সম্প্রতি ১৮৮ দেশের প্রায় ২৩ লাখ মুসলিমের অংশগ্রহণে পবিত্র হজ সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে এবার ১ লাখ ২৭ হাজার ১৫২ জন হজ আদায় করেছেন। অতীতের তুলনায় এবার বাংলাদেশের হজ ব্যবস্থাপনা সার্বিকভাবে সুশৃংখল হয়েছে। তবে কিছু সমস্যা লক্ষ্য করা গেছে। এসব সমস্যা আগামীতে যেন না থাকে এবং দোষী এজেন্সি ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং এবারকার বড় কিছু সাফল্য অর্জনের পেছনে আলাদা কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল— ইত্যাদি বিষয়ে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী আলহাজ এডভোকেট শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন আমিন ইকবাল
প্রশ্ন : এবার বাংলাদেশের হজ-ব্যবস্থাপনা অন্যবারের তুলনায় সুন্দর ও সুশৃংখল হয়েছে। এমন কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন— যার ফলে হাজীরা সুন্দরভাবে হজ করতে পেরেছেন?
এডভোকেট শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ : ২০১৯ সালে আমাদের হজ ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে সুন্দর হোক— এ বিষয়ে শুরু থেকেই প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার একটি নির্দেশনা ছিল এবং আমাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ছিল। সে লক্ষে ধর্মমন্ত্রণালয়ের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়সহ হজ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত— সকলকে নিয়ে আমরা সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করেছি। সবার প্রতি আমার আহ্বান ছিল— যেকোনো মূল্যে এবারের হজ ব্যবস্থানাকে একটি দৃশ্যমান সফলতায় নিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনাকে আমরা সবসময় স্মরণ রেখে কাজ করেছি। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি হাজীরা আল্লাহর মেহমান। আর আল্লাহর মেহমানদের চোখের পানি আমি সহ্য করতে পারি না। বিশেষ করে— ইহরামের কাপড় পরে হাজিরা যখন বিমানবন্দরে কান্নাকাটি করেন, এটা আমাকে খুব কষ্ট দেয়। এই পরিস্থিতি আমি আর দেখতে চাই না।’
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা মনেপ্রাণে গ্রহণ করে যেকোনো সময়ের চেয়ে এবার বাংলাদেশের হজ ব্যবস্থাপনা সুন্দর হোক— কঠিনভাবে সে চেষ্টা করেছি। আমি বিশ্বাস করি— সততা, নিষ্ঠা, সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে যেকোনো কাজে আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যায়। পবিত্র হজের বিষয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম— ‘এ ব্যাপারে আমি নিজে দুর্নীতি করব না এবং কাউকে দুর্নীতি করতেও দেব না।’ এই কঠিন ব্রত থাকার কারলেই হয়তো আল্লাহর রহমতে আমরা সুন্দর কিছু উপহার দিতে পেরেছি।
প্রশ্ন : সার্বিকভাবে এবার হজ ব্যবস্থাপনা সুন্দর হলেও ছোটখাটো কিছু সমস্যা কিন্তু ছিল! যেমন— সর্বশেষ কয়েকজন হাজী যেতে পারছিলেন না, আবার ফিরে এসে হাজীদের কেউ কেউ ওখানকার নানা সমস্যার কথা জানিয়েছেন। আগামীতে যেন এ সমস্যাগুলো না থাকে— সে লক্ষ্যে কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কী?
শেখ মোহাম্মাদ আব্দুল্লাহ : আমরা শতভাগ চেষ্টা করেছি সব রকমের সমস্যামুক্ত সুন্দর হজ-ব্যবস্থাপনা উপহার দিতে। ফলে নিবন্ধিত কোনো হাজীই কিন্তু এবার বাদ পড়েনি। সবাই হজ করতে পেরেছেন। আমি সৌদি যাওয়ার আগে সাংবাদিক সম্মেলনে ওপেন বলেছি— ‘কেউ কি আছেন যে, এখনও যেতে পারেননি? থাকলে আসুন, আমি সঙ্গে নিয়ে যাবো।’ তখন চারজন লোক আমার কাছে এলে হজ অফিসারকে বললাম, তাদের বিষয়ে দ্রুত সিন্ধান্ত নিন। পরে দেখা গেল, সম্পূর্ণ তাদের সমস্যার কারণে তারা আটকা পড়েছে। কেউ ভিসা হারিয়ে ফেলেছে, কেউ পার্সপোর্ট হারিয়ে ফেলেছে। কেউ পূর্ণ টাকা জমা দেয়নি ইত্যাদি। এসব তো হাজিদের নিজের সমস্যা। তবুও আমরা শেষ পর্যন্ত আল্লাহর রহমতে সবাইকে হজ করাতে পেরেছি।
তবে হ্যাঁ, ছোটখাটো কিছু সমস্যা আমাদের নজরেও এসেছে। আগামীতে কোনো ধরনের সমস্যা যেন না থাকে এবং কোনো একজন হাজীর কাছ থেকেও যেন কষ্টের কথা শুনতে না হয়— সে লক্ষে আমরা এখন থেকেই সম্মিলিত চেষ্টা শুরু করেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও আমাকে তাগাদা দিয়ে বলেছেন, ‘এবার যতটুকু ভালো করেছেন, তা নিয়েই বসে থাকবেন না, এরচেয়েও যেন ভালো হয় আগামীবার।’ ইতোমধ্যেই আমরা দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এবারকার ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে আগামীর প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করেছি।
প্রশ্ন : সৌদি আরবে হাজীদের থাকা-খাওয়াসহ নানা অভিযোগ যেসব এজেন্সির বিরুদ্ধে এসেছে, তাদেরকে কোনো শাস্তির আওতায় আনা হবে কি না?
