ফিচার স্বাস্থ্য সুরক্ষা

করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে রাসুলের (সা.) পছন্দের ১০টি খাবার খান

লিখেছেন মিরাজ রহমান

করোনাভাইরাস আতঙ্কে কাঁপছে গোটা বিশ্ব। বিশ্বের বাঘা বাঘা চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত এর কোনো প্রতিষেধক আবিস্কার করতে সক্ষম হননি। তবে প্রায় সব চিকিৎসাবিজ্ঞানীরাই একটি কথা স্বীকার করেছেন, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো বা বেশি তারা এই ভাইরাস থেকে অনেকটাই ঝুঁকি মুক্ত। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো থাকায় সুস্থ বেশে ঘরে ফিরেছেন বহু রোগী।

মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এমন বিভিন্ন খাদ্য-খাবার রাসুল (সা.) নিজে নিয়মিত খেয়েছেন এবং উম্মতে মুহাম্মাদীকে তা খাওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন। কারোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আগ থেকেই অথবা আক্রান্ত হওয়ার পর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে আমরা এসব খাবার গ্রহণ করতে পারি। খাবারগুলো হলো,

১. আজওয়া ও সাধারণ খেজুর : বোখারী শরীফের একটি হাদিসে হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই মদীনার আজওয়া খেজুর রোগ নিরাময়কারী এবং প্রাতঃকালীন প্রতিষেধক।

আজওয়া খেজুরে রয়েছে ম্যাগনেসিয়াম, যা মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। আর আজওয়া ছাড়া অন্য খেজুরের মাঝেও প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও জিঙ্ক রয়েছে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি শরীরে আয়রনের চাহিদাও পূরণ করে।

২. মধু : পবিত্র কুরআনের সুরা নাহলের ৬৯ নং আয়াতে আল্লাহ মহান জানিয়েছেন, মৌমাছির পেট থেকে বিভিন্ন রঙের পানীয় অর্থ্যাৎ মধু নির্গত হয়। তাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিকার। মধুকে বলা হয় প্রাকৃতিক এন্টিবায়োটিক ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মধুর মধ্যে রয়েছে শক্তিশালী জীবাণুনাশক ক্ষমতা।

ইবনে মাজাহ শরীফের ৩৪৫২ নং হাদিসে হজরত আব্দুলাহ্ ইব্ন মাসঊদ (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা কোরআন ও মধু দিয়ে ব্যাধি নিরাময়ের ব্যবস্থা করবে গবেষণায় দেখা গেছে, মধু খাওয়া দ্বারা ভয়ঙ্কর সব ভাইরাসের নির্মূল হয়। মধু অনেক রোগের প্রতিষেধক এবং এতে রয়েছে রোগমুক্তি।

৩. কালোজিরা : বুখারী শরীফের ৫২৮৫ নং হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আয়িশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, নবীকে (সা.) তিনি বলতে শুনেছেন, কালোজিরা ‘সাম’ ছাড়া সব রোগের ঔষধ। হজরত আয়েশা (রা.) জিজ্ঞসা করলেন, ‘সাম’ কি? রাসুল (সা.) বললেন, সাম অর্থ হলো মৃত্যু।

গবেষণায় দেখা গেছে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে কালোজিরা। কালিজিরায় রয়েছে ভিটামিন সি ও জিঙ্ক। নিয়মিত কালোজিরা খেলে যে কোনও জীবাণু বা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য দেহ প্রস্তুত হয়। এছাড়া শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যার নিরাময়ে কালোজিরা অনেক বেশি উপকারী।

৪. জয়তুন ফল ও তেল : তিরমিজি শরীফের ১৮৫১ নং হাদিসে হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, তোমরা জয়তুনের তেল খাও এবং তা শরীরে মালিশ করো। কেননা এটি বরকত ও প্রাচুর্যময় গাছের তেল।  কোনো কোনো গবেষণায় দেখা গেছে, জয়তুনের তেলের মাঝেও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করে এবং কোষের সুরক্ষায় কাজ করে।

৫. দুধ : পবিত্র কুরআনের সুরা নাহলের ৬৬ নং আয়াতে আল্লাহ মহান ইরশাদ করেছেন, গরুর পেটের গোবর ও রক্তের মধ্য থেকে তোমাদেরকে পান করাই বিশুদ্ধ দুধ, যা পানকারীদের জন্য স্বাচ্ছন্দ্যকর।

