পবিত্র আশুরা— ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিবস। ইসলামিক পঞ্জিকা অনুযায়ী মুহাররম মাসের দশম দিনকে আশুরা বলা হয়। ইসলাম ধর্ম অনুসারীদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন এই আশুরা। আশুরা শব্দটি আরবী শব্দ ‘আশারা’ থেকে নেয়া হয়েছে। এর অর্থ ১০। মুহাররম মাসের দশম দিন হওয়ার একে আশুরা বলা হয় বলে অনেক ইসলামি স্কলার মন্তব্য করেছেন। বাংলাদেশেসহ বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে ঘটা করে পবিত্র আশুরা দিবস পালন বা উদযাপন করা হয়। এ দিবসটি নিয়ে আমাদের মুসলিম তরুণ-তরুণীদের ভাবনা ও মতামত নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন ইসলাম প্রতিদিনের সহ-সম্পাদক জাহিদ হাসান মিলু
১. তাহমিরুল ইসতিয়াক
ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আশুরা পালন আজকাল আমাদের কারো কারো কাছে কুসংস্কারের ছাদরে ঢাকা ছাওনি আবার কারো কারো কাছে মহাপবিত্র একটি বিষয়। এ দিবসে প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর কলিজার টুকর হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত ঘটে। আর এ বিষয়কে যদি কেন্দ্র করে এগিয়ে যাই তাহলে এটা একটা শোকাবহ দিন। আর এ দিনে দেখা যায় সারা পৃথিবী জুড়ে মুসলিম সমাজে রোজা রাখা ও ভালো খাওয়া দাওয়ার বিধান প্রচলিত এবং রাস্তায় রাস্তায় নেচে নেচে ‘হায় হুসাইন, হায় হুসাইন! ‘ সুর মিলিয়ে গান গাইতেও শোনা যায়। আসুন এ প্রসঙ্গে একটু আমার অব্জার্ভাভেশনটা বলি— আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের একজন ছাত্র। গ্রাম থেকে উঠে এসেছি তাই আশুরা হলো আমার কাছে জাস্ট রোজা রাখাটাই। আমরা হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত স্বরণে রোজা রেখে শোক পালন করে দুয়া করি। আর যেন তার ওছিলায় হলেও আল্লাহ আমাদের জান্নাত দেন। আসল কথা বলি— ‘আমার একটা টিউশনি আছে চকবাজারে। আমি নাজিমুদ্দিন রোড দিয়ে হেঁটে টিউশনিতে যাই। প্রতিদিনের মতো আজও যখন যাচ্ছিলাম তখন রোডে গাড়ি ঘোড়া অফ দেখলাম প্রচুর লোকজন হাতে ইয়া বড় বড় লাঠি হাতে নিয়ে বুকে থাপ্পড় মারছে আর দৌড়াচ্ছে আর বলছে ‘হায় হুসাইন’ । কেমন যেন গীতিকার সভা। প্রথমে শঙ্কিত হয়ে পরে নির্ভিকচিত্তে এক ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম ভাই এগুলা কি? সে বললো, হুসাইনি স্বণন আই মিন আশুরা। আর ভাই রাস্তায় মেয়ে আর মহিলাগুলো পাশ দিয়ে লাইন ধরছে। দেখছে কি করে সাধারণ জনগনের হাটারও জায়গা নাই৷। কে কার উপর পড়ছে ঠিক নাই। কোনো মতে শত শত মানুষ ধাক্কিয়ে বের হলাম৷ তাহলে কি আশুরা এটাই? নাচ-গানের মাধ্যমে কি শোক পালন করা হয়? তাও আবার নারী-পুরুষের সংমিশ্রণে? আমরা কি আমাদের মহাপবিত্র দিনটাকে এভাবে কলুষিত করছি না? আসুন নিজেদের মধ্যে সচেতনতাবোধ জাগাই। হৃদয়ের গহীন থেকে ইসলাম মেনে দিনটি পালন করি৷ পালন হোক আশুরা সুন্দর ও সাবলীল ভাবে। নিপাত যাক কুসংস্কারের ঢাল। গুনাহ থেকে মুক্তি পাক মানুষ। হৃদয়ের বাণী ছুয়ে যাক মনের সুর, সুষ্ঠ ইসলামি চিন্তা এগিয়ে যাক বহুদুর। আমিন।
২. মেহেদি হাসান
অর্থনীতি বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।
ইসলামিক মতে আশুরার দিনের গুরুত্ব অনেক, তদ্রূপ বাংলাদেশেও দিনটি গুরুত্বের সহিত পালিত হয়। কিন্তু ইসলামের আদেশকৃত পথে পালনের পাশাপাশি অনেক বিদআতে লিপ্ত হয়ে থাকে । যেমন, হাসান-হোসেনের মৃত্যুর জন্য কষ্ট পেয়ে নিজেকে ছুরিকাঘাত করা, মাতম করা , কবরের রেপ্লিকা নিয়ে মিছিল করা ইত্যাদি। এই বিষয়গুলো ইসলাম যেমন নিষেধ করে তেমনি আমার কাছেও দৃষ্টিকটু। আশুরার গুরুত্ব নবী (সা.) আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। কিভাবে আশুরা পালন করতে হয়, তিনি আমাদেরকে সেটি শিখিয়ে দিয়েছেন । তাই নবীর দেখানো পথ অনুসরণ করে আশুরা উপলক্ষে দুই দিন রোজা রাখাই শ্রেয়। আমি আশা করি আমরা আশুরার মত পবিত্র দিনে বিদআত থেকে মুক্ত হয়ে নবীর (সা.) দেখানো আমল করব।
৩. সুমাইয়া ঐশী
ইন্সটিটিউট অব হেল্থ ইকোনমিক্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আশুরা মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় দিন। মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, এইদিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল যার মধ্যে সবচে গুরুত্বপূর্ণ ছিল হজরত মুসা (আ.)-এর ফিরাউনকে পরাজিত করা। বর্তমানে শিয়া সম্প্রদায়ে আশুরাকে একটা উৎসবের দিন হিসেবে পালন করে এবং এর পিছনে কারণ হিসেবে নবীজী (সা.) -এর নাতি হজরত হোসাইনকে (রা.) হত্যার ঘটনা তুলে ধরা হয়। শিয়া সম্প্রদায় এদিনে ‘খাটিয়া মিছিল’ নিয়ে বের হয়, সিন্নি বিলি করে, বুক চাপড়ে মাতম প্রকাশ করে, যা নবী করিম (সা) -এর দেয়া সংযমের শিক্ষার পরিপন্থী। এছাড়া নবীজি (সা.) কখনো কারো জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন করেননি। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশের সাধারণ মুসলিমদের মাঝেও আশুরার গুরুত্ব ও ইবাদত সম্পর্কে একটা ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হচ্ছে। আল্লাহ আমাদেরকে সকল ভুল-ভ্রান্তির পথ থেকে দূরে রাখুন।
৪. রিয়াজ হাসান
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
৬৮০ সালের ১০ মহররমে কারবালার প্রান্তরে হোসাইন (রা.)-এর শহীদ হওয়ার যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে; মূলত সেটাকে কেন্দ্র করেই সারা বিশ্বে আশুরা পালিত হয়ে থাকে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই মুহাররম মাসে ইসলামের ঐতিহাসিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। তাই এই মাসের মর্যাদা অনেক। হুজুর (সা.) আশুরার রোজা রাখার ফজিলত সম্পর্কে আমাদের জানিয়েছেন। আমাদের উচিত হবে সঠিক পন্থায় এটাকে পালন করা। আমরা দেখি সারা বিশ্বে এটাকে এমন কিছু কাজের মাধ্যমে পালন করা হয়ে থাকে; যার সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের দেশেও কিছু সম্প্রদায়ের মানুষ এটাকে নোংরাভাবে পালন করে। তাছাড়া আশুরাকে কেন্দ্র করে কিছু কুসংস্কারও আমাদের সংস্কৃতিতে প্রবেশ করেছে বহু আগে। যার মাধ্যমে আশুরার পবিত্র ফজিলত থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত তো হচ্ছেই, এমনকি মাঝে মাঝে কবিরা গুনাহ এবং শিরকের মতো বড় গুনাহ করে ফেলছে। এটা প্রতিকার করতে চাইলে আলেম সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সবার মাঝে বিশুদ্ধ জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে হবে।
৫. উমাইয়া তূর্ণা
ওম্যান অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমি কিভাবে দেখি বলতে, আমি জানি মুহাররমের ১০ তারিখে আশুরা। নানুর থেকেই শুনছিলাম এই দিনে নবী করিম (সা.) রোজা রাখতো, হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছিল। এছাড়া এই দিনে ইমাম হোসাইন (রা.) কারবালার প্রান্তরে শহীদ হয়েছিল। ছোটবেলা থেকে দেখছি আমার আশেপাশের মুরুব্বিরা এই আশুরার দিনে রোজা রাখের কিন্তু আমার নানু ২ দিন রোজা রাখতেন। অনেক জায়গায় এই দিনে ইমাম হোসাইনের শহীদ হওয়ার উপলক্ষে শোক পালন করা হয়, বিশেষ করে শিয়ারা করে। অনেকে দোয়া করায় মসজিদে এগুলোই জানি। কিন্তু আশুরার দিনে এই শরীরে ছুড়ির মতো কি একটা দিয়ে শিয়ারা আঘাত করে রক্ত বের করে— এটা আমি ঠিক বলে মনে করিনা। আর এই দিনে শোক পালন করাটাকেও উচিত বলেেআমার মনে হয় না।
৬. মোসাদ্দেক বিল্লাহ
