সাক্ষাৎকার

চিকিৎসাসেবা শুধু ব্যবসা নয়, মানুষের দোয়া পাওয়ার মাধ্যমও : অধ্যাপক মতিয়ার রহমান

ল্যাপারোসকপিক যন্ত্রের দ্বারা পিত্তথলি পাথর অপারেশনে দেশসেরা ও বিশ্ববিখ্যাত অভিজ্ঞ সার্জন হচ্ছেন অধ্যাপক মো. মতিয়ার রহমান। তিনি একজন সমাজসেবক এবং একজন কুরআন গবেষকও। বর্তমানে তিনি ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া ইনসাফ বারাকাহ কিডনি এন্ড জেনারেল হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, দি বারাকাহ ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান এবং কুরআন রিসার্চ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।


https://youtube.com/watch?v=bfmLB7nAo3E


খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার আরজি-ডুমুরিয়া গ্রামের এক ধার্মিক পরিবারে মতিয়ার রহমানের জন্ম। নিজ গ্রামের কওমি মাদরাসায় তার শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়। মাদরাসায় ছয় বছর পড়ার পর ডুমুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন তিনি। ১৯৬৮ ও ১৯৭০ সালে যথাক্রমে ডুমুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও খুলনার দৌলতপুর সরকারি বিএম কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করেন। এরপর ১৯৭৭ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন।সরকারি চাকরিতে যোগদানের পর ১৯৭৯ সালে ইরাক চলে যান তিনি এবং ইরাকের জেনারেল হাসপাতালে সার্জারি বিভাগে চার বছর চাকরি করেন। এরপর তিনি উচ্চ শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে যান এবং ১৯৮৬ সালে গ্লাসগো রয়েল কলেজ অব ফিজিসিয়ানস এন্ড সার্জনস থেকে সার্জারিতে এফআরসিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ইংল্যান্ডে রেসিডেন্ট পারমিট থাকলেও তা ত্যাগ করে তিনি ১৯৮৭ সালে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৮৮ সালে তিনি ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল ইনিস্টিটিউট হাসপাতালে সার্জারি বিভাগের কনসালটেন্ট হিসেবে যোগ দান করেন। কুরআন গবেষণা এবং লেখালেখি করা মতিয়ার রহমানের একটি বিশেষ গুণ। ইসলামের নানান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর এখন পর্যন্ত তার লেখা ৩৩টি গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তন্মধ্যে ‘মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য’, ‘নামাজ কেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে?’, ‘মুমিনের এক নাম্বার কাজ এবং শয়তানের এক নাম্বার কাজ’, ‘আল্লাহর ইচ্ছায় সবকিছু হয় কথাটির প্রকৃত ব্যাখ্যা’, ‘তাকদীর (ভাগ্য!) পূর্বনির্ধারিত তথ্যটির প্রচলিত ও প্রকৃত ব্যাখ্যা’, ‘Common sense-এর গুরুত্ব কতটুকু এবং কেন’, ‘অমুসলিম পরিবার ও সমাজে মানুষের অজানা মুমিন ও বেহেশতী ব্যক্তি আছে কি?’ ইত্যাদি সাড়া জাগানো গ্রন্থ। ‘আল কুরআন যুগের জ্ঞানের আলোকে অনুবাদ’ গ্রন্থের প্রধান সম্পাদক তিনি। এ ধরনের অনুবাদ পৃথিবীতে প্রথম। পড়াশুনা, চাকরি এবং আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনারে যোগ দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশে সফর করেছেন গুণী এই চিকিৎসক। চিকিৎসাসেবা ও ব্যবসা, চিকিৎসা বিজ্ঞান ও ইসলাম এবং বর্তমান সময়ের চিকিৎসা ও হাসপাতাল ব্যবসার নানা দিক ও বিষয় নিয়ে তিনি প্রিয়.কম-এর সঙ্গে কথা বলেছেন।প্রিয়.কম: হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি আপনার তত্ত্বাবধানে সমাজসেবামূলক, জনহিতকর ও দাওয়াহ ভিত্তিক আর কী কী কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে?

