মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী— একজন আলেমেদ্বীন, লেখক-গবেষক ও বক্তা। আরবী, উর্দূ, ফারসী এবং ইংরেজি ভাষায় দক্ষ একজন স্কলার। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্বরত রয়েছেন। তরুণ আলেম-উলামাদের মিডিয়ামুখী হওয়া এবং মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জিনদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় নিয়ে ইসলাম প্রতিদিনের প্রতিনিধি ওয়ালি উল্লাহ সিরাজের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি।
তরুণ আলেমরা অনেকেই মিডিয়ার দিকে ঝুকছে। বিষয়টিকে আপনি অবশ্যই ভালো বলবেন। তবে আমি জানতে চাইবো মিডিয়াতে তাদের কাজ করার ক্ষেত্রগুলো কি কি?
শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী : সমাজ উন্নয়নে ও সমাজ পরিবর্তনে মিডিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। নবী রসূলগণ তাঁদের সময়কার মিডিয়া ব্যবহার করেই দাওয়াতী কাজ ও সমাজ সংস্কার করেছেন। নবী রসূলগণের উত্তরাধিকারী হিসেবে আলেম উলামাগণ সে দায়িত্ব পালনে সমকালীন মিডিয়ার সর্বোত্তম ব্যবহার করবেন এটাই স্বভাবিক। তারুন্য সফলতা ও বিজয়ের প্রতীক। তরুণ আলেমগণ সমাজ পরিবর্তন ও উন্নত সমাজ বিনির্মাণে ভুমিকা রাখবে এটাই কাঙ্খিত। এই কাজে মিডিয়া তাদের সহায়ক অস্ত্র। তাই মিডিয়ার সকল ক্ষেত্রেই তাদের কাজ করতে হবে। প্রিন্ট মিডিয়া বা অফ লাইন, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বা অনলাইন, সোস্যাল মিডিয়া বা সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গণমাধ্যম নির্বিশেষে সর্ক্ষেত্রেই সুদক্ষ পদচারণা থাকতে হবে। আজকাল মিডিয়া তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছে, এজন্য তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে বিজ্ঞতার স্বাক্ষর রাখতে হবে। যেমন: ইন্টারনেট, গুগুল, ফেইসবুক, ফেইসবুক পেইজ, ফেইসবুক গ্রুপ, টুইটার, ইনস্ট্রাগ্রাম; ইউটিউব, অনলাইন চ্যানেল, অনলাইন পোর্টাল ইত্যাদির ব্যবহার সতর্কতার সাথে সচেতনভাবে করতে হবে।
মিডিয়াতে যেই সকল তরুণ আলেমরা কাজ করতে আগ্রহী তাদের আসলে কি ধরণের যোগ্যতা অর্জন করা দরকার?
শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী : মিডিয়াকে যেহেতু সমাজ পরিবর্তন ও উন্নয়নের জন্য দাওয়াতী কাজের মাধ্যম হিসেবে নিতে হবে। প্রথমত: দাওয়াতী কাজের মূলধন হিসেবে কুরআন, সুন্নাহ, ফিকাহ এবং ইসলামী সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর প্রভুত জ্ঞান থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত: দাওয়াতের মূলনীতি ও পদ্ধতি জানা থাকতে হবে। যেমন: মহব্বত, আজমত, হিকমাত ও খিদমাতের গুণাবলী অর্জন করতে হবে। তৃতীয়ত: পর্যাপ্ত ভাষা জ্ঞান থাকতে হবে, একাধিক বিদেশী ভাষা জানা থাকলে ভালো। চতুর্থত: বিশ্বসভ্যতা, বিশ্বসাহিত্য ও বিশ্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকতে হবে। পঞ্চমত: সমকালীন বিশ্ব ও সমসাময়িক প্রচার মাধ্যমগুলোর সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখা।
মিডিয়াতে থেকে যেমন দ্বীনের কথা প্রচার করা যায় ঠিক তেমনই দ্বীনের কথা প্রচার করা যায় মসজিদের মিম্বার থেকে। আর এই দায়িত্ব মসজিদেরে ইমামগণ অনেক আগে থেকেই পালন করে আসছেন। আমি জানতে চাইবো বাংলাদেশের ইমামগণ দ্বীনের জন্য যে কষ্ট করেন সেই তুলনায় তাদের মূল্যায়নটা কেমন?
শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী : মসজিদের ইমামগণ মানবতার কল্যাণে সমাজ সেবায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেও আমাদের সমাজ তাদের সেভাবে মূল্যায়ন করতে পারেনি। এর বিবিধ কারণসমূহের মধ্যে রয়েছে এই ধর্মীয় ও আত্মিক সেবার জাগতিক মূল্য অনুধাবন করতে না পারা, এই সমাজ সেবার সামাজিক স্বীকৃতি না থাকা, এই কল্যাণ কাজের আর্থিক মূল্যায়ন না হওয়া। সর্বোপরি ইমামগণের জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা না থাকা এবং মানুষের করুণা ও দয়া-দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভরশীল হওয়া। পাশাপাশি ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও দক্ষতার অভাব এবং সমকালীন বিষয়ে অনগ্রসরতাও এ জন্য দায়ী। তাই ইমানগণের উচিৎ তাদের দূর্বলতাগুলো ঝেড়েফেলা এবং সমাজের কর্তব্য তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা। কারণ প্রত্যেকটি মসজিদের মিম্বার একটি মিডিয়া। প্রত্যেক খতিব-ইমাদের উচিত এই মিডিয়ার যথার্থ ও সৎ ব্যবহার নিশ্চিত করা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের একটি ভাতা চালু করার কথা বলেছেন, এই বিষয়ে আপনি কতটা আশাবাদি?
শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী : অত্যন্ত সুখের ও আনন্দের বিষয় যে, আমাদের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের তিন লক্ষ মসজিদের প্রায় দশ লক্ষ জনশক্তিকে (খতীব, পেশ-ইমাম, ইমাম, মুআজ্জিন ও খাদেমগণকে) মূল্যায়ন করার ঘোষণা দিয়েছেন। এ জন্য তাঁকে সাধুবাদ ও ধন্যবাদ জানাই। যারা আমাদের সমাজের এই সেরা সেবকগণকে এ যাবত মূল্যায়ন করতে পারেননি সেটা তাদের ব্যর্থতা। মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর এই ঘোষণা যথাযথ, এই সম্মান ও সম্মানী তাদের প্রাপ্য অধিকার। এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী আরেকটি নতুন মাইল ফলক রচনা করলেন। এটি তার বিজ্ঞতার পরিচায়ক। আমি আশাবাদি প্রধানমন্ত্রী খুব দ্রুত এটি বাস্তায়ন করবেন। আমি আরো বিশ্বাস করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যা বলেন, তা তিনি বাস্তায়ন করেন এবং এটি তাঁর পক্ষেই সম্ভব।
পৃথিবীর অনেক দেশেই ইমামরা নামাজ পড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসা বাণিজ্যের কাজে যুক্ত হন। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো এই ধরণের কালচার গড়ে ওঠেনি। এর কারণ কি ?
শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী : ইমাম মানে নেতা। ইমাম ধর্মীয় ও সামাজিক সকল ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিবেন, এটা তার দায়িত্ব। দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজন যথাযথ যোগ্যতা; আর ইমামগণ মসজিদে ইমামতি করার পর্যাপ্ত যোগ্যতা অর্জন করেছেন বিধায় এই দায়িত্ব নির্বিঘ্নে পালন করে যাচ্ছেন; কখনো কোনো মুসল্লী বা মসজিদের সভাপতি সেক্রেটারী ইমামের সামনে ইমামতি করার দুঃসাহস দেখায় না। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় সামাজিক নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব সম্পর্কে আমাদের সমাজে অনেক ইমামগণই সচেতন নন। তাই এজন্য যেসকল যোগ্যতা ও গুণাবলী বা সামর্থ থাকা দরকার অনেক ইমামগণই সে বিষয়ে উদাসীন। তবে বর্তমানে এ অবস্থার পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। আশা করি অদূর ভবিষ্যতে ইমামগণ আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ও স্বাবলম্বী হয়ে নিজ পায়ে দাড়াবেন এবং প্রকৃত ইমাম হিসেবে সমাজে যথাযথ ইমাম বা নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করে উন্নয়ন, কল্যাণ ও শান্তির সমাজ বিনির্মাণে অবদান রাখবেন।