জীবনী মুসলিম মনীষী

শেখ সাদি : পথে পথে বেড়ে ওঠা মহামানব

লিখেছেন মনযূরুল হক

জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন ২০১২ সালের ৩০ আগস্ট তেহরান সফরকালে বলেন— নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘের সদর দপ্তরে রয়েছে একটি মহৎ কার্পেট—আমার মনে হয়, জাতিসংঘের সবচে’ বড় কার্পেট সেটি। জাতিসংঘের প্রবেশপথের (আসলে নর্থ ডেলিগেট লাউঞ্জে) দেয়ালে সেঁটে থাকা সেই কার্পেটটি ইরানি জনগণের পক্ষ থেকে দেয়া উপহার বটে; যার মাঝখানে উৎকীর্ণ আছে ইরানের মহাকবি সাদির একটি চমৎকার কবিতা— সব মানুষ এক দেহের অঙ্গসম; যেহেতু সবার প্রথম উপাদান একই। যখন একটি অঙ্গ ব্যথায় আক্রান্ত হয়, বাকি অঙ্গও তখন স্থির থাকতে পারে না। অন্যের দুর্যোগে যদি উদ্বিগ্ন না হও, তবে তোমার নাম মানুষ হতে পারে না।[1]

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০০৯ সালের মার্চ মাসে ইরানের নববর্ষ (নওরোজ) উপলক্ষে সে দেশের জনগণকে ভিডিও টেপের মাধ্যমে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান শেখ সাদির একই কাব্যাংশ কোট করে। তিনি বলেন— এটা ঠিক যে, আমরা নিজেদের মধ্যে কতগুলি বিভাজনের কারণে বিভক্ত হয়ে আছি। তবে আমরা সেই শব্দগুলো মনে রাখতে পারি, যা কবি সাদি লিখে রেখেছেন বহুবছর আগে— আদম সন্তান সবাই এক দেহের বিভিন্ন অঙ্গের মতো, যেহেতু সবাই একই উপাদান থেকে তৈরি।[2]

শেখ সাদির ‘গুলিস্তাঁ’ গ্রন্থে উদ্ধৃত এই কবিতাটির মূল ফার্সি পাঠ হলো—

بنى آدم اعضای یک پیکرند٭٭٭ که در آفرینش ز یک گوهرند

چو عضوى به درد آورد روزگار٭٭٭ دگر عضوها را نماند قرار

تو کز محنت دیگران بیغمی ٭٭٭ نشاید که نامت نهند آدمی 

সন্দেহ নেই কবিতাটি তিনি নবি মুহাম্মাদের স. একটি হাদিসের[3] প্রেরণা থেকে রচনা করেছেন।

ভারতের কংগ্রেসনেত্রী সোনিয়া গান্ধিও শেখ সাদির ‘জন্ম বার্ষিকী’ উপলক্ষে এক বাণীতে বলেছেন— সাদির কবিতা সময় ও ভৌগলিক সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে গোটা মানবতা এবং জাতিগুলোর সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে ভারতীয়রা সব সময়ই সাদির মহতী কবিতা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছে এবং তার কবিতা আমাদের নিত্য-নৈমিত্তিক সমস্যাসহ বড় ধরনের বিপর্যয়ের ক্ষেত্রেও প্রজ্ঞাপূর্ণ দিক-নির্দেশনা ও প্রশান্তির উৎস।[4]

সাদির ‘জন্ম বার্ষিকী’ পালন করা হয় যেহেতু এবং বিশ্ব ব্যাপী ফার্সিকাব্য গবেষণার জন্যে এ দিনে ইরানে আন্তর্জাতিকমানের ‘সাদি পুরস্কার’ও প্রদান করা হয়, তা হলে সেই দিনটি কবে এবং সেটা এপ্রিলের ২১ তারিখে হয় কী করে— আমরা জানি না। কারণ সাদির জন্মসাল নিয়ে ব্যাপক বিভ্রান্তি রয়েছে। মাসের নির্ধারণ তো তার কোনো জীবনীকার করেছেন বলেও দেখা যায় নি। সবচে’ প্রসিদ্ধ মত হলো তিনি ১১৮৪ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।[5]তবে তিনি ইরানের শিরাজ নগরে জন্মগ্রহণ করেছেন। এ কারণে তাকে ‘শিরাজি’ বলা হয়ে থাকে। মনে রাখতে হবে, এখন যাকে ইরান বলা হয়, ত্রয়োদশ শতকেও সে অঞ্চল পারস্য বা পারসিয়া নামে পরিচিত ছিলো।