অধ্যাপক মো. মতিয়ার রহমান: হাসপাতালও মূলত একটি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। আমাদের প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালগুলো মূলত সেবা প্রদানের মানসিকতা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া কুরআন রিসার্চ ফাউন্ডেশন নামে আমাদের একটা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আমি মনে করি, শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি মুসলমানদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কারণ যে কুরআন হাতে নিয়ে মাত্র ৫০০ থেকে ৭০০ বছর পূর্বে মুসলিম জাতি পৃথিবীর অন্য সকল জাতির চেয়ে জীবনের সকল দিকে শ্রেষ্ঠ ছিল, সে কুরআন অক্ষরে অক্ষরে অপরিবর্তিত আছে। কিন্তু মুসলিম জাতি আজ জীবনের প্রায় সকল দিকে অন্য জাতিদের চেয়ে অবিশ্বাস্য রকমভাবে পিছিয়ে রয়েছে। এ কথা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে মুসলিম জাতি কুরআনের প্রকৃত শিক্ষা থেকে বহু দূরে। জ্ঞানে ভুল থাকলে কাজেও ভুল হবে, এটি চিরসত্য কথা। কুরআনই হলো মুসলিম জাতির জ্ঞানের মূল ভিত্তি। এ গ্রন্থে মানব জীবনের যত দিক আছে তার প্রত্যেকটির মূল কথাগুলো লেখা আছে। তাই কুরআনের শিক্ষাকে ভিত্তি করে মুসলিম জাতি যদি তাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে না সাজায়, তবে এ জাতি কখনও বিশ্ব দরবারে তাদের হারানো স্থান ফিরে পাবে না। এ লক্ষ্যে আমরা শিক্ষাবিষয়ক বেশ কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করেছি; যার অন্যতম একটি হলো- কুরআন রিসার্চ ফাউন্ডেশন। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা কুরআন নিয়ে গবেষণা ও দাওয়াহ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি। কুরআনের সঠিক তথ্যগুলো আমরা কুরআন, সুন্নাহ ও কমনসেন্সের আলোকে মানুষকে শেখানোর চেষ্টা করি। এ ছাড়া দি বারাকাহ ফাউন্ডেশন নামে সমাজ কল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনাকারী একটি প্রতিষ্ঠানও আমাদের রয়েছে।

প্রিয়.কম : আপনি কেন একজন ডাক্তার হলেন? ডাক্তারি পেশায় আসার নেপথ্যে আপনার মূল প্রেরণাটা কী ছিল?

মো. মতিয়ার রহমান: ছাত্র জীবনে আমি অঙ্কে বেশ ভালো ছিলাম। তাই আমার ইচ্ছা ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ব। এই লক্ষ্যে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করে ভর্তিও হয়েছিলাম। কিন্তু আমার মা-বাবা ও শিক্ষকরা বললেন, তুমি মেডিকেল সায়েন্স নিয়ে পড়ো। তাদের কথা মান্য করতে গিয়েই আমি মেডিকেলে ভর্তি হলাম। মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পরে চিকিৎসাসেবার প্রতি আমার বেশ আগ্রহ জন্মে গেল। কারণ আমি দেখলাম, চিকিৎসার মাধ্যমে যেভাবে মানুষের সরাসরি কল্যাণ বা সেবা করা সম্ভব হয়, সেটা অন্য কোনো পেশার মাধ্যমে সম্ভব না। আর চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে মানুষের সরাসরি দোয়া পাওয়া যায়। তাছাড়া এই পেশার মাধ্যমে সৎভাবে ভালো উপার্জনও করা সম্ভব। মানুষের সম্মান পাওয়া যায় এবং সমাজে ভালো একটা অবস্থানও তৈরি হয়ে যায়। সবদিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, চিকিৎসা পেশা অত্যন্ত সুন্দর একটি পেশা। মূলত এই সব কারণ বিবেচনা করেই আমি ডাক্তার হয়েছি।

প্রিয়.কম: আপনি একজন ডাক্তার হয়েও কুরআন রিসার্চ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করলেন কেন?

মো. মতিয়ার রহমান: ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন পাশ করার পরে আমি ইরাকে গিয়েছিলাম। সেখানে চার বছর ছিলাম। সেখানকার ভাষা আরবি। চার বছর রোগীদের সাথে কথা বলতে বলতে আরবি ভাষার ওপর আমার কিছুটা দখল তৈরি হয়ে যায়। আমি যদিও ছোটবেলা মাদরাসায় কিছুটা পড়েছি, কিন্তু আরবি ভাষা ততোটা শেখা হয়নি। দেশে ফিরে আসার পরে আমার মধ্যে একটা চেতনা তৈরি হয়, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা যদি জিজ্ঞেস করেন- তুমি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হওয়ার জন্যে ইংরেজি ভাষা শিখে বড় বড় বই পড়েছ কিন্তু তোমার জীবন পরিচালনার গাইডলাইন ধারণকারী আরবিতে লেখা যে কুরআন আমি দিয়েছি, তা কি তুমি বুঝে পড়েছিলে? তখন আমি কী জবাব দেবো। আমি তখন কুরআনের তাফসির পড়া শুরু করলাম। কুরআনের তরজমা ও তাফসির পড়তে গিয়ে দেখি- ইরাকে সাধারণ আরবরা যে আরবিতে কথা বলত, তার অনেক শব্দ কুরআনে আছে এবং আমি তা বুঝতে পারি। তখন আমি কুরআন পড়তে বেশ মজা পাই। কুরআন পড়তে গিয়ে আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, আল্লাহ তায়ালা কুরআনের প্রথম যে আয়াতটি নাজিল করেছেন, তা হলো জ্ঞান অর্জন করার আদেশ। এরপরে দ্বিতীয় আয়াতটিতেই তিনি মেডিকেল সায়েন্সের কথা বলেছেন। আপনি দেখুন, আল্লাহ তায়ালা সূরা আলাকের প্রথম আয়াতে বলেছেন, ‘পড়ো, তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’। এখানে কিন্তু কোনো সাবজেক্ট বলা হয়নি, কেবল জ্ঞান অর্জন করতে বলা হয়েছে। দ্বিতীয় আয়াতে তিনি বলছেন, ‘যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ‘আলাক’ থেকে’। এখানে Human Embryology মেডিকেল সায়েন্সের কথা আলোচিত হয়েছে। অর্থাৎ কুরআনের প্রথম বিষয়ভিত্তিক আলোচনা হলো মেডিকেল সায়েন্স নিয়ে। তাই আমার মনে হলো, নিশ্চয়ই চিকিৎসা বিজ্ঞান কুরআন বোঝার জন্য সহায়ক একটি বিষয়। আমি যখন কুরআন পড়ি, কুরআনের অর্থ নিয়ে গবেষণা করি, তখন দেখি মেডিকেল সায়েন্সের সাথে কত অপূর্ব মিল! চিকিৎসা বিজ্ঞানে আমরা যা পড়েছি, একই কথা আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন। যার কারণে কুরআন পড়ে আমি অভাবিত আনন্দ লাভ করি এবং সেই শিক্ষকদের জন্যে দোয়া করি, যারা আমাকে তখন মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কুরআনের তাফসির পড়া শেষ হলে আমি অবাক হয়ে দেখতে পাই মুসলিম সমাজে যেসব কথা চালু আছে, তার অনেক কিছু কুরআনের সরাসরি বিপরীত। তাই আমি লিখতে শুরু করি। আর কুরআনের গবেষণা ও প্রচারের লক্ষ্য নিয়ে কুরআন রির্সাচ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করি।

প্রিয়.কম: সম্পূরক একটা প্রশ্ন করি, বাংলাদেশের যেসব প্রতিষ্ঠানে কুরআন পড়ানো হয় বা গবেষণা করা হয়, আপনি কি মনে করেন, কুরআন বোঝার জন্যে মেডিকেল সায়েন্সের কিছু বিষয়ও তাদের সিলেবাসে যুক্ত করা দরকার?

মো. মতিয়ার রহমান : হ্যাঁ, এটা অত্যন্ত প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। মেডিকেল সায়েন্সের কিছু বিষয় যদি তাদের সিলেবাসে যুক্ত করা হয়, তাহলে তাদের কুরআন বুঝতে সুবিধা হবে। শুধু কুরআন কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানে নয়, আমি মনে করি, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এসএসসি বা ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত আমরা যেমন বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক ও সাধারণ বিজ্ঞান সম্পর্কে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করি, তেমনি মেডিকেল সায়েন্স সম্পর্কেও কিছু বেসিক জ্ঞান সবাইকে শিক্ষা দেওয়া দরকার। কারণ অন্যান্য বিষয়ের মতো মেডিকেল সায়েন্সের বিষয়টাও আমাদের জীবনের সাথে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত এবং মেডিকেল সায়েন্স কুরআন বুঝার জন্য বিশেষভাবে সহায়ক।

প্রিয়.কম: স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাখাতকে বর্তমান সময়ের একটি ঝুঁকিমুক্ত ব্যবসা খাত বলা হয়। অনেকেই বলেন- যদি ঝুঁকিমুক্ত ব্যবসা করতে চাও, তাহলে কোনো হাসপাতাল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করো। একজন চিকিৎসক হিসেবে বা একজন চিকিৎসা ব্যবসার কর্ণধার হিসেবে এই মন্তব্যকে আপনি কীভাবে দেখেন?

মো. মতিয়ার রহমান: আমি মনে করি, যদি আপনি যে কোনো ব্যবসা সৎভাবে করেন, তবে সেখানে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা কম। তা ছাড়া আমাদের দেশে জনসংখ্যা অনেক বেশি, আবহাওয়া ও পরিবেশের কারণে এ দেশের মানুষের রোগব্যাধিও বেশি হয়। সুতরাং কেউ যদি যথাযথ সেবার মানসিকতা নিয়ে এই সেক্টরে ব্যবসা করে, তাহলে বিফল হওয়ার সম্ভাবনা অবশ্যই কম থাকবে। তবে রিস্ক যে একেবারে নেই, তা কিন্তু বলা যাবে না। এ দেশে অনেক হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যাওয়ার নজিরও রয়েছে। মূলত চিকিৎসা এবং শিক্ষার চাহিদা বেশি থাকার কারণেই এই সেক্টরে ব্যবসার সম্ভাবনা বেশি।

Comment

লেখক পরিচিতি

আবদুল্লাহ মারুফ

আমি আবদুল্লাহ মারুফ। বর্তমানে অধ্যয়নরত আছি আল বায়ান অ্যারাবিক লানিং সেন্টারে। পাশাপাশি নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি হেরার জ্যোতি ও মাসিক ঘাসফড়িঙ -এর। পড়াশুনা, লেখালেখি আর ঘুরে বেড়ানো এই আমার ছোট্ট জীবন। ইসলাম প্রতিদিনের সাথে আছি কন্ট্রিবিউটিং রাইটার হিসেবে।

কমেন্টস করুন