জাদুল মায়াদ নামক একটি গ্রন্থের উল্লেখ রয়েছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমাদের গরুর দুধ পান করতে হবে কারণ এর মধ্যে ঔষধি গুণ আছে। দুধের তৈলাক্ত পদার্থে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে, তবে এর মাংস রোগ সৃষ্টিকারক। আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণায় প্রমাণিত গরুর দুধ মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

৬. লাউ : মুসলিম শরীফের ২০৪১ নং হাদিস ইরশাদ হয়েছে, হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার একজন দরজি রাসুলকে (সা.) খাবারের দাওয়াত করেন। আমিও মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে সেই খাবারে অংশগ্রহণ করি। রাসুল (সা.)-এর সামনে বার্লির রুটি এবং গোশতের টুকরা ও লাউ মিশ্রিত ঝোল পরিবেশন করা হয়। আমি দেখেছি, রাসুল (সা.) প্লেট থেকে খুঁজে খুঁজে লাউ নিয়ে খাচ্ছেন।

লাউয়ে রয়েছে প্রচুর মাত্রায় পানি, রয়েছে প্রচুর পরিমাণ খনিজও। বিভিন্ন গবেষণায় পাওয়া গেছে, প্রতিদিন লাউয়ের রস বা জুসের সঙ্গে লেবুর রস মিশিয়ে খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নতি ঘটে।

 ৭. সামুদ্রিক মাছ : মুসলিম শরীফের ৪৮৪৪নং হাদিসে হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণনা এসেছে। রাসুল (সা.)-এর পক্ষ থেকে একটি কাফেলা অভিযানে পাঠানো এবং তাদের খাবার ফুরিয়ে যাওয়ায় সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার পর তারা যখন মদীনায় ফিরে এসে রাসুলকে (সা.) ঘটনাটি জানালেন, তখন রাসুল (সা.) বললেন, ওটা ছিলো রিজিক, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য পাঠিয়েছিলেন। তোমাদের কাছে এর গোশত অবশিষ্ট আছে কি? থাকলে আমাকে খাওয়াও। এরপর সেই মাছের কিছু অংশ রাসুলকে (সা.) দেওয়া হলে, তিনি তা খেলেন।

ওমেগা থ্রি সমৃদ্ধ সামুদ্রিক মাছ শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এছাড়া এই মাছে রয়েছে জিংক ও আয়োডিন। জিংকও মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

৮. তরমুজ : তিরমিজি শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) তরমুজের সঙ্গে ‘রাতাব’ বা পাকা-তাজা খেজুর খেতেন।

মৌসুমি ফল তরমুজ গরমে শুধুমাত্র শরীর ঠাণ্ডা রাখে এমনটা নয়; এতে থাকা গ্লুটাথিওন নামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে তোলে। বাড়ায় জীবাণু প্রতিরোধ ক্ষমতা। তরমুজের পুষ্টি, খাদ্য ও ভেষজগুণ সর্বজনবিদিত ও বৈজ্ঞানিক সত্য।

৯. কিশমিশ : মুসলিম শরীফে ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.)-এর জন্য কিশমিশ ভিজিয়ে রাখা হতো এবং তিনি সেগুলো পান করতেন।

কিসমিসে প্রচুর ভিটামিন এবং খনিজ আছে। একে বলা হয় প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট; যা রোগের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা বাড়ায়। গবেষণায় পাওয়া গেছে, ভেজা কিসমিস এবং তার পানি নিয়মিত খাওয়ার দ্বারা বোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি লাভ করে। এছাড়া কিশমিশে রয়েছে প্রচুর পরিমানে ব্যাকটেরিয়ারোধী এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান, যা ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জ্বর সাড়াতে করতে সাহায্য কারে।

১০. বেশি বেশি পানি পান করা : বহু হাদিস রাসুল (সা.) পানি বসে পান করা, ডান হাত দিয়ে পান করা, তিন বারে পান করা, পানি পানের শুরুতে বিসমিল্লাহ এবং শেষে আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করাসহ বিভিন্ন নিদের্শনা প্রদান করেছেন। পানি পানের ব্যাপারে রাসুলের (সা.) এতোসব নিদের্শনা একথাই প্রমাণ করে যে, রাসুল (সা.) বেশি বেশি পানি পান করাকে গুরুত্ব দিয়েছেন।

