বিশ্বে ইসলামী স্থাপত্যের বহু নিদর্শন রয়েছে। ইসলামী সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর মধ্যে মুসলিম স্থাপত্য অন্যতম। মুসলমানরা বিশ্বে এমন বহু নিদর্শন তৈরি করেছেন, হাজার হাজার বছর পরেও যা ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। বিখ্যাত মুসলিম স্থাপত্যগুলো শিল্প ও চারুকলা এবং স্থাপত্য ও অলঙ্করণকলার বিবেচনায় অতুলনীয়। প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণপিপাসু মানুষদের পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নেয় এসব স্থাপনা। বিশ্ববিখ্যাত ভ্রমণগাইড ওয়েবসাইট ট্রিপঅ্যাডভাইজার, পান্ড্রোট্রিপ ও লনিপ্লানেট অবলম্বনে বিশ্বসেরা ১০টি মুসলিম স্থাপত্য নিয়ে সেরা দশের আজকের প্রতিবেদন।
১. শেখ জায়েদ গ্রান্ড মসজিদ (আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত) : সংযুক্ত আরব আমিরাতের সবচেয়ে বড় মসজিদ এবং এটি বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম ও সুন্দরতম মসজিদ। সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রয়াত রাষ্ট্রপ্রধান শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানের নামানুসারে মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছে। মসজিদের নকশা নির্মাণে মার্বেল পাথর, মূল্যবান স্ফটিক পাথর ও মৃৎশিল্প ব্যবহƒত হয়েছে। লাখ লাখ স্বচ্ছ পাথরে তৈরি বিশ্বের বৃহত্তম ঝাড়বাতিটি এই মসজিদে স্থাপিত রয়েছে। সারা বিশ্বের মুসলিম-অমুসলিম পর্যটকদের কাছে এই মসজিদটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। এটি একটি দর্শনীয় স্থান ও স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত।
২. দ্য আল হাম্বরা (আন্দালুসিয়া, স্পেন) : এটি মূলত একটি প্রাসাদ এবং একই সঙ্গে জটিল দুর্গ। স্পেনের আন্দালুসিয়ার গ্রানাডায় দ্য আল হাম্বরা অবস্থিত। তেরো শ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে স্পেনের মুসলিম নাসরি রাজবংশের শাসনামল চলাকালে অনিন্দ্যসুন্দর এই প্রাসাদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। সৌন্দর্যে ভরা প্রাসাদটির ভেতরে রয়েছে বাগান, ঝরনা ও চমৎকার শিল্পসম্মত অলঙ্করণ। ১৯৮৪ সালের ২ নভেম্বর ইউনেস্কোর বিশ্বঐতিহ্যবাহী স্থান নির্বাচন কমিটি আল হাম্বরাকে মানবতার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে মর্যাদা দেয়। আল হাম্বরা প্রাসাদটির নামের উৎপত্তি নিয়েও অনেক গল্প প্রচলিত আছে।
৩. নাসির আল মুলক মসজিদ (শিরাজ, ইরান) : ইরানের শিরাজে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী মসজিদ নাসির আল মুলক মসজিদ। মসজিদটি গোলাপি মসজিদ নামেও বেশ পরিচিত। এটি ১৮৮৮ সালে নির্মিত। মসজিদ নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে রঙিন গ্লাসের অলঙ্কার। একটি বিশেষ আয়োজন এবং যখন এই জানালার মধ্য দিয়ে সূর্যের আলো প্রবেশ করে, তখন পুরো মসজিদটি গোলাপি রঙিন আভায় পূর্ণ হয়ে যায়। মূলত এ কারণেই মসজিদটি গোলাপি মসজিদ নামেও পরিচিত। ইরানি স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই মসজিদ ইরানসহ গোটা মুসলিম বিশ্বের অন্যতম সুন্দর একটি মুসলিম স্থাপত্য নিদর্শন।