শেখ মোহাম্মাদ আব্দুল্লাহ : প্রথম কথা হলো— হজ এজেন্সি কিন্তু একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তাদের মধ্যে দুই ধারার লোক রয়েছে। এজেন্সিদের এক অংশ মনে করেন— ‘আমি এর মাধ্যমে ব্যবসা করব ঠিক; তবে মূল উদ্দেশ্য হলো হাজীদেও খেদমত করা। যথাযথ খেদমত করার পর যা ব্যবসা হয়— তা আমার জন্য হালাল।’ আরেকটা অংশ মনে করে— ‘যারা হজ করতে যায়, তাদের কাছে টাকা-পয়সা আছে এবং অনেকেই গ্রাম থেকে আসায় তাদের সঙ্গে দুই নাম্বারি করা খুবই সহজ। তাই তাদের কাছ থেকে যত পারি টাকা চুষে নিব।’ এরা হজের কাজ সেবা ও সওয়াবের নিয়তে না কওে শুধু ব্যবসার নিয়তে করে। ফলে হাজীদের শত কষ্ট কিংবা সর্বনাশ হলেও তারা এটাকে গোনাহের কাজ মনে করে না।
এদের বিষয়ে আমরা শুরু থেকেই সতর্ক ছিলাম। তাই সব এজেন্সিকে কাজ করার সুযোগ দেইনি। যাদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে দুষ্টু প্রকৃতির কিছু এজেন্সি হয়তো ঢুকে গেছে। এবার হজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আমি প্রথম, তাই ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে কিছু দুষ্ঠু ঢুকে গেছে! তবে কথা দিচ্ছি— সামনেরবার তারা আর সুযোগ পাবে না। ইতোমধ্যেই আমাদের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে— তারা অপরাধীদের তালিকা করছেন। দায়ী এজেন্সি ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে সবরকমের ব্যবস্থা নেব ইনশাআল্লাহ। বিধিমালা অনুযায়ী যার যতটুকু শাস্তি প্রাপ্য— তা হবেই। কারও অর্থদন্ড হতে পারে, কেউ সাময়িক বরখাস্ত হতে পারে, কারও আবার লাইসেন্স বাতিলও হতে পারে।
প্রশ্ন : এবারের হজ ব্যবস্থাপনায় উল্লেখ করবার মতো কী কী সাফল্য অর্জন করেছেন বলে মনে হয়?
শেখ মোহাম্মাদ আব্দুল্লাহ : সাফল্য অর্জনের কিছু না। মূল হলো হজের মতো ফরজ একটি ইবাদত পালনে হাজীদের খেদমত করে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারা। আল্লাহর সাহায্যে উল্লেখ করার মতো এবারকার বড় কাজ হলো— হজের ফ্লাইট শিডিউল মিস না হওয়া, নিবন্ধিত সকল হাজী-ই হজ করতে পারা, ‘রোড টু মক্কা’ প্যাকেজের মাধ্যমে প্রায় অর্ধেক হাজীর ইমিগ্রেশন ঢাকাতেই সম্পন্ন করা এবং সৌদি আরবে হাজীদের লাগেজ বাসায়-হোটেলে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা। আরও একটি সাফল্য হলো— এ বছরই প্রথম বাংলাদেশের ৫৮ জন বিশিষ্ট আলেম-উলামা ও পীর-মাশায়েককে হাজীদের পরামর্শক হিসেবে হজে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি।
প্রশ্ন : বিভিন্ন ধারার ৫৮ জন বিশিষ্ট আলেমকে একত্রে হজে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো কিভাবে? এই উদ্যোগটা আসলে কার?
শেখ মোহাম্মাদ আব্দুল্লাহ : আমাদের দেশে নানা মত ও পথের আলেম রয়েছেন। তাদেরকে একত্র করা খুবই কঠিন। কিন্তু আল্লাহর বিশেষ রহমতে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দির্ক-নিদের্শনা ও মহামান্য রাষ্ট্রপতির আগ্রহে সম্মানিত আলেমদেরকে একসঙ্গে হজে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। হাজীরা যেন হজের নানাবিধ কার্যাদি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে শীর্ষ আলেমদের পরামর্শ ও নির্দেশনা নিতে পারেন— সে লক্ষ্যেই আলেমদেরকে নিয়ে যাওয়া। আর এ উদ্যোগটা প্রথমে আমি নিই এবং আলেম-উলামাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি-বর্গের কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাই। আলহামদুলিল্লাহ, কোনো একজন আলেমও আমাকে ফিরিয়ে দেননি। যাকেই প্রস্তাব করেছি, তিনিই দাওয়াত কবুল করেছেন। অনেকে নিজ থেকে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, তাকেও যেন এই কাফেলার সঙ্গে নেওয়া হয়। প্রথমে আমার চিন্তা ছিল ১০/১২ জন শীর্ষ আলেম নিয়ে যাওয়া। তাদেরকে দাওয়াত দিতে গিয়ে অন্যদের আগ্রহ দেখে পরামর্শের ভিত্তিতে বাধ্য হয়ে তালিকা বড় করতে হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ, তাদেরকে নিতে পেরে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। তারাও আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। আমি মনে করি— এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা যে, এতজন শীর্ষ আলেম একসঙ্গে হজে গিয়েছেন। জেনে খুশি হবেন— সৌদি আরবে এই আলেমদেরকে মক্কা-মদিনার হজ কর্তৃপক্ষ বিশেষ সংবর্ধনা দিয়েছেন— যা আমাদের দেশের জন্য বিরাট গৌরবের। এছাড়া আলেম-উলামাগণ হজ পালনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বাংলাদেশের মহান স্থাপতি জাতির জন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ গোটা দেশবাসীর জন্য দোয়া-মোনাজাত করে চোখের পানি ঝরিয়েছেন।