ইবাদত বেসিক ইসলাম

সালাতুত তাসবীহ কেন পড়বেন এবং কীভাবে পড়বেন?

লিখেছেন মিরাজ রহমান

সালাতুত তাসবীহ একটি বিশেষ নামাজ। অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ নফল আমল। নামাজটিতে বার বার বিশেষ একটি তাসবীহ পাঠ করতে হয় বলেই পরিভাষায় একে ‘সালাতুত তাসবীহ’ বলা হয়।  হাদিসের বর্ণনা থেকে জানা যায়, রাসুল (সা.) বলেছেন, এই নামাজটি আদায় করলে আল্লাহ তাআলা বান্দার আগের-পরের, পুরাতন-নতুন, ইচ্ছাকৃত-অনিচ্ছাকৃত, সগিরা-কবিরা এবং গুপ্ত-প্রকাশ্য সব প্রকার গোনাহ মাফ করে দেবেন।  সালাতুত তাসবীহ নামাজের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে নামাজ আদায়ে পদ্ধতি বর্ণনা করার পর আপন চাচাকে সম্মোধন করে রাসুল (সা.) বলেছেন, যদি সম্ভব হয় তাহলে প্রতিদিন একবার এ নামাজ পড়বেন। যদি প্রতিদিন পড়তে সক্ষম না হন, তাহলে প্রত্যেক জুমআর দিনে একবার পড়বেন। তাও যদি না পারেন তবে প্রত্যেক মাসে একবার পড়বেন। এটাও যদি সম্ভব না হয়, তবে বছরে একবার পড়বেন। তাও যদি সম্ভব না হয়, জীবনে অন্তত একবার হলেও এই নামাজটি পড়বেন।

সালাতুত তাসবীহর নামাজে যে বিশেষ তাসবীহটি পড়তে হয় তা হলো—

سُبْحَانَ اللَّهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ

বাংলা উচ্চারণ— সুবহানাল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াআল্লাহু আকবার।

বাংলা অর্থ হলো— সব পবিত্রতা একমাত্র আল্লাহ মহানের এবং সব প্রশংসাও একমাত্র তার জন্য। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ বা মাবুদ নেই। আল্লাহ সবচেয়ে বড় বা মহান।

সালাতুত তাসবীহ নামাজবিষয়ক বিস্তারিত হাদিসটি হলো— হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবকে (রা.) বলেছেন, হে আব্বাস! হে চাচা! আমি কি আপনাকে দেব না? আমি কি আপনাকে প্রদান করব না? আমি কি আপনাকে সংবাদ দেব না? আমি কি আপনাকে এমন দশটি সৎ গুণ বা তাসবীহের কথা বর্ণনা করব না; যা আদায় করলে আল্লাহ তাআলা আপনার আগের ও পিছনের, নতুন ও পুরাতন, ইচ্ছায় ও ভুলবশত কৃত, ছোট ও বড় এবং গোপন ও প্রকাশ্য সকল গুনাহ মাফ করে দেবেন।

আর সে দশটি সৎ গুণ বা তাসবীহ হলো হলো— আপনি চার রাকাত নামাজ পড়বেন। প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা পড়বেন। এরপর প্রথম রাকাতে যখন কিরাআত পড়া শেষ করবেন তখন দাঁড়ানো অবস্থায় ১৫ বার তাসবীহটি পড়বেন। এরপর রুকুতে যাবেন এবং রুকু অবস্থায় ১০ বার পড়বেন। এরপর রুকু থেকে মাথা ওঠাবেন এবং ১০ বার পড়বেন। এরপর সিজদায় যাবেন এবং সিজদারত অবস্থায় ১০ বার পড়বেন। এরপর সিজদা থেকে মাথা উঠাবেন এবং ১০ বার পড়বেন। এরপর আবার সিজদায় যাবেন এবং সিজদারত অবস্থায় ১০ বার পড়বেন। এরপর সিজদা থেকে মাথা ওঠাবেন এবং ১০ বার পড়বেন। এভাবে প্রতি রাকাতে ৭৫ বার পড়বেন।

