পোস্টমর্টেম বা ময়নাতদন্ত—কোনো মানুষের অস্বাভাবিক বা রহস্যজনক মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের পদ্ধতি। যাকে গ্রিক ভাষায় ‘অটোপসি’ও বলা হয়। ময়না শব্দটি উর্দু থেকে এসেছে। অর্থ ভালোভাবে খোঁজ করা। তাই ময়নাতদন্ত মানে হলো—ভালো করে তদন্ত করা।
ময়নাতদন্তের ইতিহাস : খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে প্রথম পোস্টমর্টেম করা হয় বলে জানা যায়। ঐতিহাসিকদের সূত্রানুসারে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৪ অব্দে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর পর তার পোস্টমর্টেম করা হয়েছিল। তবে সে সময় এখনকার মতো উন্নত পদ্ধতি ব্যবহৃত হতো না। সপ্তাদশ শতকে ময়নাতদন্তের আধুনিক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়।
বাংলাদেশের আইন : বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধি মোতাবেক হত্যাকাণ্ড, দুর্ঘটনায়, বিষপানে মৃত্যু, শরীরের কোথাও যদি কোনো আঘাতের দাগ থাকে অর্থাৎ স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি বলে সন্দেহের অবকাশ থাকলে সে মৃত্যুর কারণ জানার জন্য পোস্টমর্টেম করতে হবে। এই তদন্তে বেশ কয়েকটি বিষয় অনুসন্ধানের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। এর মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দুইটি বিষয় হলো—মৃত্যু কীভাবে হয়েছে এবং কখন হয়েছে তা শনাক্ত করা। এ ছাড়াও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে কি না, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে কি না, বিষ পান করানো হয়েছে কি না, রক্তক্ষরণের কোনো ঘটনা ঘটেছে কি না—ইত্যাদি বিষয়ও ময়নাতদন্তে প্রকাশিত হয়।
কীভাবে করা হয় ময়নাতদন্ত? ময়নাতদন্তের কক্ষ বা মর্গে তদন্তকারী চিকিৎসক প্রথমে মৃতদেহের বাহ্যিক অবস্থার বিশ্লেষণ করেন। মৃতদেহে কোনো আঘাত বা ক্ষত আছে কি না, ত্বক ও জিহ্বার রং ইত্যাদি দেখে মৃত্যুর কারণ খোঁজার চেষ্টা করেন। তারপর মৃতদেহের ব্যবচ্ছেদ করে মস্তিষ্ক, ফুসফুস, লিভারসহ শরীরের ভেতরে যাচাই করে দেখা হয়। এতে দেহের অভ্যন্তরে কোনো আঘাত থাকলে বা বিষক্রিয়া থাকলে, চিকিৎসকরা সেটি বুঝতে পারেন। কোথাও আঘাতের চিহ্ন থাকলে সেটি কীভাবে হয়েছে, তা ময়নাতদন্তের এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বোঝা যায়। এই কাজটি সম্পন্ন করতে মৃতদেহের নানা অংশ কেটে দেখতে বাধ্য হন চিকিৎসকরা। এর জন্য দেহের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ল্যাবেও পাঠানো হয়।
ময়নাতদন্তের ব্যাপারে ইসলাম কী বলে? হজরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, মানুষ জীবিত অবস্থায় যেমন সম্মানিত, মৃত্যুর পরেও তেমনি সম্মানিত। (আবু দাউদ : ৪০৮) আবু দাউদ শরীফের ২/৪৫৮ নং হাদীসের দলিলে ফাতওয়ায়ে হক্কানিয়ার ২য় খণ্ডের ৩৯৮ পৃষ্ঠায় এসেছে, মৃত্যুর পরে মানুষের শরীর কাটাছেঁড়া করা জীবিত অবস্থায় কাটাছেঁড়া করা মতোই। তাই জীবিত মানুষকে কষ্ট দেওয়া বা কাটাছেঁড়া করা যেমন অপরাধ ও গুনাহের কাজ তেমনি মৃত্যুর পরেও কাউকে কষ্ট দেওয়া অপরাধ ও গুনাহের কাজ। সুতরাং একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কারও লাশ কাটাছেঁড়া পোস্টমর্টেম করা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম কাজ। তবে বিশেষ প্রয়োজনে মামলা-মোকাদ্দামার ক্ষেত্রে পোস্টমর্টেম করার সুযোগ রয়েছে। যদি এমন হয়, সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে কোনো হত্যা বা ধর্ষণের সুষ্ঠু বিচারকার্য সম্ভব নয়। তখন পোস্টমর্টেম বা ময়নতদন্ত অথবা ফরেনসিক টেস্ট করানো জায়েয আছে।
