আইন-বিচার জীবন বিধান ফিচার বিধান

ইসলামে মাদকাসক্তির বিধান ও শাস্তি

সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহতম ব্যাধির নাম মাদক ৷ মাদকাসক্তি আধুনিক সভ্যতার ভয়ংকর ব্যাধিগুলোর অন্যতম। এটি বর্তমান বাংলাদেশের উন্নয়নে বড় বাধা ৷ মাদকের কারণেই আজ অনেক মানুষের জীবন ও পরিবারকে আমরা ধ্বংস হয়ে যেতে দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনেই ৷ এর বিবিধ কুফলের কারণে বিশ্ব কল্যানের ধর্ম ইসলামে মাদক সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ৷

ইসলামে মাদকদ্রব্যের বিধান :  মাদকদ্রব্য সেবনকে ইসলাম সম্পূর্ণরূপে হারাম ঘোষণা করেছে, তা যে নামের হোক বা যেভাবেই গ্রহণ করা হোক ৷ সূরা মায়েদার ৯০- ৯১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেন,  হে মুমিনগণ, এই যে মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য-নির্ধারক শরসমূহ এসব শয়তানের অপবিত্র কার্য বৈ তো নয়। অতএব, এগুলো থেকে বেঁচে থাক-যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও। শয়তান তো চায়, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মাঝে শুত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে দিতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও নামায থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখতে। অতএব, তোমরা এখন ও কি নিবৃত্ত হবে? হাদীস শরীফে রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নেশাসৃষ্টিকারী সকল দ্রব্য হারাম। এটি একটি মুতাওয়াতির হাদীস ৷ হাদীস বিশারদগণের পরিভাষায় মুতাওয়াতির ঐ সকল হাদীসকে বলা হয় যা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত, যা এত যা এত সংখ্যক বর্ণনাকারীর সূত্রে বর্ণিত যে, এতে কোনো প্রকার সন্দেহ সংসংশয়ের অবকাশ থাকে না ৷ (ফতহুল বারী ৩/৭৩)

আল্লাহর রাসূল (সা.) মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করার নির্দেশ দ্য়েছেন, দায়লাম হিরমায়ী বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আরজ করলাম, ‘আল্লাহর রাসূল! আমরা এক ঠান্ডা দেশের অধিবাসী, আমাদেরকে কঠিন প্ররিশ্রমের কাজ করতে হয়, আমরা গম দ্বারা এক ধরণের পানীয় প্রস্তুত করে থাকি যার দ্বারা আমরা কাজের শক্তি পাই ও শীতের মোকাবেলা করি ৷’তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সেটা কি নেশা সৃষ্টি করে? আমি বললাম, জী হাঁ ৷তিনি বললেন, ‘তাহলে বর্জন কর ৷’ আমি বললাম, লোকেরা তা বর্জন করতে প্রস্তুত হবে না ৷ তিনি বললেন, ‘ ত্যাগ না করলে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর ৷’ (আবু দাউদ/৩৬৮৩) এ মর্মে আরো অনেক আয়াত ও হাদীস বর্ণিত হয়েছে ৷

মাদক গ্রহণের শাস্তি : খেজুর, আঙ্গুর, ও কিশমিশের তৈরি মদ গ্রহণকারূ ব্যাক্তি নেশগ্রস্ত হোক বা না হোক, তাকে ৮০ বার বেত্রাঘাত করা হবে এ ছাড়া অন্যান্য যে কোন জিনিস থেকে তৈরি করা নেশাদ্রব্য নেশাগ্রস্ত হওয়ার পরিমাণ গ্রহণ করলে ৮০ বার বেত্রাঘাত করা হবে ৷ হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসূল (সা.) মাদক সেবনের অপরাধে খেজুরের ডাল ও জুতা দিয়ে আঘাত করেন ৷ আর আবু বকর রা: ৪০ বার বেত্রাঘাত করেন ৷ অতপর ওমর (রা.) যখন খলিফা হন, তিনি লোকদের ডেকে বলেন, অনেক লোক পানির উৎসগুলোতে ও গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে, এখন আপনারা মাদক গ্রহণে দন্ড সম্পর্কে কী বলেন? তখন আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) বলেন, আমরা হদের আওতায় লঘু শাস্তি দেয়ার মত দিচ্ছি ৷ সুতরাং এর শাস্তি হিসেবে ৮০ বার বেত্রাঘাত নির্ধারণ করেন ৷ (আবু দাউদ: ৪৪৭৯) বেত্রাঘাতের ক্ষেত্রে মাথা, চেহারা এবং সংবেদনশীল জায়গায় আঘাত করা যাবে না এবং শরীরের একই স্থানে ৮০ টি আঘাত না করে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে আঘাত করবে ৷

শাস্তি প্রয়োগের শর্ত : ইসলামী শরিয়তের বিধান মতে যথাযত তদন্তের মাধ্যমে যদি কারো বিরুদ্ধে স্বেচ্ছায় মাদক গ্রহণের প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে অভিযুক্ত ব্যাক্তির ওপর শরিয়ত কতৃক নির্ধারিত ‘হদ’ বা দন্ড প্রয়োগ করা হবে ৷ মাদক গ্রহণকারী ব্যাক্তি সুস্থ মস্তিষ্কে নিজে মাদক গ্রহণ স্বীকার করার দ্বারাও তার ওপর দন্ড প্রয়োগ করা হবে ৷ (ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ২/১৫৯) অভিযুক্ত ব্যাক্তি প্রাপ্তবয়স্ক, জ্ঞানসম্পন্ন, মুসলিমও হওয়া আবশ্যক ৷ শিশু, বোবা, পাগল ও অমুলিমের ওপর উল্লেখিত ইসলামী দন্ড প্রয়োগ হবে না ৷