তার পুরো নাম— আবু মুহাম্মদ মোশাররফ উদ্দিন বিন মোসলেহ উদ্দিন আব্দুল্লাহ সাদি শিরাজি।[6]

সাদি ডাকনামটি তিনি গ্রহণ করেছিলেন— সেলজুকি বংশের পঞ্চম সম্রাট বাদশা মুজাফফর উদ্দিন কুতলুগ খান আবুবকর বিন সাদ বিন জঙ্গির (১২৩১-১২৬০) নাম থেকে। এ বাদশার যুগেই ১২৫৮ সালে কবি ছয় দশক পরে তার জীবনের দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে শিরাজে প্রত্যাবর্তন করেছেন[7] এবং তিনি তখন ইরানি জনগণসহ সাদিকে বিপুল সংবর্ধনা দিয়ে বরণ করেছেন। ইরানে ফেরার পরেই সাদি তার বিখ্যাত গ্রন্থ গুলিস্তাঁ রচনা করেছেন, এবং যতদূর জানা যায়, সাদির বেশিরভাগ রচনা শিরাজে প্রত্যাবর্তনের পরেই রচিত— যুক্তিও সে-কথাই বলে। সুতরাং ‘সাদি’ ডাকনাম গ্রহণও সে-কারণেই যথার্থতা পেয়েছে। সাদি কবি-জীবনে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির প্রশংসা করেছেন। তার মধ্যে রয়েছেন সাদির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু— শামসুদ্দিন মোহাম্মদ ও আলাউদ্দিন আতা মুলক জুয়াইনি। দুজনেই ছিলেন মোঙ্গল আমলের বিজ্ঞ মন্ত্রী। তবে তার সবচে’ প্রশংসনীয় ব্যক্তি ছিলেন এই বাদশাহ—যার নামকে তিনি নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছেন—যদিও সে প্রশংসায় কোনো তোষামোদি কিংবা অতিরঞ্জন নেই। তার রচিত ‘গুলিস্তাঁ’ গ্রন্থটিও বাদশার নামে উৎসর্গ করেছেন এবং দু’টি মর্সিয়াও এঁর মৃত্যুতে পাঠ করেছেন।

সাদির জীবনীকারগণ লিখেছেন— সাদির বাবাও এই বাদশার বাবা সুলতান আতাবক সাদ বিন জঙ্গির দরবারে চাকরি করতেন। কবির বাবা যখন মারা যান তখন তিনি তার শৈশব পার করতে পারেন নি। যার ফলে বাবার তেমন স্মৃতিও তার মনে নেই। যা দু-একটি মনে আছে, সেটুকু অবশ্য তিনি বর্ণনা করতে ভোলেন নি। সুতরাং ঐতিহাসিক সূত্রে তেমন কিছু পাওয়া না গেলেও তার নিজের লেখা থেকে পাওয়া যায়— তিনি যখন নিতান্ত ছোটো তখন তার বাবা লেখার জন্য তাকে একটি ‘স্লেট’ এবং হাতের আঙ্গুলে পরার জন্য একটি আংটি কিনে দেন। কিন্তু এক মিষ্টি বিক্রেতা কবিকে মিষ্টি দিয়ে ভুলিয়ে আংটি নিয়ে চম্পট দেয়। বোঝা যায়— কবি মিষ্টি বেশ পছন্দ করতেন।

