আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে/জানি নে, জানি নে/কিছুতেই কেন যে মন লাগে না। সুপ্রিয় দর্শক! মেঘলা আকাশ আর বৃষ্টিস্নাত এমন পরিবেশে কিছুতে মন লাগুক আর না লাগুক একপ্লেট খিচুরির জন্য আত্মহারা হয় বাঙালি মন। সাথে একটু আচার হলে তো আর কথাই থাকে না…
না দর্শক খিচুরি আর আচার নিয়ে কথা বলছি না আজ। কাউকে নিষেধও করছি না এমন দিনে খিচুরি খেতে। আজ তাহলে কি নিয়ে কথা বলবো? আজ কথা বলবো ঝড়-বৃষ্টির দিনে রাসুল (সা.) কি কি আমল করতেন সে বিষয়ে। একজন মুসলিম হিসেবে ঝড়-বৃষ্টির সময় আমাদের করণীয় ও বর্জনীয় কি সে সব বিষয়গুলো জেনে নেব আজ…
১. প্রথম আমল হলো— দোয়া পড়া
বৃষ্টি নিয়ে মোট পাঁচটি দোয়ার পাঠের কথা বিভিন্ন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। চলুন জেনে নেই— কখন কখন পড়তে হয় সে দোয়া পাঁচটি?
১. বৃষ্টি বর্ষণ শুরু হলে যে দোয়া পড়তে হয় : রহমতের বারিধারা শুরু হলো সুন্নত হলো দোয়া পড়া। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বৃষ্টি হতে দেখলে বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা ছাইয়্যিবান নাফিয়া’। অর্থাৎ হে আল্লাহ, এমন বৃষ্টি আমাদের ওপর বর্ষণ করুন যাতে ঢল, ধস বা আজাবের মতো কোনো অমঙ্গল নিহিত নেই। (বোখারি শারিফ, হাদিস নং— ১০৩২)।
২. বৃষ্টি চলাকালে দোয়া পড়া : বৃষ্টি চলমান সময়ে দোয়া কবুল হয়। তাই এ সময় দোয়ার জন্য লুফে নেয়া সুন্নত। হজরত সাহল বিন সাদ (রা.) বলেন, ‘দুই সময়ের দোয়া ফেরত দেয়া হয় না কিংবা (তিনি বলেছেন), খুব কমই ফেরত দেয়া হয়- আজানের সময় দোয়া এবং রণাঙ্গণে শত্রুর মুখোমুখি হওয়াকালের দোয়া। অন্য বর্ণনা মতে, বৃষ্টির সময়ের দোয়া। (আবু দাউদ, হাদিস নং— ২৫৪০)
৩. বজ্রপাতের সময় দোয়া পড়া : হজরত ইবনে ওমর (রা.) বলেন, “রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন বজ্রের আওয়াজ শুনতেন, তখন এ দোয়া পড়তেন, ‘আল্লাহুম্মা লা-তাক্বতুলনা বিগজবিকা ওয়া লা-তুহলিকনা বিআজা-বিকা ওয়া আ-ফিনা- ক্ববলা জা-লিকা।’ অর্থাৎ হে আল্লাহ, আপনি আমাকে আপনার গজব দিয়ে হত্যা করে দেবেন না এবং আপনার আজাব দিয়ে ধ্বংস করে দেবেন না; বরং এসবের আগেই আমাকে পরিত্রাণ দিন। (তিরমিজি, হা. ৩৪৫০)
৪. বৃষ্টির বর্ষণ শেষ হলে যে দোয়া পড়তে হয় : হজরত জায়েদ ইবনে খালেদ জুহানি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) হুদাইবিয়ায় রাতে বৃষ্টির পর আমাদের নিয়ে নামাজ পড়লেন। নামাজ শেষে তিনি লোকজনের মুখোমুখি হলেন। তিনি বললেন, তোমরা কি জানো তোমাদের রব কী বলেছেন? তারা বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন। তিনি বলেছেন, আমার বান্দাদের কেউ আমার প্রতি ঈমান নিয়ে আর কেউ কেউ আমাকে অস্বীকার করে প্রভাতে উপনীত হয়েছে। যে বলেছে, বিফাদলিল্লাহি ওয়া রহমাতিহি তথা আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়ায় আমরা বৃষ্টিপ্রাপ্ত হয়েছি। ফলে সে আমার প্রতি ঈমান আর তারকার প্রতি কুফরি দেখিয়েছে। আর যে বলেছে, অমুক অমুক তারকার কারণে, সে আমার প্রতি অস্বীকারকারী এবং তারকার প্রতি ঈমানদার।’ (বোখারি, হাদিস নং— ৮৪৬; মুসলিম, হাদিস নং— ১৫)
৫. অতি বৃষ্টি বন্ধে দোয়া পড়া : বৃষ্টি হওয়া ভালো কিন্তু অতিবৃষ্টি ভালো না। সেজন্য রাসুল (সা.) থেকে অতিবৃষ্টি যেন না হয়; সেজন্য দোয়া পাঠের বর্ণনা পাওয়া যায়। হজরত আনাস (রা.) বলেন, একদা জুমার দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) খুতবা দেয়া অবস্থায় জনৈক সাহাবি মসজিদে প্রবেশ করে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! জীবজন্তু মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে, পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে, আল্লাহ তায়ালার কাছে আমাদের জন্য বৃষ্টি প্রার্থনা করুন। তৎক্ষণাৎ রাসুলুল্লাহ (সা.) দুই হাত সম্প্রসারিত করে দোয়া করলেন, ‘আল্লাহুম্মা হাওয়ালাইনা ওয়ালা আলাইনা। আল্লাহুম্মা আলাইকা বিল আকাম ওয়াজজিরাব ওয়া বুতুনিল আওদিয়া ওয়া মানাবিতিশশাজার’। অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমাদের বৃষ্টি দান