ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), নির্বাহী ও অডিট কমিটির চেয়ারম্যান পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে জামায়াত-নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক হিসেবেই পরিচিত ছিল। সেই পরিচয় থেকে ব্যাংকটিকে বের করে আনতে বেশ কিছুদিন ধরে এটির মালিকানা, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় ধাপে ধাপে পরিবর্তন আসছিল। সর্বশেষ গতকাল দিনভর অনুষ্ঠিত পরিচালনা পর্ষদের সভায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়।
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান ইবনে সিনা ট্রাস্টের প্রতিনিধি হিসেবে এত দিন ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন মুস্তাফা আনোয়ার। তাঁর জায়গায় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সরকারের সাবেক সচিব আরাস্তু খানকে।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি কার্যকর হওয়া মীর কাসেম আলী ছিলেন ইসলামী ব্যাংকের অন্যতম উদ্যোক্তা। তিনি একসময় ইবনে সিনা ট্রাস্টেরও চেয়ারম্যান ছিলেন।
রাজধানীর পাঁচ তারকা র্যা ডিসন হোটেলে অনুষ্ঠিত পর্ষদ সভায় ব্যাংকটিতে বড় ধরনের এ পরিবর্তন আনা হয়। পরিবর্তন আনা হয়েছে ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান পদেও।
নতুন পরিচালক হিসেবে গতকাল পর্ষদ সভায় যোগ দিয়েই ব্যাংকটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন সরকারের সাবেক সচিব আরাস্তু খান। আরমাডা স্পিনিং মিলস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে আরাস্তু খান ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক মনোনীত হন। গতকালই তিনি প্রথম পর্ষদ সভায় যোগ দেন এবং সেখানে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
“ব্যাংকের পর্ষদ সভায় চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও এমডি পরিবর্তন”
চেয়ারম্যান পদ ছাড়াও ব্যাংকটির পরিচালক ও ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান পদ থেকেও পদত্যাগ করেন মুস্তাফা আনোয়ার। পদত্যাগ করেছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান। নতুন এমডি হিসেবে ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি আবদুল হামিদ মিঞার নাম অনুমোদন করা হয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন সাপেক্ষে তাঁর নিয়োগ কার্যকর হবে। তবে আবদুল মান্নান পর্ষদ সভায় উপস্থিত ছিলেন না।
যোগাযোগ করা হলে গতকাল রাতে মুস্তাফা আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, পর্ষদের সভায় ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ভাইস চেয়ারম্যান আজিজুল হক ও এমডি আবদুল মান্নান পদত্যাগ করেছেন। সবকিছু শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে।
ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের গতকালের সভায় চেয়ারম্যান ছাড়াও ভাইস চেয়ারম্যান আজিজুল হক পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তাঁর স্থলে নতুন ভাইস চেয়ারম্যান করা হয় সৈয়দ আহসানুল আলমকে। তিনি ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যানও ছিলেন। ভাইস চেয়ারম্যানের অপর একটি পদে ইউসুফ আবদুল্লাহ আল-রাজি পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন।
এ ছাড়া মেজর জেনারেল (অব.) আবদুল মতিনকে নির্বাহী কমিটি ও মো. জিল্লুর রহমানকে অডিট কমিটি এবং মো. আবদুল মাবুদকে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান করে একাধিক কমিটি পুনর্গঠন করা হয়।
বড় ধরনের এ পরিবর্তন এলেও পরিচালনা পর্ষদের আকারে বড় পরিবর্তন আসেনি। পুনর্গঠনের পর ১৮ জনের পর্ষদ নেমে এসেছে ১৭ জনে। এর মধ্যে ৭ জনই স্বতন্ত্র পরিচালক। তাঁরাই মূলত ব্যাংকটি পরিচালনায় মূল ভূমিকা রাখছেন। ব্যাংকটির বিদেশি শেয়ারধারীদের মধ্যে পরিচালক হিসেবে রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আল-রাজি, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং সরকারি মালিকানাধীন দেশীয় প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) প্রতিনিধি। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে এবিসি ভেঞ্চার, গ্র্যান্ড বিজনেস লিমিটেড, এক্সেল ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং, প্লাটিনাম এনডেভরস, প্যারাডাইস ইন্টারন্যাশনাল ও ব্লু ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে যুক্ত হয়েছেন। স্বতন্ত্র পরিচালকেরা হলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল, পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হেলাল আহমেদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলম, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সাবেক এমডি জিল্লুর রহমান, পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক আবদুল মাবুদ, আইনজীবী বোরহান উদ্দিন আহমেদ ও বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠান শাইনপুকুর সিরামিক ও নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির।
এর আগে জামায়াতের কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে জড়িত এমন পরিচালক ও কর্মকর্তাদের ইসলামী ব্যাংক থেকে সরিয়ে দিতে ব্যাংকটির ভাইস চেয়ারম্যান ইউসুফ আল-রাজি সম্মতি দিয়েছেন বলে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ জানিয়েছিলেন। অর্থমন্ত্রীর কাছে পাঠানো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এক চিঠি থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। অর্থমন্ত্রীর নির্দেশে সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহর সঙ্গে এক বৈঠকে এমন মত দেন ইউসুফ আল-রাজি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে পাঠানো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়।
ইসলামী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংকের শীর্ষ দুই বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানই বিদেশি। এর মধ্যে একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইসলামী ব্যাংকের সবচেয়ে বেশি শেয়ার রয়েছে আল-রাজি কোম্পানির। এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যাংকটির ভাইস চেয়ারম্যান ইউসুফ আল-রাজি। এরপরই বেশি শেয়ার রয়েছে কুয়েতের পাবলিক অথরিটি ফর মাইনরস অ্যাফেয়ার্সের।
ইসলামী ব্যাংকের বিদেশি উদ্যোক্তারা হলেন ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, কুয়েত ফিন্যান্স হাউস, ইসলামিক ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড করপোরেশন দোহা, ইসলামিক ব্যাংকিং সিস্টেম ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং লুক্সেমবার্গ, শেখ আহমেদ সালেহ জামজুম, শেখ ফুয়াদ আবদুল হামিদ আল-খতিব, দ্য পাবলিক ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল সিকিউরিটি কুয়েত, মিনিস্ট্রি অব জাস্টিস কুয়েত। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠাকালীন বিদেশি উদ্যোক্তা বাহরাইন ইসলামি ব্যাংক সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে। এ ছাড়া অপর এক উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান দুবাই ইসলামি ব্যাংকও বেশির ভাগ শেয়ার ছেড়ে দিচ্ছে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি স্থানীয় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হলো বায়তুল শরীফ ফাউন্ডেশন, ইবনে সিনা ট্রাস্ট, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ইসলামিক ইকোনমিক রিসার্চ ব্যুরো। গতকালের পরিবর্তনের ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিমুক্ত হলো ইসলামী ব্যাংক।
দেশি-বিদেশি যৌথ উদ্যোগে দেশে ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের যাত্রা শুরু হয়। শুরুতে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ১৩টি প্রতিষ্ঠানের ৬৩ শতাংশের বেশি মালিকানা ছিল ইসলামী ব্যাংকে। তবে দুই বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংকে তাদের মালিকানা ছেড়ে দেওয়ায় উদ্যোক্তা অংশের পরিমাণ কিছুটা কমেছে।
ইসলামী ব্যাংক দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক হিসেবে পরিচিত। সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় আসে এ ব্যাংকের হাত ধরে। ২০১৬ সালে ব্যাংকটি ২ হাজার ৩ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের ব্যাংকটির গতকাল শেয়ারবাজারে দাম ছিল ৩০ টাকা।
সৌজন্যে : প্রথম আলো
কমেন্টস করুন