আপনি চার রাকাতেই অনুরূপ করবেন। যদি আপনি প্রতিদিন এই নামাজটি আমল করতে পারেন, তবে তা করুন। আর যদি না পারেন, তবে প্রতি জুমাআয় একবার পড়ুন। যদি প্রতি জুমআয় না করেন, তবে প্রতি মাসে বা প্রতি বছরে একবার পড়ুন। আর যদি তাও না করেন তবে জীবনে একবার অন্তত এই নামাজটি পড়ুন। হাদিসটি সুনানে আবু দাউদে ১২৯৭ নং, সুনানে ইবনে মাজায় ১৩৮৭ নং, সহীহ ইবনে খুজাইমায় ১২১৬ নং এবং সুনানে বায়হাকীতে ৪৬৯৫ নং হাদিস হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে। এছাড়া তিরমিজি ও মিশকাত শরীফেও হাদিসটি সঙ্কলিত হয়েছে। আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.), ইমাম সুয়ূতী (রহ.), আল্লামা ওয়াদেয়ী (রহ.) এবং শায়েখ নাসীরুদ্দীন আলবানী (রহ.)সহ বহু বিজ্ঞ আলেম-উলামা এবং হাদিসবিশারদগণ এই হাদিসটিকে হাসান ও সহিহ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

এবার আসুন আমরা সহজভাবে কীভাবে সালাতুত তাসবীহর নামাজ আদায় করবো, তার জরুরি কিছু বিধান ও নিয়ম-পদ্ধতি বিস্তারিতভাবে জেনে নেই।  প্রথমত ভালোভাবে পবিত্রতা অর্জন করার পর অজু করে পবিত্র স্থানে দাঁড়িয়ে নফল নামাজ হিসেবে চার রাকাত সালাতুত তাসবীহ আদায়ের নিয়ত করুন। এরপর স্বাভাবিক নামাজের মতো আল্লাহু আকবার বলে নামাজ শুরু করুন।



প্রথম রাকাতে সুরা ফাতিহা পড়ে তার সঙ্গে অন্য সুরা পড়ুন। এরপর ১৫ বার বিশেষ তাসবীহটি পড়ুন। এরপর রুকুতে গিয়ে রুকুর তাসবীহ পাঠের পর ১০ বার বিশেষ তাসবীহটি পড়ুন। এরপর রুকু থেকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ১০ বার বিশেষ তাসবীহটি পড়ুন। এরপর প্রথম সিজদায় গিয়ে সিজদার তাসবীহ পাঠের পর ১০ বার বিশেষ তাসবীহটি পড়ুন। এরপর সিজদাহ থেকে উঠে বসে ১০ বার বিশেষ তাসবীহটি পড়ুন। এরপর দ্বিতীয় সিজদায় গিয়ে সিজদার তাসবীহ পাঠের পর ১০ বার বিশেষ তাসবীহটি পড়ুন। এরপর দ্বিতীয় সিজদাহ থেকে উঠে দাড়ানোর আগে বসা অবস্থায় ১০ বার বিশেষ তাসবীহটি পড়ে দাঁড়িয়ে যান এবং দ্বিতীয় রাকাত শুরু করুন।

দ্বিতীয় রাকাত হুবহু প্রথম রাকাতের মতো। ব্যতিক্রম হলো দ্বিতীয় সিজদাহ থেকে উঠে তাশাহুদ পড়ার আগে বা পড়ে ১০ বার বিশেষ তাসবীহটি পড়ে দাঁড়িয়ে যান এবং তৃতীয় রাকাত শুরু করুন।

তৃতীয় রাকাত প্রথম রাকাতের হুবহু আদায় করুন।

চতুর্থ রাকাতটি দ্বিতীয় রাকাতের মতোই। ব্যতিক্রম হলো দ্বিতীয় সিজদাহ থেকে উঠে তাশাহুদ, দরুদ শরীফ ও দোয়ায় মাছুরা পড়ার আগে বা পড়ে ১০ বার বিশেষ তাসবীহটি পড়ে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করুন।

বিশেষভাবে খেয়াল রাখুন— প্রতি রাকাতে সুরা ফাতিহা পড়ার দাঁড়ানো অবস্থা ১৫ বার। রুকুতে ১০ বার। রুকু থেকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ১০ বার। প্রথম সিজদায় ১০ বার। সিজদাহ থেকে উঠে বসে ১০ বার। দ্বিতীয় সিজদায় ১০ বার। দ্বিতীয় সিজদা থেকে উঠে বসে ১০ বার। প্রতি রাকাতে ৭৫ বার হিসেবে চার রাকাতে মোট ৩০০ বার বিশেষ তাসবীহটি পড়তে হবে। ফিকাহবিদরা সালাতুত তাসবীহ আদায়ের আরো কিছু পদ্ধতি বাতিয়েছেন কিন্তু এই পদ্ধতিটি উত্তম কারণ এটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।

সালাতুত তাসবীহ নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়ে যেসব বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি, তা হলো— ১. এই নামাজটি আদায় করতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হয় সুতরাং নামাজে দাঁড়ানোর আগে বাসা বা ঘরের শিশুদের নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা করুন এবং নামাজের সময় সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে এমন সব কারণ মিটিয়ে নামাজে দাঁড়ান।  ২. কোনো রাকাতের কোনো স্থানে যদি নির্ধারিত সংখ্যার তাসবীহ পড়তে কম-বেশি হয় তাহলে পরবর্তী যে কোনো রোকনে তা সুধরে নিতে হবে। ৩. কোনো করণে যদি নামাজের কোনো ওয়াজিব ছুটে যায় এবং সেজন্য সাহু সিজদাহ দেওয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে সাহু সিজদায় এবং সাহু সিজদাহর মাঝখানে বিশেষ তাহবীহ পাঠ করতে হবে না। ৪. প্রতি রাকাতের প্রতি রোকনে তাসবীহর সংখ্যা স্মরণ রাখার জন্য আঙ্গুলের কর গণনা করা যাবে না তবে আঙ্গুল চেপে স্মরণ রাখা যেতে পারে। কোনো কোনো ইসলামী বিশেষজ্ঞ বলেছেন, নামাজটি সহিহভাবে আদায়ের উদ্দেশ্যে আঙ্গুল চেপে স্মরণ রাখার অনুমতি যেহেতু রয়েছে সর্তকভাবে আঙ্গুলের করের মাধ্যমে গণনা করলেও সমস্যা হবে না। কারণ নামাজে আঙ্গুলের কর গণনা আমলে কাছির হিসেবে পরিগণিত হয় না। ৫. সালাতুত তাসবীহ নামাজ একাকী পড়ার কথাই হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। জামাতের সাথে পড়ার কোনো প্রমাণ নবীজী (সা.), সাহাবায়ে কেরামের যুগ এবং খাইরুল কুরূন থেকে প্রমাণিত নয়। সুতরাং জামাতে না আদায় করে একা পড়াই উত্তম। ফতওয়ায়ে উসমানী, প্রথম খণ্ডের ৪৪৪-৪৫ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ইসলামী আইনবিশেষজ্ঞ বলেছেন, ইমামসহ মোট ৩জন সদস্য নিয়ে জামাতে সালাতুত তাসবীহ আদায় করা যাবে। তিনজনের অধিক হলে জামাতে এই নামাজ পড়া মাকরুহ হবে।