একবার ঈদের দিন লোকজনের ভিড়ে শেখ সাদি পিতার জামার প্রান্ত ধরে হাঁটছিলেন, যেনো পিতা থেকে বিচ্ছিন্ন্ হয়ে না যান। কিন্তু পথে খেলাধুলায় মত্ত ছেলেদের দেখে জামার প্রান্ত ছেড়ে তিনি তাদের দেখতে লেগে যান এবং যথারীতি হারিয়ে গিয়ে কাঁদতে থাকেন। পরে তার বাবা তাকে ফিরে পাওয়ার সময় রেগে গিয়ে বলেন— “গাধা, তোমাকে না বলেছিলাম কাপড় ছাড়বে না।” এ ঘটনা কবির হৃদয়ে রেখাপাত করে এবং তিনি সারা জীবনের জন্যে বুঝতে পারেন— বড়দের ‘প্রান্ত’ কখনো ছাড়তে নেই। তা হলেই পথাহারা হবার সম্ভাবনা থাকবে।

আরেকটি ঘটনা থেকে জানা যায়— একবার তিনি বাবার সঙ্গে সারারাত মসজিদে ইবাদত করে কাটিয়ে দিলেন। এ সময় মসজিদে কয়েকজন দরবেশ ঘুমে ছিলো অচেতন। সকালে সাদি তার বাবাকে বললেন— “এই দরবেশদের একজনেরও তাওফিক হলো না জেগে দু-চার রাকাত তাহাজ্জুদ পড়ার। এতোটা গাফেল যে, মনে হয়েছে, মরা লাশ পড়ে আছে।” সাদি বলেন— এ কথা শুনে বাবা আমাকে বেশ ধমকালেন। বললেন— তুমি যদি শুয়ে থাকতে তবে সেটাই বরং এই পরচর্চা থেকে অনেক ভালো কাজ হতো।

পিতার কাছেই তার লেখাপড়ার হাতে খড়ি হয়। সাদির বাবার নাম— সৈয়দ আবদুল্লাহ। মায়ের নাম— মাইমুরা খাতুন।

কৈশরের আগেই বাবা মারা যাওয়ার কারণে কবির ছেলেবেলা কেটেছিলো বাংলার কবি নজরুলের মতোই হাড়-হাভাতে। তার মা তাকে নিয়ে বড় আতান্তরে পড়ে যান। রক্ষাণাবেক্ষণের ভার তার নানার উপর অর্পিত হয় বটে, কিন্তু নানার অবস্থাও স্বচ্ছল ছিলো না। এদিকে স্বভাবকবি বলেই সাদির জ্ঞান তৃষ্ণাও ছিলো প্রবল। মা ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলেন ছেলেকে কিভাবে মানুষ করবেন। এতিম সাদিকে নিয়ে তার মা কতোটা কষ্টে দিনানিপাত করেছেন তা কবি নিজেই বর্ণনা করেছেন— উঠতি যৌবনে বেপরোয়া সময়টাতে একদিন মূর্খতাবশত মায়ের সামনে চিৎকার করে উঠলে মা ব্যথিত হৃদয় নিয়ে ঘরের কোণে বসে থাকেন এবং কাঁদতে কাঁদতে বলেন— মনে হচ্ছে, তুমি তোমার শৈশব ভুলে গেছো, তাই তেজ দেখাচ্ছো।[8]তাকে নিয়ে মায়ের ভাবনার সবচে’ বড় কারণ ছিলো— সাদির অসম্ভব মেধাশক্তি।