মাদকদ্রব্য পাওয়া গেলে তার শাস্তি : যদি কারো কাছে বা ঘরে অথবা দোকানে মাদকদ্রব্য পাওয়া যায় কিন্তু মদ্যপান প্রমাণিত হয়নি, তাহলে তার ওপর ‘হদ’ তথা শরিয়ত কতৃক নির্ধারিত দণ্ড প্রয়োগ করা হবে না ৷ তবে এ ক্ষেত্রে ‘তাজির’ তথা সাধারণ অনির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগ করা হবে ৷ মুসলিম রাট্রপ্রধান সার্বিক বিবেচনায় এদের ওপর কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি প্রয়োগ করতে পারবে ৷ (রদ্দুল মুহতার: ৪/৩৯, খুলাসাতুল ফাতাওয়া: ৩/৩৯)

মাদক গ্রহণে মৃত্যুদন্ড : ইসলামী শরিয়তে মাদক গ্রহণের শাস্তি পূর্ব উল্লেখিত পদ্ধতি হবে ৷ তবে যদি মনে হয় যে, মাদকের মূলুৎপাটনে তা যতেষ্ট হচ্ছেনা, তাহলে মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান সার্বিক বিবেচনায় ভাল মনে করলে মাদকদ্রব্য নির্মূলে ‘তাজির’ হিসেবে শরয়ী পদ্ধতীতে সন্দেহাতিত ভাবে প্রাণিত হলে এরূপ ব্যাক্তিকে মৃত্যুদন্ডাদেশ দিতে পারবেন ৷ এ বিবেচনায় জনসাধারণের কল্যাণে দেশ থেকে মাদকদ্রব্য নির্মূলের উদ্দেশ্যে মাদক ব্যাবসায়ী ও মাদকের ব্যাপক প্রসারকারীকে রাষ্ট্রপ্রধান মৃত্যুদন্ডাদেশ দিতে পারবেন ৷ আর তা যেন অবশ্যই দেশ ও জনগণের কল্যানেই হয়ে থাকে, অযথা নিজস্ব স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য না হয় ৷ পাশাপাশি নির্দোষ ও নীরিহ জনগণ যেন জুলুমের শিকার না হয় ৷ তবে সাধারণভাবে ব্যপক হারে এই অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ড আইন বা বিধান করা যাবে না ৷ (তাকমালা ফতহুল মুলহিম ২/২৫৯, আল আরফুশ শাজি: ৩/১৩৬, তাশরিউল জিনাঈন: ১/৬৮৮, কিতাবুন নাওয়াযিল ১৬/১৩৬)

সবশেষে বলি, মাদক একটি জাতি ও সভ্যতার ঘুর্ণয়মান চাকাকে নিমিষেই থামিয়ে দেয় বরং পিছিয়ে দেয় ৷ এখনই যদি একে থামানো না যায় দেশ জাতির জন্য অপেক্ষা করছে ভয়ঙ্করতম ভবিষ্যৎ ৷ এতএব একে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমেই নির্মূল করতে হবে। আসুন না, মাদকের বিরুদ্ধে আমরা সবাই এক হই, অন্তত:এই একটি ক্ষেত্রে আমরা সবাই দল, মত, নির্বিশেষে সবাই হাতে হাত ধরে কাজ করি।

Comment

লেখক পরিচিতি

মুফতি রহিমুল্লাহ শরীফ

রহিমুল্লাহ শরীফ ৷ জন্ম বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ পৈরসভাস্থ খানকার পাড়ায়৷ প্রাথমিক পড়ালেখা পাড়ার মকতবে। এরপর টেকনাফ মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়ে জামেয়া ইসলামিয়া টেকনাফের হিফজ বিভাগে ৷ হিফজ সমাপ্ত করে হেদায়তুন্নাহু জামাত পর্যন্ত টেকনাফ জামেয়ায় ৷ এরপর ২০০৯ সালে দেশের অন্যতম দ্বীনি প্রতিষ্ঠান জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়া ভর্তি ৷ কাফিয়া জামাত থেকে দাওরা সমাপনি পর্যন্ত জামেয়া পটিয়ায় ৷ ২০১৪/২০১৫ শিক্ষাবর্ষে পটিয়া থেকে মুমতাজ পেয়ে দাওরায়ে হাদিস পাশ করেন।
দাওরায়ে হাদিস শেষ করে ভর্তি হন ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরায় ৷ মুমতাজ দরজা পেয়ে সমাপ্ত করেন ইফতা। বর্তমানে কর্মরত আছেন কক্সবাজার ইলামিক রিসার্চ সেন্টারে মুদাররিস হিসেবে। এর মাঝেই আমি দাখিল, আলিম ও ফাজিল সম্পন্ন করেছেন।

কমেন্টস করুন