৪. সুলতান আমির আহমদ বাথহাউস (কাশান, ইরান) : সুলতান আমির আহমদ বাথহাউস কুয়েসি বাথহাউস নামেও পরিচিত। এটি ইরানের ঐতিহ্যবাহী গোসলখানা, যেটি সাধারণ মানুষের জন্য উš§ুক্ত। এটি কাশানে অবস্থিত। ষোড়শ শতাব্দীতে এটি নির্মিত হয়। তবে ১৭৭৮ সালে ভূমিকম্পে এটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে আবার নির্মাণ করা হয়। ১ হাজার বর্গমিটারের এই গোসলখানা দুই ভাগে বিভক্ত। একটি পোশাক পরিবর্তনের জন্য; অন্যটি গরম পানিতে গোসল করার স্থান। মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের এক অনন্য স্থাপনা এই গোসলখানা। এতে ব্যবহƒত বেশিরভাগ টাইসলই হচ্ছে নীলকান্তমণি ও স্বর্ণখচিত। আশ্চর্য ও অলঙ্কারময় টাইলস দিয়ে সুসজ্জিত এই গোসলখানাটি বর্তমানে একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। এই স্থাপত্যটি জাতীয় ও ঐতিহাসিকভাবে খ্যাতিলাভ করেছে।
৫. মন্তাজা প্যালেস (আলেকজান্দ্রিয়া, মিসর) : আলেকজান্দ্রিয়া মিসরের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এবং এই শহরেই মিসরের বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর অবস্থিত। প্রাচীনকালে এই শহরটি বাতিঘর (প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের একটি) এবং গ্রন্থাগারের (প্রাচীন সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগার) জন্য বিখ্যাত ছিল। আলেকজান্দ্রিয়ার নামকরণ করা হয়েছে এর প্রতিষ্ঠাতা আলেকজান্ডার দি গ্রেটের নামানুসারে। ইতিহাসবেত্তা অ্যারিয়ানের বর্ণনায় আলেকজান্ডার কিভাবে শহর তৈরির প্রাথমিক পরিকল্পনা করেছিলেন তা জানা যায়। আলেকজান্ডারের ভবিষ্যৎ দ্রষ্টারা কিছু পূর্ব লক্ষণ বিবেচনা করে বলেছিলেন যে এই শহর ব্যাপক উন্নতি করবে। এখানে রয়েছে মন্তাজা প্রসাদ। মুসলিম স্থাপত্য নিদর্শনের অন্যতম একটি স্থাপনা এই মন্তাজা প্রাসাদ। এটি নির্মিত হয়েছে ১৯৩২ সালে। রাজা ফুয়াদ কর্তৃক নির্মিত একটি গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ হিসেবে এটি পরিচিত। এই স্থাপত্যটি ভূমধ্য সাগরের তীরে অবস্থিত। প্রাসাদের স্থাপত্যকলা তুর্কি এবং ফ্লোরেনটাইন কারুশৈলী দ্বারা সজ্জিত। প্রাসাদের রাজপথ এবং বিস্তৃত রাজকীয় বাগানগুলি সবার জন্য উন্মুক্ত। যে কেউ চাইলেই এখানের মনোরম পরিবেশে সময় কাটাতে পারবেন। জায়গাটি সকলের জন্য উন্মুক্ত। এখানে প্রচুর দর্শনার্থী ভীর করেন।
৬. চেফচাওয়েন টাউন (চেফচাওয়েন, মরক্কো) : মরক্কোর উত্তর-পশ্চিমের শহর চেফচাওয়েন। এটি চাওয়েন নামেও পরিচিত। ১৪১৭ সালে প্রসিদ্ধ সুফি আল আলামি পর্তুগিজদের সঙ্গে মোকাবেলার করার জন্য এই নগর প্রতিষ্ঠা করেন। রাইফ পর্বতের পাশে অবস্থিত পুরো শহরের বেশিরভাগ বাড়িই নীল রঙে রাঙানো। ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দলিল হিসেবে এই স্থাপত্যটি স্বীকৃত। মরক্কোর দর্শনীয় স্থানগুলোর অন্যতম আকর্ষণের জায়গা চাওয়েন। পাহাড়ঘেরা ছোট সুন্দর ছবির মতো এই শহর খুব সহজেই মন কাড়ে ভ্রমণপ্রিয় পর্যটকদের। প্রতি বছর নানা দেশ থেকে প্রচুর পর্যটক এখানে আসেন। দর্শকরা রাস্তায় হেঁটে হেঁটে অবাক চোখে সুন্দর চেওয়ানের সৌন্দর্য উপভোগ করেন। প্রতি বছর গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময় দুইশ’র বেশি হোটেল পর্যটকে পরিপূর্ণ থাকে। এ ছাড়া শৌখিন মানুষজন কেনাকাটা করতেও এখানে আসেন। কারণ চাওয়েন হস্তশিল্পের জন্য বিখ্যাত।