তবু আর্থিক অনটন আর মায়ের নি:সঙ্গতার কারণে শেখ সাদির প্রাথমিক শিক্ষা-দীক্ষা শিরাজ নগরেই চলতে থাকে। সৌভাগ্যক্রমে এক ধনী ব্যক্তির সহায়তায় তিনি শিরাজের সুলতান গাসোদ্দৌলা প্রতিষ্ঠিত গাসদিয়া বিদ্যানিকেতনে ভর্তি হতে পারেন। পরবর্তী সময়ে এ শহরেরই আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে তিনি পাঠ গ্রহণ করেন। বাদশা আতাবক জঙ্গিও সে সময়ে কয়েকটি লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকায় দেশের প্রতি ততটা মনোযোগ দিতে পারেন নি। এতে করে দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে, শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হয়— অতএব সাদির জ্ঞানতৃষ্ণা মিটানোর জন্যে অন্য কোথাও, বিশেষ করে বাগদাদের মতো জ্ঞান-শহরে গমন আবশ্যক হয়ে পড়ে। বাদশার পৃষ্ঠপোষকতা নিয়েই সাদি ভর্তি হন সে-সময়ের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ বর্তমান ইরাকের রাজধানী বাগদাদে অবস্থিত নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এখানে অধ্যয়নের খরচ যোগাতেও তাকে প্রথমে হিমশিম খেতে হয়। এসময় তিনি একদিন একটি কবিতা লিখে ভার্সিটির একজন শিক্ষককে—কবি আবুল ফাতাহ বিন জুজিকে—দেন হয়েছে কি না দেখে দিতে। শিক্ষক কবিতা পড়ে মুগ্ধ হন এবং অন্য শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এভাবে অল্প দিনেই তিনি মেধাবী ছাত্র হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন । অধ্যক্ষ আবু ইসহাক শিরাজির কল্যাণে শিক্ষাবৃত্তিও পেয়ে যান। এ সময় সাদির বয়স ছিলো ২১। পরে কবি আবুল ফাতাহ জুজির অনুপ্রেরণায় শেখ সাদি ভাষা শিক্ষায় আগ্রহী হন এবং আরবি, ফার্সি, হিব্রু, গ্রিক, তুর্কি, ল্যাটিন, উর্দু, হিন্দি, সংস্কৃত, আফগানিসহ  অন্তত চব্বিশটি ভাষা শিক্ষা করেন।

নেজামুল মুলক তুসি (মৃ. ৪৫৯ হি.) প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্বখ্যাত বিদ্যাপীঠে ১১৯৫ সাল থেকে নিয়ে ১২২৬ সাল পর্যন্ত তিনি একাডেমিক শিক্ষা অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষায় যখন উর্ত্তীর্ণ হন, তখন তার বয়স তিরিশের কোটা পেরিয়ে যাওয়ার কথা। একই সঙ্গে তিনি শারিয়া, আলকেমি, গভর্নমেন্স, হিস্টোরি, অ্যারাবিক লিটরেচর ও থিওলজি বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন এবং ‘মওলানা’ ডিগ্রি হাসিল করেন।

বাগদাদ তখনও মোঙ্গল তাতারদের আক্রমণ থেকে নিরাপদ ছিলো এবং তিনিও শামসুদ্দিন আবুল ফারাজ আব্দুর রহমান ইবনুল জাওযির রহ. (মৃ. ৫৯৭ হি./১২০০ খ্রি.) মতো জগদ্বরেণ্য ব্যক্তিত্বকে শিক্ষক হিসেবে পেয়ে ধন্য হন। একই সময়ে তিনি সুফিবাদের প্রতিও ঝুঁকে পড়েন। তার রচিত ‘বোস্তাঁ’ গ্রন্থের একটি ঘটনা থেকে জানা যায়— সেকালের খ্যাতনামা সুফি ও তার অন্যতম শিক্ষক শাহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দীর (মৃ. ১২৩৪ খ্রি.) প্রভাবে প্রভাবান্বিত হন তিনি। নিয়মিত সুফিদের সান্ধ্যাকালীন গজলের আসরে উপস্থিত হতেন। প্রিয় শিক্ষক ইবনুল জাওযি রহ. তাকে বারণ করলেও তিনি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করতে না। সাদি লিখেছেন— “একবার এমন একটি আসর আমাকে পেলো, যেখানে গজল পরিবেশনকারীর কণ্ঠ ছিলো অত্যন্ত কর্কশ ও বিশ্রী। গত্যন্তর না থাকায় সারাটা রাত আমাকে সেই জঘন্য সুর শুনে কাটাতে হয়েছে। সকালে এই অপয়া মজলিস থেকে নিস্তার পেতেই আমি পকেট থেকে একটি স্বর্ণমুদ্রা বের করে এবং নিজের মাথার পাগড়ি খুলে শিল্পীকে উপহার দিলাম। সঙ্গীরা অবাক হলে তাদের বললাম— এ লোক নি:সন্দেহে ‘দিলকাশ’ সুফি। প্রিয় শিক্ষকের এতোটা নিষেধাজ্ঞা আমাকে যে শিক্ষা দিতে পারে নি, যা তার অন্তর্ভেদি ‘দাউদি কণ্ঠস্বর’ আমাকে তা দিয়েছে। তাই দিলাম।”[9]

