মাদরাসা শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ (৬৫%) কৌতুহল বা জানার আগ্রহ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে; অন্য কোন উদ্দেশ্য, বিতর্ক তৈরি করা বা প্রশ্ন তোলার জন্য নয়। এমন তথ্য উঠে এসেছে মুভ ফাউন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত পরীক্ষামূলক একটি গবেষণা জরিপে।
রোববার (৩০ জুন) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে মুভ ফাউন্ডেশন কর্তৃক ‘বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষর্থীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সাক্ষরতা’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (কাউন্টার টেরোরিজম) মো. মনিরুল ইসলাম ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের মহাপরিচালক মাওলানা যোবায়ের আহমদ চৌধুরী। প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার প্রফেসর ড. মো. গোলাম রহমান। এছাড়া অতিথি হিসেবে আরো উপস্থিত ছিলেন ঢাকাস্থ কানাডা হাই কমিশনার পলিটিক্যাল কাউন্সিলর ব্র্যাডলি কোটস ও ইসলামী ঐক্যজোটের যুগ্ন মহাসচিব মাওলানা আলতাফ হোসাইন।
শতাধিক মাদরাসা শিক্ষক-শিক্ষার্থী, মিডিয়াকর্মী ও ইসলামী লেখক-গবেষকদের উপস্থিতিতে মুভ ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট সাইফুল হক তুষার গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপণ করেন। অনুষ্ঠানে বক্তাগণ মুভ কর্তৃক পরিচালিত এই গবেষণা জরিপের প্রসংশা করেন এবং বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (কাউন্টার টেরোরিজম) মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘মুভ ফাউন্ডেশনের এই হবেষণা প্রতিবেদন দেখে মাদরাসা শিক্ষার্থী সম্পর্কে আমার অতীত ধারণা পাল্টে গেছে। আমি ধারণা করতাম যে, মাদরাসা শিক্ষার্থীরা সোশ্যাল মিডিয়া তেমন একটা ব্যবহার করেন না’। তিনি আরো বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়া বা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পরা নেগেটিভ বা মন্দ কনটেন্টের বিপরীতে পজেটিভ বা ভালো কনটেন্ট প্রচারে আলেম-উলামাদের এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা যথা সম্ভব সহযোগিতা করবো’।
বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের মহাপরিচালক মাওলানা যোবায়ের আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘রাসুল (সা.) পৃথিবীতে নবুয়াতি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি একজন শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন এবং তিনি সেকথা স্বীকার ও বাস্তবায়ন করেছেন। নবীর উত্তরসূরি হিসেবে আমাদের মাঝে শিক্ষকসুলভ আচার-আচরণ থাকলে অনেক সমস্যার সমাধান সহজে সম্ভব’। তিনি আরো বলেন, ‘ইসলাম কখনোরই কোনো ধরনের উগ্রবাদকে সমর্থন করেন না। যারা ইসলামের নামে উগ্রবাদ ছড়ায় তারা ইসলামের ভুল ব্যাখা দিচ্ছেন’। তিনি আরো বলেন, ‘এই জরিপের মাধ্যমে প্রমাণিত হলো মাদরাসা শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ (৬৫%) কৌতুহল বা জানার আগ্রহ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে; অন্য কোন উদ্দেশ্য নয়’।
সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার প্রফেসর ড. মো. গোলাম রহমান বলেন, ‘তথ্য খুব সেনসেটিভ একটি বিষয়। ইন্টারনেটে তথ্য প্রচার-প্রসারে সবার সতর্ক উচিত। এক্ষেত্রে ধর্মবিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টিতে আলেম-উলামাগণকে এগিয়ে আসতে হবে’।
মুভ ফাউন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদনটি হলো– সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সাক্ষরতা বলতে আমরা মূলতঃ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উপস্থাপিত ও প্রকাশিত ডিজিটাল আধেয় বা বিষয়বস্তু (যেমনঃ লেখা, ছবি, অডিও-ভিডিও ইত্যাদি) যথার্থতা এবং দায়িত্বশীলতার সাথে ব্যবহার করার জ্ঞান ও সক্ষমতাকে বুঝে থাকি। বাংলাদেশের তরুণদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের প্রবণতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বয়স ও শিক্ষার ধরন অনুযায়ী ব্যবহার প্রবণতা ও সাক্ষরতায় তারতম্য দেখা যায়। তাদের কাছে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হলো ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার ইত্যাদি। এই পরীক্ষামূলক গবেষণায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাদরাসার শিক্ষার্থীদের সাক্ষরতার অবস্থা দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে কওমি ও আলিয়া উভয় ধরনের মাদরাসার ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের বয়স ১৬ থেকে ২২ বছরের মধ্যে, যারা মাধ্যমিক এবং এর উপরের লেখাপড়া করছে। দেশের ১২টি জেলার (ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, রাজশাহী, সিলেট, হবিগঞ্জ, বরিশাল, ভোলা, গাইবান্ধা ও পঞ্চগড় ) ৩৬টি মাদরাসার (২৩টি কওমি ও ১৩টি আলিয়া) ৮২৫জন ছাত্র-ছাত্রীর অংশগ্রহণে মুভ ফাউন্ডেশন এই জরিপ চালিয়েছে। গবেষণার লক্ষ্য ছিল সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবেশের মাধ্যম, দৈনিক ব্যবহারের মাত্রা, পছন্দকৃত বিষয়, পোস্ট করা বা শেয়ার করার প্রবণতা, উগ্রবাদ ও সাইবার অপরাধ এবং এ সংক্রান্ত আইনি বিধান বিষয়ে অংশগ্রহণকারীদের জ্ঞান সম্পর্কে ধারণা লাভ করা।
০ উত্তরদাতাদের মধ্যে ৭৫% বাড়িতে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তথ্য- প্রযুক্তি মাধ্যম ব্যবহারের সুযোগ পায় (৬৩% মোবাইল। বা ট্যাবলেট এবং ১২% কম্পিউটার ব্যবহার করে)। মাত্র ৫ শতাংশ ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে (ইউডিসি) যায় বা এ সম্পর্কে অবগত। বাকিরা সাইবার ক্যাফে (৫%), বন্ধু বা আত্মীয়ের ফোন বা কম্পিউটার এর উপর নির্ভরশীল।
০ ৪২% কওমি ছাত্র এবং ৫৮% আলিয়া ছাত্রছাত্রী ইন্টারনেট সংযোগসহ মোবাইল বা ট্যাবলেট ব্যবহার করে এবং ৫% কউমি ছাত্র ও ১০% আলিয়া ছাত্রছাত্রী ইন্টারনেট সংযোগসহ কম্পিউটার ব্যবহার করে।
০ জরিপে অংশগ্রহণকারী কওমি ছাত্রীদের কেউই কম্পিউটার ব্যবহার করার সুযোগ পায়না, যদিও তাদের শতকরা ৭০ভাগ মোবাইল বা ট্যাবলেট ব্যবহার করে থাকে। এর মধ্যে মাত্র ১.৪ শতাংশ কওমি ছাত্রীর ইন্টারনেট সংযোগ আছে।