করো! হে আল্লাহ! আমাদের বৃষ্টি দান করো! হে আল্লাহ! আমাদের বৃষ্টি দান করো! আনাস (রা.) বলেন, আল্লাহর শপথ! তখন আকাশে বিন্দুমাত্র মেঘের ছোঁয়াও ছিল না, রাসুলুল্লাহ (সা.) এর দোয়ার পর দিগন্তে মেঘের উদ্ভাস হয়, কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো আকাশ ছেয়ে ফেলে, অতঃপর মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হয়। আনাস (রা.) বলেন, আল্লাহর শপথ! পরবর্তী ছয় দিন যাবৎ আমরা সূর্য দেখিনি। সপ্তাহান্তে পরবর্তী জুমায় পুনরায় ওই ব্যক্তি যখন মসজিদে প্রবেশ করে তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) খুতবারত অবস্থায়, ওই ব্যক্তি আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! ধনসম্পদ সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, পানিতে পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে, আল্লাহ তায়ালার কাছে বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার প্রার্থনা করুন। আনাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) দুই হাত উঁচিয়ে দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! আমাদের ওপর থেকে আশপাশের অঞ্চলে সরিয়ে দাও, পাহাড়-মরু, খাল-বিল ও বনাঞ্চলের দিকে সরিয়ে নাও! বর্ণনাকারী বলেন, তখনই বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়, অতঃপর আমরা নামাজান্তে রোদের মধ্যে বের হই।’ (বোখারি, হাদিস নং— ১০১৩; মুসলিম, হাদিস নং— ৮৯৭)
২. দ্বিতীয় আমল হলো— বৃষ্টির পানি স্পর্শ করা
বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা হয়ে নামে রহমতের ধারা। তাই সুন্নত হলো বৃষ্টির ছোঁয়া পেতে বস্ত্রাংশ মেলে ধরা। হজরত আনাস (রা.) বলেন, ‘আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে থাকাকালে একবার বৃষ্টি নামল। রাসুলুল্লাহ (সা.) তখন তাঁর পরিধেয় প্রসারিত করলেন, যাতে পানি তাকে স্পর্শ করতে পারে। আমরা বললাম, আপনি কেন এমন করলেন? তিনি বললেন, কারণ তা তার রবের কাছ থেকে মাত্রই এসেছে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং— ৮৯৮)।
৩. তৃতীয় আমল হলো— বৃষ্টিকে গজব না বলা এবং গালাগালি বা দোষারোপ না করা
প্রবল ঝড় বৃষ্টি শুরু হলেই অনেকে বলে থাকে যে, আল্লাহর গজব শুরু হয়েছে। সেব কথা না বলা। কিংবা অমুক ব্যক্তির কারণে দেশে বা অঞ্চলে গজব নাজিল হয়েছে, এসব না বলা। অতিরিক্ত ঝড়-বৃষ্টি হলে মানুষ ‘অমুক-তমুক’ বৃষ্টি-ঝড় বলে গালাগাল দিতে থাকে। মারাত্মক ধরনের বাজে মন্তব্য করে থাকে। হাদিসে এসেছে, মানুষ যদি এমন কোনো কিছুকে গালি দেয়, যেগুলো গালি পাওয়ার উযুক্ত নয়, সেগুলোকে গালি দিলে, সে গালি নিজের দিকে ফিরে আসে। অতএব যত বৃষ্টি, তুফান বা ঘূর্ণিঝড় হোক- এগুলোকে গালি দেয়া যাবে না।
৪. চতুর্থ আমল হলো— ঝড়োহাওয়া শুরু হলে আল্লাহকে ভয় করা
হজরত স্ত্রী আয়েশা (রা.) বলেন, ‘যখন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হতো এবং ঝড়ো বাতাস বইতো; তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) এর চেহারায় পেরেশানির ভাব ফুটে উঠত। আয়েশা (রা.) আরও বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছি যে, লোকজন মেঘ দেখলে বৃষ্টির আশায় আনন্দিত হয়ে থাকে, আর আপনি এতে পেরেশান হয়ে থাকেন?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আমি এ ভেবে শঙ্কিত হই যে, তা আমার উম্মতের ওপর আজাব হিসেবে পতিত হয় কিনা, কেননা পূর্ববর্তী উম্মতদের ওপর এ পদ্ধতিতে আজাব পতিত হয়েছিল।’ (মুসলিম : ৮৯৯)।
৫. পঞ্চম আমল হলো— হাদিস পরিপন্থী আমল বা কাজ থেকে বিরত থাকা
বৃষ্টির সময় আমাদের সমাজে বেশ কিছু হাদিস পরিপন্থী আমল বা কাজ প্রচলিত রয়েছে। সেসব আমল বা কাজ থেকে বিরত থাকা। যেমন, আমাদের সমাজে অতি বৃষ্টি সময় আজাদ দেওয়ার একটি প্রচলন চালু রয়েছে। কিন্তু বৃষ্টি বা অতিবৃষ্টি থেকে বাঁচা বা রক্ষার উদ্দেশ্যে আজান দেওয়ার কোনো আমলের বর্ণনা কোনো সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয় সুতরাং এহেন হাদিস পরিপন্থী আমল বা কাজ থেকে বিরত থাকাও একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল।