‘ইহুদি’ শব্দের সাথে ‘সুদখোর’ শব্দটির গভীর সুসম্পর্ক থাকায় সুদখোর শব্দটিকে ইহুদির প্রতিশব্দ বলা যায়। কারণ, তারা যেসমাজেই বাস করেছে সেখানেই জঘন্য প্রথা সুদ চালু করেছে। এমনকি এ কর্মে তারা অত্যন্ত পাকা হয়ে ওঠে। ফলে তারা সুদখোর জাতি হিসেবেই কুখ্যাতি লাভ করে। সুদের সাথে ইহুদিদের সম্পর্কের ব্যাপারে মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘বস্তুত পূত-পবিত্র বস্তু যা ইহুদিদের জন্য হালাল ছিল তাদের সীমালঙ্ঘন এবং আল্লাহর পথে অনেককে বাধা প্রদানের জন্য আমি তা হারাম করে দিয়েছি। এবং তাদের সুদ গ্রহণের জন্যও, যদিও তা তাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং অন্যায়ভাবে লোকদের ধন-সম্পদ গ্রাস করার জন্য। বস্তুত তাদের মধ্যে যারা কাফির তাদের জন্য তৈরী করে রেখেছি বেদনাদায়ক শাস্তি।’ (সূরা নিসা : ১৬০-১৬১)
প্রখ্যাত মুফাসসির ইবনে কাসীর (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আল্লাহ ইহুদিদেরকে সুদ খাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। অথচ তারা তা খেয়েই চলেছে, গ্রহণ করেছে, এবং তা খাওয়ার জন্য নানান ভন্দি বের করেছে। এমনকি তারা সুদকে ভক্ষণ করতে বিভিন্ন হালাল প্রথার সাথে তার তুলনা করেছে। ইহুদিরা তাদের নবীদের (আলাইহিমুস সালাম) সাথে বিভিন্ন কৌশলের অবতারণা করেছে। নবীদেরকে ধোঁকা দিয়েছে। আল্লাহ কর্তৃক হারামকৃত সুদকে হালাল করতে তাঁদের সাথে প্রতারণা করেছে। আল্লাহ্ সুদকে তাদের প্রতি শুধু হারামই করেননি বরং তা থেকে দূরেও থাকতে বলেছেন। সুদকে হালাল করতে ইহুদিরা যে কৌশল অবলম্বন করেছে তা হলো, তারা পরস্পরের মধ্যে সুদী কারবারকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। আর বলতে থাকে যে, আমরা তো নিজেদের মধ্যে সুদী কারবার করি না। কিন্তু ইহুদি ব্যতীত অন্য ধর্মের লোকদের সাথে সুদী লেনদেনে কোনো সমস্যা নাই বরং তা জায়েজ আছে। এভাবে তারা হারামকে হালাল বানায়।
ইহুদি ধর্মশাস্ত্র প্রতারণা, মুনাফেকি ও সুদের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনে অনুমতি দেয়। সুতরাং তারা বলে থাকে যে, ধোঁকার মাধ্যমে এবং সুদের মাধ্যমে অর্থ কামাই করা বৈধ। তবে তোমার ইহুদি ভাইয়ের সাথে ক্রয়-বিক্রয়ের প্রাক্কালে তাকে ধোঁকা দিও না, তার সাথে প্রতারণাও করি না। শয়তানও তাদেরকে প্ররোচিত করতে থাকে এবং তাদের সাথে খেলা করতে থাকে। আর এ কারণে তারা মনে করে যে, তাদের স্কলাররা যদি কোনো বিষয়কে হারাম করে থাকে তাহলে তা হারাম। আর যদি কোনো বিষয়কে হালাল করে থাকে তাহলে তা হালাল। যদিও সেবিষয় তাদের ওপর প্রবর্তিত বিধান তাদের আসমানী কিতাব ‘তাওরাত’ বিরোধী হয়ে থাকে।
১২১৫ সালে ক্যাথলিক খ্রীষ্টান চতুর্থ ধর্মীয় কনফারেন্স আয়োজন করে। সেসম্মেলনের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল সারা ইউরোপ জুড়ে ইহুদিদের সীমালঙ্ঘন ও বাড়াবাড়ির বিষয়টা। কারণ, সেসময় ইহুদিরা সুদ প্রথার মাধ্যমে অন্যান্য সম্প্রদায়ের তুলনায় সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছিল। ফলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ইহুদিরা অন্যদের তুলনায় শক্তিশালী আর্থিক ভিত গড়ে তুলেছিল। আর একারণেই অনৈতিক ও অবৈধ পদ্ধতি সুদ প্রথা রুখতে ইহুদিরের বিরুদ্ধে ওই সময় নানান শাস্তিমূলক ব্যবস্হা প্রণয়ন করা হয়।
এরপর ১২৭২ সালে ইংল্যান্ডের সম্রাট প্রথম এ্যাডওয়ার্ড সিংহাসনে আরোহনের পর ইহুদিদের সুদচর্চা বন্ধ করতে একটি রুল জারি করেন। অতঃপর ১২৭৫ সালে ইহুদিদেরকে কঠিন নিয়মের আওতায় আনতে তিনি সংসদে অনেক কঠোর শর্তযুক্ত একটি প্রস্তাবনা পাশ করে নেন। যার নাম দেন ‘রেজুলেশনস ফর দ্যা জিউস’। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, সবখানে সুদখোর ইহুদিদের যে শক্তিশালী সুদী প্রভাব রয়েছে তা প্রতিরোধ করা। শুধু খ্রীষ্টানদের ওপর থেকে তাদের প্রভাব মুক্ত করতে নয় বরং গরীর ইহুদিদের ওপর থেকে সুদখোর ইহুদিদের প্রভাব মুক্ত করতেও ওই নীতি প্রণয়ন করা হয়।
চতুর্দশ শতাব্দীতে ইহুদি সুদখোররা প্রথমবারের মত ‘জিমানুল করজ’ তথা ঋণের গ্রান্টর হিসেবে স্পেন-সরকার থেকে জনসাধারণ হতে সরাসরি ট্যাক্স আদায়ের দায়িত্ব পায়। তারা আপাময় প্রজাদের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় করে সরকারি তহবিলে জমা দিত। এসময়ে অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে ইহুদি সুদখোররা সবচেয়ে বেশি বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছিল। টাকা তুলতে গিয়ে প্রয়োজনে তারা শরীরের মাংস কেটে রেখে দিতে কোনো দ্বিধা বা কার্পণ্য করত না। এ কারণে ইহুদিদের বিরুদ্ধে প্রজাদের অন্তর চরম বিদ্বেষে ভরে উঠে এবং তাদের মাঝে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে।
এন্সাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকাতে এসেছে যে, চতুর্দশ শতাব্দীটা স্পেনীয় ইহুদিদের নিকট স্বর্ণযুগ ছিল। কিন্তু ১৩৯১ সালে ফার্নান্দো মেরিটিস নামে খ্রীষ্টান ধর্মযাজকের নৈতিকতামূলক বক্তব্য স্পেনের একটা গ্রামে ইহুদি গণহত্যায় বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিল। সেবক্তব্য ইহুদিদের উপর গণহত্যা চালাতে নেতৃত্ব দিয়েছিল। আর রাজা কর্তৃক ট্যাক্স আদায়ে ইহুদিদের ব্যবহারের কারণে প্রজারা ইহুদিদেরকে চরমভাবে ঘৃণা করত। ১৮৯১ সালে বাসেলে প্রথম ইহুদি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সময়কালে ইউরোপ সমাজে সুদখোর ইহুদিদের চরিত্র ছিল অত্যন্ত ভয়ংকর ও হিংস্র। বিখ্যাত ইংলিশ কবি উইলিয়াম সেক্সপিয়র তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্যা মার্চেন্ট অব ভেনিস’ (১৫৯৬-১৫৯৯)-এ ইহুদি সুদখোর শাইলকের বর্বর চরিত্র তুলে ধরেছেন। সেখানে সুদখোর ইহুদি শাইলক শর্ত আরোপ করে যে, যদি ঋণগ্রহীতা সময়মত দেনা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে তাকে তার শরীরের এক পাউন্ড মাংস কেটে নেওয়ার অনুমতি দিবে।
ইহুদিদের বিশ্বকে শাসন করার পরিকল্পনা স্বরূপ বিখ্যাত বই (১৯০১ সালে লেখা হয়) ‘The Protocols of the Elders of Zion’ যাতে চব্বিশটা প্রোটকল রয়েছে, এর ২০তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, ‘ঋণ হচ্ছে সরকার বা কোনো রাষ্ট্রকে দুর্বল করার প্রথম হাতিয়ার। কেননা, ঋণ যখন সর্বদা তার মাথায় বোঝা হয়ে ঝুলতে থাকবে তখন সে আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে এহসান বা অনুগ্রহ পেতে হাত বাড়িয়ে দেবে।’ এটা ঋণ বলতে সেই ঋণ নয়, এটা হলো বিদেশী ঋণ যা নাম মাত্র সুদে দেওয়া হয়। ধরুন, সুদ ৫% যা বিশ বছরে পরিশোধ করতে হবে। যদি চল্লিশ বছরে পরিশোধ করতে হয় তবে তার দ্বিগুণ হারে পরিশোধ করতে হবে। আর যদি ষাট বছরে পরিশোধ করা হয় তাহলে তিনগুণ হারে পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু মূলধন যা ছিল তাই থাকবে।
একুশতম অধ্যায়ে বলা হয়, ‘আমরা অচিরেই আর্থিক বাজারের পরিবর্তে সরকারি স্টাইলে ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করব। এভাবে সব শিল্প প্রতিষ্ঠান আমাদের অনুগত থাকবে।’ ‘ইহুদিদের এ ধরনের বুদ্ধিভিত্তিক বা ষড়যন্ত্রমূলক চাল একটি রাষ্ট্রকে দেউলিয়া বানিয়ে দিয়ে অবশেষে সে রাষ্ট্রের অর্থনীতির চাকাকে ভেঙ্গে দেয়। কেননা, যখনই সেরাষ্ট্র্ একটা প্রকল্প সমাধান করে এবং ঋণ পরিশোধ করে তখনই আবার নতুন রেটে নতুন সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। এভাবে একটি রাষ্ট্র ইহুদি লাটিমের সাথে ঘুরতে থাকে যা তখনই থেমে যায় যখন রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে যায় এবং দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থাকে অস্থির করে তুলে।’ আর ইহুদিরা বুদ্ধি করে স্বর্ণধাতুকে মুদ্রার মূল্যমান বানিয়েছে এবং মূল্যের মূলভিত্তি বানিয়েছে। আর ইহুদিদের এই পরিকল্পনা বিশ্বব্যাপী আজ প্রচলিত। বাইশতম অধ্যায়ে বলা হয়, ‘বর্তমান সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী সম্পদ সোনা আমাদের হাতে রয়েছে। আর আমরা দুই দিনের মধ্যে বিশ্ববাজার থেকে যেকোনো পরিমাণ স্বর্ণ তুলে নিতে পারি।’ কিন্তু ইহুদিদের বিশ্বের সম্পদ ও স্বর্ণের অধিকারী হয়ে চূড়ান্ত উদ্দেশ্য কী?
ইহুদিরাই এ প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে যে, যতদূর সম্ভব পুরো বিশ্বকে নিজের প্রভাব ও কর্তৃত্বের আওতায় নিয়ে আসা। ইহুদিদের উক্তি যে, যুগ যুগ ধরে যে স্বর্ণ আমরা জমা করে রাখছি। তা অবশ্যই আমাদেরকে আমাদের মূল লক্ষ্য পৃথিবীকে শাসন করতে সহযোগিতা করবে। এজন্যই বিশ্বঅর্থের ওপর ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণ। শক্তিশালী ও বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা তাদেরই, ব্যাংকগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণে, বিভিন্ন কলকার-কারখানা তাদের নিয়ন্ত্রণে, স্বর্ণ তাদের নিয়ন্ত্রণে এবং সম্পদও তাদের হাতে। আর মানুষতে সম্পদের দাস। সুতরাং মানুষ সম্পদশালীদের দাসে রূপান্তরিত হয়েছে।
সূত্র : আকসাঅনলাইন.ওআরজি
কমেন্টস করুন