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আশুরা তথা ১০ মুহাররম মুসলিম জাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে বিবেচিত। ইসলামের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এ দিনে সংঘটিত হয়। বাংলাদেশে আশুরা উদযাপনের বাহ্যিক বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। আশুরা উদযাপনের তিনটি বিষয় হাদীসের পাওয়া যায়— ১. রোজা রাখা। ২. পরিবারে ভালো খাবারের আয়োজন করা। ৩. নবী করীম (সা.) -এর পরিবারের প্রতি দোয়া পাঠ করা। কিন্তু বাংলাদেশে তাজিয়া মিছিল, শরীরের বিভিন্ন জায়গা রক্ত বের করা ইত্যাদি কুসংস্কারের মাধ্যমে আশুরা পালন করা হয়, যা ইসলামের দৃষ্টিতে মোটেও ঠিক নয়। হাদীসের উল্লেখিত বিষয়ের পাশাপাশি বিশ্ববাসীর জন্য দোয়া ও কল্যাণ কামনায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক পবিত্র আশুরা।
৭. আফসার মুন্না
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমাদের দেশে একদল লোক আশুরাকে কিছু ভালো খাওয়ার মাঝে সীমাবদ্ধ করেছে আর অন্যদল গায়ে ছুরিকাঘাতকে এই দিনে পালনীয় করে নিয়েছে। এর কোনটিই যৌক্তিক নয়।
বরং ইবাদতের মাধ্যমে এই দিনকে পালন করার পাশাপাশি সারা বছর ইবাদত চালু রাখাই এই দিনের শিক্ষা হওয়া উচিত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এই দিনের প্রতিপাদ্য হওয়া উচিত।
৮. প্রমি জান্নাত
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
যদিও আমি ধর্ম সম্পর্কে পর্যাপ্ত জানিনা, তবে বাংলাদেশে শিয়াদের আশুরা পালন নিয়ে আমার মাঝে পজিটিভ কোনো ধারণা নেই। অনেক আলেমের মতেই আশুরা পালন বিদআত।
রাসুল (সা.) জীবিত থাকতেই আমাদের ধর্ম ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এখানে আর কিছু বাড়তি সংযোজন বা বিয়োজনের কিছু নেই।
এক কথায় রাসুল (সা.)-এর মৃত্যুর পর কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাড়তি কোনো বিধান আবিষ্কারের পক্ষপাতিত্বে আমি নই।
৯. সাঈদ মাহমুদ সোহরাব
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
হাদিস শরীফে মহররমের ১০ তারিখ একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ইসলামের বিশেষ বিশেষ ঘটনাবলীর অধিকাংশই এ দিনে সংঘঠিত হয়৷ তবে নবী (সা.) -এর ওফাতের পর কারবালার যুদ্ধকে ঘিরে দিনটির গুরুত্ব ভিন্নদিকে রূপায়িত হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুসলিম উম্মাহ শিয়া-সুন্নি নামে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
শিয়ারা দিনটিকে শোকের দিবস হিসেবে শারীরীক কষ্ট সহ্য করে অশ্রু বিসর্জনের মধ্য দিয়ে পালন করে। অন্যদিকে সুন্নি মুসলিমরা হাদিসের অনুসরণে সিয়াম পালনের মাধ্যমে কারবালার সে শোকাবহ দিনগুলোর স্মরণ করে।
১০. মো. আব্দুল্লাহ
তাকমীল, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া, যাত্রাবাড়ী
হযরত আলীকে (রা.) এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমজানের পর আর কোন মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোজা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসুলের (সা.) নিকট জনৈক সাহাবী করেছিলেন, তখন আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, ‘রমজানের পর যদি তুমি রোজো রাখতে চাও, তবে মুহররম মাসে রাখ। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তাআলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন। (জামে তিরমিযী ১/১৫৭) এ হাদিসের আলোকে আমি মনে করি এ মাসের করণীয় বিষয়গুলো হলো— তওবা-ইস্তেগফার, নফল রোজা এবং অন্যান্য নেক আমল। এসব বিষয়ে যত্নবান হওয়া এবং সব ধরনের কুসংস্কার ও গর্হিত রসম-রেওয়াজ থেকে বেঁচে কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক চলাই মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।