এই প্রতিষ্ঠানে থাকতে আরেকবার তার কয়েকজন সহপাঠী তাকে হিংসা করছে বলে তিনি এই প্রিয় শিক্ষকের কাছে অভিযোগ করেন। শিক্ষক তাকে বলেন— তারা তো তাদের আঞ্জাম বরবাদ করছেই, সাথে তুমিও তা-ই করছো। তারা করছে তোমাকে হিংসা করে আর তুমি করছো তাদের পরচর্চা করে।[10]

তবে অধ্যয়ন সমাপ্ত হবার পরেই তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞান-অর্জনের প্রতি পুরোপুরি মনোযোগ দেন এবং জামালউদ্দিন আবুল ফারাজ আব্দুর রহমান মুতাসের রহ. সান্নিধ্যে পৌঁছেন ও তার কাছে দীক্ষাগ্রহণ করেন। সাদি তাকে অভিভাবক ও শায়খ হিসাবে গ্রহণ করেন।[11]আব্দুল কাদির জিলানির রহ. (মৃ. ৫৬১ হি./১১৬৬ খ্রি.) সান্নিধ্যে গিয়ে সাদি দীক্ষা নিয়েছেন বলে প্রসিদ্ধি রয়েছে।[12] তবে সেই বর্ণনাটি যে গ্রহণযোগ্য নয়, তা স্পষ্টতও বোঝা যায়। কারণ মতভেদ সত্ত্বেও কোনো বর্ণনামতেই সাদির সময়কাল তার সময়কালের সঙ্গে মেলে না। সাদির জন্মসাল যদি ১১৭৫ খ্রিষ্টাব্দও মেনে নেয়া হয়, তবু মানতে হবে, সাদির জন্মের অন্তত ১০ বছর আগে আব্দুল কাদির জিলানির মৃত্যু (১১৬৬ খ্রিষ্টাব্দ) হয়েছে।[13] আফ্লাকির একটি বর্ণনামতে, মহাকবি জালালুদ্দিন রুমির (মৃ. ৬২১হি./১২৩১ খ্রি.) সঙ্গে তার সাক্ষাত হয়েছে।[14]

১২২৬ সালে, লেখাপড়ার পাট চুকাতেই তাকে পথে নামতে হয়। শুরু হয় তার পর্যটক-জীবন। যদিও মাতৃভূমি শিরাজ ও মমতাময়ী মাকে চিরতরে ছেড়ে—যেহেতু কবি কাজী নজরুলের মতোই সাদির মায়ের আর কোনো খবর আমরা জানতে পারি নি এবং তিনি যখন বাগদাদে ফিরেছেন, ততদিনে মা বেঁচে না থাকারই কথা—বাগদাদে আসার সময় থেকেই তার ভ্রমণ শুরু হয়েছে বলে ধরা যায়। সাদিকে পথে নামতে হয়েছে, কারণ চেঙ্গিস খাঁর পৌত্র হালাকু খাঁর তাতার বাহিনী বাগদাদ আক্রমণ করেছে এবং নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে মাত্র কয়েক দিনে মহানগরী পরিণত করেছে মহাশ্মশানে। আক্রান্ত হয়েছে খাওয়ারিজম নগর ও পারস্য। তাই সে পরিস্থিতিতে তার পক্ষে কোনোমতেই স্বদেশে ফেরা সম্ভব হয় নি।

সুবিধা হয়েছে— এতে করে তিনি আধ্যাত্মিক সাধনা, দেশ ভ্রমণ ও কবিতা লেখা একসঙ্গে চালাতে পেরেছেন।

তিনি গেলেন আনাতোলিয়া; যাকে এখন তুরস্কের অন্তর্ভুক্ত ধরা হয়, জায়গাটা একটু নিরাপদই ছিলো। সেখান থেকেও তাকে পালাতে হয়। অতএব সিরিয়ার দামেস্কের দিকে পা বাড়ান তিনি। এখানে তিনি ভালোই ছিলেন। তার বর্ণনায় সে শহরের খরার কথা উল্লেখ রয়েছে।