আধুনিক গবেষণায় একথা প্রমাণিত যে, প্রতিদিন বেশি বেশি পানি পান করার দ্বারা মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং তা বিভিন্ন ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুস্থ করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে।

ইসলাম ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচিত খাবারগুলো আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে করোনাভাইরাস থেকে বেঁচে থাকাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে, ইনশা আল্লাহ। করোনাভাইরাসের যেহেতু কোনো ওষুধ নেই; তাই আমাদের শরীরকে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুত রাখতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিকারক এসব খাবার গ্রহণ করা উচিত। এসব খাবার গ্রহণ করলে একদিকে যেমন করোনা ভাইরাস থেকে বেঁচে থাকার সম্ভবণা সৃষ্টি হবে, অন্যদিকে পালন করা হবে রাসুলে আরাবি (সা.)-এর সুন্নাতও।

Comment

লেখক পরিচিতি

মিরাজ রহমান

গতানুগতিক ধারার বাইরে থেকে কাজ করে ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন মিরাজ রহমান। পেশায় পুরোদস্তুর একজন সাংবাদিক হলেও কেবল ইসলামকে ঘিরেই আবর্তিত তার ধ্যান-জ্ঞান। দৈনিক পত্রিকার ইসলাম পাতায় লেখালেখি থেকে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন বটে, কিন্তু একসময় শিল্প চর্চায়ও ছিলেন বেশ মনোযোগী।
মিডিয়ায় সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেছেন যখন, তখনও তিনি ছাত্র। মাদানিনগর মাদরাসার কাফিয়া জামাতের (শ্রেণি) শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় কণ্ট্রিবিউটর হিসেবে প্রথম কাজ শুরু করেন দৈনিক যুগান্তরে। ধারালো লিখনী শক্তি অল্পদিনের মধ্যে পরিচিত করে তোলে তাকে। দেশের জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রায় সবগুলোতেই ইসলামবিষয়ক কলাম ও ফিচার লিখেছেন দীর্ঘ সময়। জাতীয় প্রিন্ট মিডিয়াগুলোতে তার অন্তত দুই সহস্রাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
মিরাজ মূলত পড়াশুনা করেছেন কওমি শিক্ষাধারায়, এর পাশাপাশি তিনি জেনারেল শিক্ষাধারায়ও পড়াশুনা করছেন। সহ-সম্পাদক হিসেবে প্রথম যোগদান করেন দৈনিক ডেসটিনি পত্রিকায়। সেখান থেকে দৈনিক কালের কণ্ঠে। দেশে-বিদেশে অনলাইন গণমাধ্যমের জয়যাত্রা শুরু হলে মিরাজ ইন্টারনেট জগতকে ইসলাম প্রচারের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র বিবেচনা করে অনলাইনেই গাঁটছাড়া বাঁধেন। দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইসলামবিষয়ক অনলাইন পোর্টাল প্রিয়.কমের ‘প্রিয় ইসলাম’-এর সৃষ্টি ও পথচলার সূচনা তারই হাতে। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন প্রিয়.কমের প্রিয় ইসলাম বিভাগের এডিটর ইনচার্জ। সর্বশেষ কর্মরত ছিলেন দৈনিক বাংলাদেশের খবরের ফিচার ইনচার্জ হিসেবে।
টেলিভেশনে অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা ও আলোচনার সঙ্গেও ইতিমধ্যে যুক্ত হয়েছেন মিরাজ রহমান। পরিচালনা করেছেন বেশ কিছু অনুষ্ঠানও। এসো কলম মেরামত করি, ছোটদের নবী-রাসূল সিরিজ, তাবলিগী জামাতের পৃষ্ঠপোষক-মুরুব্বি ছিলেন যাঁরা, শরয়ী পর্দার বিধান, আশিক মিন ফিলিস্তিন, নারী তুমি সৌভাগ্যবতী ও হালাল ব্যবসা ও হালাল অর্থনীতির কথকতাসহ বেশ কিছু আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থেও জনক তিনি। বর্তমান তিনি ইসলাম প্রতিদিনের সম্পাদক ও প্রকাশক এবং দ্য সুলতান প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।