও মানবতাবিরোধী অর্থনীতির পরিবর্তে অত্যন্ত কল্যাণমুখী এবং মধ্যপন্থি অর্থনৈতিক নীতিমালার আদর্শ তার ব্যক্তিগত জীবন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। রসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন স্বনির্ভর। অর্থনীতিবিদদের মতে, রসুল (সা.) যে অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলেছিলেন, তাতে নিুোক্ত মূলনীতিগুলো অন্তর্ভুক্ত। যথা- (ক) সেবামূলক কার্যক্রম। (খ) মধ্যস্বত্বভোগ সীমাবদ্ধ করা এবং সুদকে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা। (গ) ব্যক্তি মালিকানার সঙ্গে সামাজিক দায়িত্ববোধের সমন্বয়। (ঘ) সাম্যের নীতি প্রতিষ্ঠা। মহানবী (সা.) জাকাত, উশর, ফাই (সন্ধিসূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ), জিজিয়াহ (কর), খারাজ ও খুমুস (যুদ্ধলব্ধ সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ) ইত্যাদি প্রচলন করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিতকে মজবুত করেছিলেন। এ ছাড়া পবিত্র ব্যবসায়িক পেশা মনোপ্রবৃত্তির শিকার না হওয়ার জন্য তিনি ঋণ ও ক্রয়-বিক্রয় লিখে রাখার আদেশ দিয়েছেন।
একজন মুসলিমের জীবনে অর্থনৈতিক অধ্যায়ের গুরুত্ব কতটুকু?
এম আযীযুল হক : একজন মুসলিমের জীবনে অর্থনৈতিক বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক মুসলিমের জীবনে প্রথম বিষয় হলো ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসগুলো জানতে হবে, মানতে হবে এবং হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। এটা হলো ইসলামের প্রথম রিকোয়ারমেন্ট। দ্বিতীয় বিষয় হলো অ্যাকশন, আমল-ইবাদত বা শরিয়ত। তৃতীয় বিষয় হলো আখলাক। ইসলামের যত দিক-নির্দেশনা রয়েছে সবগুলোকে এই তিনটি বিষয়বস্তুর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। ইসলামের দ্বিতীয় রিকোয়ারমেন্ট আমল-ইবাদত বা শরিয়তকে আবার দুইভাগে বিভক্ত করা যায়। এক হলো আমল-ইবাদত আর দুই হলো মোয়ামালাত বা লেনদেন। ইবাদত হলো প্রভুর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক আর মোয়ামালাত হলো পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং সময়ের সঙ্গে সম্পর্ক। প্রত্যেক মানুষ কিন্তু আল্লাহতায়ালার খলিফা। ইবাদতের মধ্যে সালাত, সাওম, জাকাত, রোজাসহ যত ইবাদত রয়েছে এগুলো আদায় করতে একজন মুসলিমের প্রতিদিনের ২৪ ঘণ্টা সময়ের মাত্র দুই থেকে তিন ঘণ্টা ব্যয় হয়। বাকি ২১-২২ ঘণ্টা কি একজন মুসলিম মুক্ত? আল্লাহ মহান বলেছেন, ইসলামে পূর্ণভাবে প্রবেশ কর। তো ২৪ ঘণ্টার ২ ঘণ্টা ইবাদতে ব্যয় হলে পূর্ণভাবে কি ইসলামে প্রবেশ সম্ভব? সম্ভব নয়। বাকি ২২ ঘণ্টা একজন মুসলিমের ইসলামের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী কাটাতে হবে। এই ২২ ঘণ্টার মধ্যে রয়েছে সামাজিক জীবন, অর্থনৈতিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন ইত্যাদি। আর এই ২২ ঘণ্টার জীবনে যা কিছু রয়েছে প্রায় সবই কোনো না কোনোভাবে অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। সুতরাং একজন মুসলিম যদি ভাবে- তার প্রতিদিনের মাত্র দুই ঘণ্টা সময় ইবাদত করে বাকি ২২ ঘণ্টা গোলমাল করবে, তাহলে কখনো তার পক্ষে পূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করা সম্ভব হবে না। একজন মুসলিমের জীবনে অর্থনৈতিক অধ্যায়ের গুরুত্ব খুব বেশি। কারণ, কারো উপার্জন যদি হালাল না হয়, তাহলে কিন্তু অজু ছাড়া নামাজের মতো অবস্থা হবে। হারাম উপার্জনকারীর কোনো আমল-ইবাদতই কবুল হয় না। সুতরাং পরিপূর্ণভাবে ইসলাম পালন করার জন্য প্রতিটি মুসলিমের জীবনে অর্থনৈতিক অধ্যায়ের গুরুত্ব অপরিসীম।
বর্তমানে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে চলমান ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের পথ ও পদ্ধতি এবং বাস্তবায়নের ধারা ও নীতিমালা সম্পর্কে আপনার কিছু বলার আছে?
এম আযীযুল হক : আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি লাখ লাখ মানুষকে সুদ ও সুদি অর্থনৈতিক লেনদেন এবং অর্থনৈতিক জীবন থেকে রক্ষা করার একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার একজন কর্মী হিসেবে তিনি আমাকে কবুল করেছেন। আমি আগেও বলেছি, উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরুর মধ্যে যেমন বা যতটুকু পার্থক্য রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বা ইসলামিক ব্যাংকিং এবং জেনারেল ব্যাংক বা জেনারেল ব্যাংকিংয়ের মধ্যে তেমন পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে, এখন যেভাবে ইসলামিক ব্যাংকিং চর্চা হচ্ছে বা চলছে তাতে এই পার্থক্য জনসম্মুখে প্রকাশিত হচ্ছে না। যারা ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন, তাদের উচিত শতভাগ ইসলামী নির্দেশনা অনুসরণ করা। কারণ ইসলামী দিকনির্দেশনা শতভাগ অনুসরণ করার মাধ্যমেই কেবল প্রকৃত ইসলামিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, অন্যথায় নামে ইসলামিক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠিত হলেও কাজে কিছু হবে না।
কমেন্টস করুন