এর পরে কোনো কারণে দামেস্কের লোকজনের প্রতি বিরাগভাজন হয়ে তিনি আশ্রয় নেন ফিলিস্তিনের জঙ্গলে। অনেকে বলেছেন— ত্রিপোলিতে। সম্ভবত জঙ্গলটি খানিকটা লেবাননের ত্রিপোলির মধ্যে পড়েছে। হেনরি ম্যাসের (Henry Mass) মতে, এই এলাকা ৬১৮ হি./১২২১ খ্রি. সালে খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা অবরোধ করে রেখেছিলো। দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি ক্রুসেডারদের হাতে বন্দি হয়ে পড়েন। অবরোধকারীরা বুলগেরিয়া ও হাঙ্গেরি থেকে ধরে আনা ইহুদি বন্দিদের সাথে কবিকে পরিখা খননের কাজে লাগিয়ে দেয়। হালবের শাসক ছিলেন সাদির বাবার এককালের বন্ধু। একদিন সৌভাগ্যক্রমে তিনি পরিখার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে দেখে চিনতে পারেন এবং এই দুর্দশারা কারণ জানতে চান। সাদি তাকে বলেন— এ হলো দিনবদলের কারিশমা। যে ব্যক্তি একদিন আপনজনদের থেকে বাঁচতে চাইতো, সে পরের ইচ্ছায় আক্রান্ত।

বাবার বন্ধু দশটি দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) মুক্তিপণ দিয়ে তাকে মুক্ত করে আনেন এবং একশত আশরাফি (স্বর্ণমুদ্রা) দেনমোহর ধার্য করে নিজ কন্যার সাথে বিয়ে দেন। মেয়েটি ছিলো অত্যন্ত কঠোর মেজাজের ও বাচাল বটে। সে সাদির জীবনের শান্তি হারাম করে দেয়। ফলে এই বিয়ে বেশিদিন টেকে নি। সে একদিন সাদিকে খোঁটা মেরে বললো— তুমি তো সেই ব্যক্তিটিই, যাকে আমার বাবা দশটি রৌপ্যমুদ্রা কিনে এনেছেন। উত্তরে কবি বললেন— হ্যাঁ, তিনি দশটি রৌপ্যমুদ্রায় কিনে একশ’ স্বর্ণমুদ্রায় আবার বিক্রি করে দিয়েছেন।

কথিত আছে যে, ইয়েমেন ভ্রমণকালে তিনি আবার বিবাহ করেছিলেন।[15]

সম্ভবত বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার পরে তিনি বেশ কষ্টে পতিত হন। এ সময় তাকে সিরিয়াতে আবার কখনো বাইতুল মাকদিসে মানুষকে পানি পান করানোর কাজ করতেও দেখা গেছে।[16]

জেরুসালেমে সফরের সময় বায়তুল মাকদিসে মুসলিমদের সঙ্গে চলমান খ্রিষ্টানদের ক্রুসেড যুদ্ধেও সাদি অংগ্রহণ করেছেন বলে বর্ণনা পাওয়া যায়। এ সময় তার অসাধারণ বীরত্বের কথাও ছড়িয়ে পড়ে। একইভাবে, সে সময় তিনি কবিতা পাঠ করে মুসলিম মুজাহিদদের উদ্দীপ্ত করে তোলার কাজও করেন। যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী জয়ী হলে তাকে ‘গাজী’ উপাধি দেয়া হয়।[17]

সিরিয়া থেকে পরে তিনি হেঁটে যান মিশরে। মিশরের সঙ্গীত, বাজার, সুফি ও অভিজাতকূলের বর্ননা উঠে এসেছে তার লেখায়। তিনি লিখেছেন— “একবার ফাইদ মরুতে ভ্রমণকালে ঘুমের চাপ সালাতে না পেরে পথেই ঘুমিয়ে পড়ি। এক উট-যাত্রী তার উটের নাকিল দিয়ে আমাকে জাগিয়ে বলে—  মরার শখ হয়েছে বুঝি তোমার? এমন অচেতন হয়ে ঘুমাচ্ছো যে, উটের ঘণ্টির শব্দও তোমার কানে ঢুকছে না।