৭. বুর্জ আল আরব (দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত) : বুর্জ আল আরব। নামটি অনেকের কাছেই পরিচিত। বিশ্বের চতুর্থ সুউচ্চ হোটেল হিসেবে এটি স্বীকৃত। এটি মূলত সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অবস্থিত একটি হোটেল। হোটেলটি ‘বেস্ট হোটেল ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ এবং ‘বেস্ট হোটেল ইন দ্য মিডল ইস্ট’ ক্যাটাগরিতে স্বীকতি ও অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছে। ‘বুর্জ আল আরব’ মানে হলো আরবের সম্মান। যদিও কেউ কেউ বলছেন, বুর্জ আল আরবের সম্পূর্ণ অর্থ হলো ‘আরবের স্তম্ভ’। আরব বিশ্বের অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি এবং আরব আমিরাতের শাসক শেখ নাহিয়ানের পরিবার সুউচ্চ ও বিলাসবহুল এই হোটেলটি নির্মাণ করেন। এই স্থাপনাটির স্থপতি টম রাইট। এটি নির্মাণে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছে ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অ্যাটকিনস। নির্মাণ করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকান কন্ট্রাক্টর ম্যুরে অ্যান্ড রবার্টস। কেএসি ইন্টারন্যাশনালের ডিজাইন প্রিন্সিপাল খুয়ান চিউ নান্দনিক এই হোটেলটির ভেতরের সাজসজ্জার কাজ করেন।
৮. সুলায়মানিয়া মসজিদ (ইস্তাম্বুল, তুরস্ক) : তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে অবস্থিত সবচেয়ে বড় মসজিদ। ১৫৫০ থেকে ১৫৫৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এই মসজিদটি নির্মিত হয়। উসমানীয় স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে এই স্থাপত্যটি আজো বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাদশাহ প্রথম সুলাইমান মসজিদটি নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন বলে তার নামেই এর নামকরণ করা হয়েছে। সুলায়মানি মসজিদই পৃথিবীর একমাত্র প্রথম মসজিদ, যেখানে প্রথমবারের মতো চারটি মিনার স্থাপন করা হয়েছে। মসজিদটি ইউনেস্কোর বিশ্বঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। স্থাপত্যটি দেখতে দেশ-বিদেশের প্রচুর পর্যটক ভিড় করেন।
৯. জামে মস্ক অব ইস্পাহান (ইস্পাহান, ইরান) : ইরানের তৃতীয় বৃহত্তম শহর ইস্পাহানের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ এটি। বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের গৌরবের অন্যতম একটি স্থাপনা এটি। সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীকালে এটি প্রতিষ্ঠিত। ১২শ শতাব্দীতে মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করা হয়। ইউনেস্কো ২০১২ সালে এই মসজিদ-স্থাপত্যকে বিশ্বঐতিহ্যের স্থাপনা হিসেবে ঘোষণা করে। আইওয়ান নির্মাণশৈলীতে নির্মিত মসজিদটির গঠনপ্রণালি হলো- প্রত্যেক চার কোনা বিশিষ্ট একটি প্রাঙ্গণের প্রতি পাশে বড় আকারের একটি খিলান করা দরজা রয়েছে। প্রচলিত আছে, উমাইয়ার শাসনামলে দামেস্কের একজন খলিফা ব্যক্তিগতভাবে এই মসজিদের একটি পিলার নির্মাণ করেন।
১০. হাসান দ্বিতীয় মসজিদ (কাসাব্লাংকা, মরক্কো) : মরক্কোর উপকূলীয় শহর কাসাব্লাংকায় হাসান দ্বিতীয় মসজিদ অবস্থিত। মসজিদটি ঐতিহাসিক মুসলিম স্থাপত্যগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। বলা হয়ে থাকে, এটিই আফ্রিকার সবচেয়ে বড় মসজিদ। মসজিদটি স্থাপিত হয়েছে ১৯৯৩ সালে। এটি ভাসমান মসজিদ হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত। অবশ্য এর কারণও আছে। মসজিদটির তিন ভাগের এক ভাগ আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থিত। দেখলে মনে হয় সাগরের বুকে ভাসছে মসজিদটি। এই মসজিদের মিনারের উচ্চতা ২১০ মিটার। প্রায় ৬০ তলা ভবনের সমান উঁচু এ মিনারের উপরে স্থাপিত হয়েছে একটি বিশেষ লেজার রশ্মি, যা সমুদ্রপথে চলমান নাবিকদের পবিত্র কাবা শরিফের পথ প্রদর্শনে সহযোগিতা করে। এই মিনারটি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু মিনার হিসেবে স্বীকৃত।
কমেন্টস করুন