এ বিষয়ে কথা হয় বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক, মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যাকার মুফতি আবু বকর সিরাজীর সাথে। বিভিন্ন হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘বিনা কারণে লাশের পোস্টমর্টেম করা জায়েয নেই। শরীয়ত অনুমোদিত কাজ, যেমন : গোসল করানো, কাফন পরানো, জানাযা ও কবরে দাফন ব্যতীত অন্য কিছু করা যাবে না। এমনকি শিক্ষার উদ্দেশ্যেও তা করা যাবে না। তবে শিক্ষার উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সে সকল মানুষের লাশ কাটা যাবে, যাদের সম্মান নেই। যেমন মুরতাদ, হারবী কাফের প্রভৃতি। কিন্তু মৃত্যুর কারণ জানার জন্য যদি উপযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য যুক্তি থাকে, শরীয়তসম্মত দাবি থাকে, তবে পোস্টমর্টেম করা যাবে। যেমন তার মৃত্যুর কারণ ঘোলাটে। লাশটি কেটে শরীরের বিশেষ স্থান পরীক্ষা করলে তা স্পষ্ট হবে, অথবা বিশেষ কোনো রোগ চেনার জন্য, সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে কোনো হত্যা বা ধর্ষণের সুষ্ঠু বিচারকার্য সম্ভব হচ্ছে না বা লাশ কাটলে খুনিকে শনাক্ত করা সম্ভব হবে ইত্যাদি শরীয়তসম্মত কারণে লাশ কাটা অর্থাৎ পোস্টমর্টেম বা ফরেনসিক টেস্ট করানো জায়েয আছে। তবে এই তদন্ত-কার্যক্রম সহজে সম্পন্ন করা আবশ্যক।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পোস্টমর্টেমের জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের পোস্টমর্টেমের পদ্ধতি পুরোনো। কথা হয় ঢাকা মেডিকেলের ময়নাতদন্তকারী এক কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি জানান, ‘বাংলাদেশের মর্গগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা নেই। তাই আমাদের কাছে মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হলে আমরা জানতে পারি না কোথায় সমস্যা হয়েছে। তখন আমরা সাঁতার না জানা একজন লোকের সাগরে সাঁতরে বেড়ানোর মতো সমস্যা সমাধানের খোঁজে মৃতদেহে সাঁতরে বেড়াই।’
এখানেই শেষ নয়, পোস্টমর্টেম বা ধর্ষণের ফরেনসিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে মানা হয় না কোনো ধরনের পর্দার বিধানও। অথচ জীবিত ব্যক্তির জন্য যে পর্দার বিধান রয়েছে মৃত ব্যক্তির জন্যেও একই পর্দার বিধান রয়েছে। অধিকাংশ সময় সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকা সত্যেও নারী ধর্ষণ, হত্যা, দুর্ঘটনার মামলায় ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ থেকে সনদ নিতে হয়। আইনের চোখে এ সনদ গুরুত্বপর্ণ দলিল। কিন্তু নারীদের মধ্যে যারা বিভিন্ন কারণে মারা যাচ্ছেন বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন তাদের বেশির ভাগের ময়নাতদন্ত ও সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করছেন পুরুষ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
এ বিষয়ে নাম না প্রকাশের শর্তে এক নারী ভুক্তভোগীর সাথে কথা হয়। তিনি জানান, ‘আমার সাথে এ (ধর্ষণের) দুর্ঘটনা ঘটলে আমি আদালতের শরণাপন্ন হই। চাক্ষুস সাক্ষী থাকা সত্যেও বিজ্ঞ আদালত ফরেনসিক রিপোর্ট দেখাতে বলেন। ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পরিবার আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে একজন পুরুষ ডাক্তার তার রুমেই আমার পরীক্ষা করেন। আমার মনে হয়েছে, ধর্ষণের দলিল পেতে আমাকে দ্বিতীয়বার ধর্ষণের শিকার হতে হলো।’ এর মূল কারণ, নারী ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মারাত্মক সংকট।
অবাক করার বিষয় হলো, দেশের প্রায় সকল হাসপাতালেই নারীর ধর্ষণের সুরতহাল পরীক্ষার জন্য পৃথক কক্ষ নেই। চিকিৎসকের বসার কক্ষে পুরুষ চিকিৎসক পুরুষ ওয়ার্ডবয়ের সহযোগিতায় সেই টেবিলের ওপরই ধর্ষণের শিকার নারীকে রেখে তার পরিধেয় কাপড় খুলে শারীরিক পরীক্ষা করেন। নারী মৃতদেহের পোস্টমর্টেমের জন্য নেই কোনো নারী ডোমও।
সূত্র থেকে জানা যায়, সারাদেশে ৩১ সরকারি মেডিকেল কলেজে বড়জোর ৩০ জন অভিজ্ঞ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। তার মধ্যে নারী আছেন মাত্র ৪ জন। অথচ প্রয়োজন কমপক্ষে ১৫০ জন। প্রায় ৭০টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে একজন করে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ থাকলেও সেসব মেডিকেল কলেজ ব্যক্তি মালিকানায় হওয়ায় ময়নাতদন্ত ও ধর্ষণের আলামত পরীক্ষার নিয়ম নেই। অথচ অনেক আগেই নারী পুলিশ এবং নারী ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দিয়ে সুরতহাল রিপোর্ট করতে আমাদের উচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নারী ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ প্রতিটি সরকারি মেডিকেল কলেজে থাকলে অন্তত নারীদের ধর্ষণের আলামত পরীক্ষা তো আর পুরুষ ডাক্তারের হাতে দিতে হতো না। নারী ভিকটিমদের হেস্তনেস্ত হতে হতো না। রক্ষা হতো ইসলামী বিধানও।
ওকে/এমএইচ