করোনাভাইরাসে আক্রান্তের আতঙ্কে গোটা বিশ্ব আজ ঘরবন্দী। কার সময় কীভাবে কাটছে— নিজেরাই ভালো জানি। সালাতুত তাসবীহর নামাজ আদায়ের ব্যাপারে খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন রাসুল (সা.)। প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহে, প্রতি মাসে, প্রতি বছর— না হলে জীবনে অন্তত একবার হলেও এই নামাজটি আদায়ের কথা বলেছেন তিনি। সুতরাং চলুন আমার ভাই, প্রস্তুত হোন আমার বোন! আজ এই মুহূর্তে প্রতিজ্ঞা করি— বিপদসঙ্কুল এই সময়ে প্রতি সপ্তাহে একবার এই নামাজটি পড়বো, ইনশা আল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সবাইকে বেশি বেশি সালাতুত তাসবীহ আদায় করার নেক তাওফিক দান করুন। আমিন।

Comment

লেখক পরিচিতি

মিরাজ রহমান

গতানুগতিক ধারার বাইরে থেকে কাজ করে ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন মিরাজ রহমান। পেশায় পুরোদস্তুর একজন সাংবাদিক হলেও কেবল ইসলামকে ঘিরেই আবর্তিত তার ধ্যান-জ্ঞান। দৈনিক পত্রিকার ইসলাম পাতায় লেখালেখি থেকে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন বটে, কিন্তু একসময় শিল্প চর্চায়ও ছিলেন বেশ মনোযোগী।
মিডিয়ায় সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেছেন যখন, তখনও তিনি ছাত্র। মাদানিনগর মাদরাসার কাফিয়া জামাতের (শ্রেণি) শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় কণ্ট্রিবিউটর হিসেবে প্রথম কাজ শুরু করেন দৈনিক যুগান্তরে। ধারালো লিখনী শক্তি অল্পদিনের মধ্যে পরিচিত করে তোলে তাকে। দেশের জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রায় সবগুলোতেই ইসলামবিষয়ক কলাম ও ফিচার লিখেছেন দীর্ঘ সময়। জাতীয় প্রিন্ট মিডিয়াগুলোতে তার অন্তত দুই সহস্রাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
মিরাজ মূলত পড়াশুনা করেছেন কওমি শিক্ষাধারায়, এর পাশাপাশি তিনি জেনারেল শিক্ষাধারায়ও পড়াশুনা করছেন। সহ-সম্পাদক হিসেবে প্রথম যোগদান করেন দৈনিক ডেসটিনি পত্রিকায়। সেখান থেকে দৈনিক কালের কণ্ঠে। দেশে-বিদেশে অনলাইন গণমাধ্যমের জয়যাত্রা শুরু হলে মিরাজ ইন্টারনেট জগতকে ইসলাম প্রচারের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র বিবেচনা করে অনলাইনেই গাঁটছাড়া বাঁধেন। দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইসলামবিষয়ক অনলাইন পোর্টাল প্রিয়.কমের ‘প্রিয় ইসলাম’-এর সৃষ্টি ও পথচলার সূচনা তারই হাতে। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন প্রিয়.কমের প্রিয় ইসলাম বিভাগের এডিটর ইনচার্জ। সর্বশেষ কর্মরত ছিলেন দৈনিক বাংলাদেশের খবরের ফিচার ইনচার্জ হিসেবে।
টেলিভেশনে অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা ও আলোচনার সঙ্গেও ইতিমধ্যে যুক্ত হয়েছেন মিরাজ রহমান। পরিচালনা করেছেন বেশ কিছু অনুষ্ঠানও। এসো কলম মেরামত করি, ছোটদের নবী-রাসূল সিরিজ, তাবলিগী জামাতের পৃষ্ঠপোষক-মুরুব্বি ছিলেন যাঁরা, শরয়ী পর্দার বিধান, আশিক মিন ফিলিস্তিন, নারী তুমি সৌভাগ্যবতী ও হালাল ব্যবসা ও হালাল অর্থনীতির কথকতাসহ বেশ কিছু আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থেও জনক তিনি। বর্তমান তিনি ইসলাম প্রতিদিনের সম্পাদক ও প্রকাশক এবং দ্য সুলতান প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।