০ ছাত্রীদের অধিকাংশই রাতে ও মধ্যরাতের পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে। অন্যদিকে ছাত্রদের অধিকাংশ ব্যবহার করে সকালে ও দুপুরে। ছাত্রদের সিংহভাগ (৩৮%) দৈনিক সর্বোচ্চ ০-৩০ মিনিট করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যয় করে এবং ছাত্রীদের সিংহভাগ (৩৫%) ব্যয় করে দৈনিক ১ থেকে ২ ঘন্টা ।
০ অংশগ্রহণকারী বেশিরভাগ শিক্ষার্থী (৬৫%) কৌতুহল বা জানার আগ্রহ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার। করে; অন্য কোন উদ্দেশ্য, বিতর্ক তৈরি করা বা প্রশ্ন তোলার জন্য নয় । দুই-তৃতীয়াংশর বেশি (৬৭%) ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্ম সংক্রান্ত পোস্ট বা আধেয় দেখে, ১১% বিনোদন, ১৫% খেলাধুলা এবং ৭% রাজনৈতিক বিষয়গুলো লক্ষ করে।
০ কওমি ছাত্রীদের সবচে’ বেশি আগ্রহ ধর্মীয় শিক্ষামূলক বিষয়ে (৯৬%), পক্ষান্তরে কওমি ছাত্র ও আলিয়া শিক্ষার্থীদের বেশি আগ্রহ ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে (যথাক্রমে ৬৬% ও ৫৩%)।
০ শিক্ষার্থীদের সর্বাধিক শেয়ার করা ধর্মীয় শিক্ষামূলক বা ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়াবলী (৭০%); এরপর সামাজিক বিষয় (১৫%), খেলাধুলা ও বিনোদন (১০%) এবং রাজনৈতিক (৫%) বিষয়াবলি শেয়ার করে ।
০ কওমি ছাত্ররা ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়াবলি (৬০%) আর কওমি ছাত্রীরা ধর্মীয় শিক্ষামূলক (৫০%) এবং সামাজিক বিষয় সংক্রান্ত পোস্ট (৫০%) বেশি শেয়ার করে। অন্যদিকে আলিয়ার ছাত্রছাত্রীরা বেশি শেয়ার করে ধর্মীয় শিক্ষামূলক বিষয় (৫৯%), তারপর ধর্ম সংক্রান্ত বিষয় (২০%), সামাজিক বিষয় (১৭%), বিনোদন ও খেলাধুলা (১৫%) এবং রাজনৈতিক বিষয় (৭%)।
০ পোস্ট শেয়ারের উৎস হিসেবে ছাত্রদের সবচেয়ে পছন্দনীয় হলো তাদের বন্ধুদের পোস্ট (৩৯%) এবং ছাত্রীদের হলো। তাদের আত্মীয়ের পোস্ট (৩১%)। উত্তরদাতাদের অনেকেই (৩৫% ছাত্র ও ২৯% ছাত্রী) বিষয়ভিত্তিক লেখক বা সেলিব্রিটিদের পোস্টও শেয়ার করে।
০ উত্তরাদাতা কওমী ছাত্রদের অর্ধেক ও ছাত্রীদের এক-তৃতীয়াংশ এবং আলিয়ার তিন- চতুর্থাংশ ছাত্রছাত্রী পোস্ট শেয়ারের আগে তথ্য যাচাই করার চেষ্টা করে। কওমি ছাত্রদের ৭% একেবারেই যাচাই করে না, ২১% মাঝেমধ্যে করে এবং ২১% বিষয়টি নিয়ে ভাবে কিন্তু যাচাই করে না। ৩৩% কওমি ছাত্রী শেয়ার করার আগে কখনই তথ্য যাচাই করে না এবং অন্য ৩৩% যাচাইয়ের কথা ভাবে বটে, কিন্তু করে না।
০ ৬২% শিক্ষার্থী সাইবার অপরাধ পরিভাষাটির সাথে মোটামুটি পরিচিত এবং বাকিরা অল্প শুনেছে বা আদৌ শোনেনি।
০ সাইবার অপরাধ, যেমনঃ অপপ্রচার, উগ্রবাদী প্রচারণা, চরিত্র হনন ইত্যাদি ও তার সাজা সম্পর্কে কওমি ছাত্রীদের ধারণা খুবই কম ( যথাক্রমে মাত্র ১.৪% ও ২.৭%)। অন্যদিকে কওমি ছাত্রদের যথাক্রমে ৫৭% ও ৪৮% এবং আলিয়া মাদরাসার যথাক্রমে ৭৯% ও ৬৮% শিক্ষার্থী সাইবার অপরাধ ও তার সাজা সম্পর্কে অবগত।
০ সাইবার অপরাদের দণ্ডবিধি সম্পর্কে ৪৭% শিক্ষার্থী খানিকটা অবগত, ২২% এ সম্পর্কে কোন ধারনাই রাখে না এবং ৩% অনলাইন মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধকে শাস্তিযোগ্য বলে মনে করে না। আর ৪% মনে করে সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত আইন ও দণ্ডবিধি বাকস্বাধীনতাকে হরণ করছে।