এমনিতে তিনি দৈহিকভাবে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ছিলেন। পায়ে হেঁটে এ ছাড়াও বহু অঞ্চল তিনি ভ্রমণ করেছেন। ফকির-দরবেশের মতো অনেক ক্ষেত্রে খালি পায়েই তাকে চলতে হয়েছে। গুলিস্তাঁয় তিনি লিখেছেন— “আমি কখনো কালের কঠোরতা ও আকাশের নির্মমতার ব্যাপারে অভিযোগ করি নি। তবে একবার নিজেকে ধরে রাখতে পারি নি। কারণ পায়ে তখন জুতা তো ছিলোই না এবং জুতা কেনার মতো অর্থও ছিলো না। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে কুফার মসজিদে গিয়ে উঠলাম। দেখি— একটি লোক শুয়ে আছে যার একখানি পা-ই নেই। তখন খোদাকে শোকর জানিয়ে নিজের খালি পা থাকাও গনিমত মনে করলাম।”

হাঁটতে হাঁটতেই তিনি দেখেছেন— মুসলিম সাম্রাজ্যের শৌর্য-বীর্য, সাথে সাথে পতনের দৃশ্য। তারই সামনে তাতারদের হাতে সাত লক্ষ মুসলিম খুন হয়েছে। খোরাসানের চারটি শহর, বলখ, মরাদ, হেরাত এবং নিশাপুর ধ্বংস হতে দেখেছেন।

বোস্তাঁ গ্রন্থে তার ভারত ভ্রমণের ঘটনা বর্ণিত আছে। তিনি ভারতের সোমনাথ গমন করেছিলেন; সেখানকার প্রসিদ্ধ মন্দিরের দেবমূর্তিটিকে প্রতিদিন রাতে ভক্তদের প্রার্থনার জবাবে হাত উঠাতে দেখে তিনি আশ্চর্যান্বিত হন। এর রহস্য উদঘাটনের জন্য তিনি পূজারীর ছদ্মবেশে কিছুদিন সেখানে অবস্থান করেন। তিনি বলেন—  “আমি পূজারীদের বললাম— এখানে নতুন এসেছি, এ মহান দেবতার পূজাদি কিভাবে দিতে হবে আমাকে শিখিয়ে দিন। পূজারিগণ খুশি হয়ে আমাকে মন্দিরে নিয়ে গেলো। বললো— আজ রাতে তুমি মন্দিরে থাকো, তাহলে দেবতার শক্তি দেখতে পাবে।

আমি সারারাত মন্দিরে কাটালাম। মন্দিরের দরোজা বন্ধ করে মূর্তির নিকট গিয়ে দেখলাম— মূর্তির পিছনে একখানি পর্দার আড়ালে রশি ধরে একজন পূজারী বসে আছে। রশির একদিক মূর্তির সাথে বাঁধা। সে পূজারী যখন রশি ধরে টানে তখনই মূর্তির হাত উপরে উঠে যায় আর সাধারণ লোক তাকেই মূর্তির শক্তি বলে নাচতে থাকে। পূজারী হঠাৎ করেই পর্দার আড়াল আমাকে দেখে ফেললো। আমি তখন প্রাণের ভয়ে তাকে ধরে কূপে ফেলে দিলাম। এরপর সে রাতেই সোমনাথ ছাড়লাম। সমুদ্র পথে অতি কষ্টে হেজাজে এসে পৌছলাম।”[18]

কথিত আছে, সাদি আরও তিনবার ভারতবর্ষে পদার্পণ করেছিলেন। পাঠানরাজ আলতামাসের সময় তিনি কিছুকাল দিল্লিতে অবস্থান করেছিলেন। চতুর্থবার তিনি বিখ্যাত কবি ও গায়ক আমির খসরুকে দেখতেই ভারতে আসেন।[19] সাদি পুবে ভারতের সিন্ধু প্রদেশ অবধি এসেছিলেন। হয়তো ভারতীয় অদ্বৈতবাদী দর্শন একমেবাদ্বীতিয়াম (এক ব্যতীত দুই নাই) তাকে আকৃষ্ট করেছিলো। এরপরে খ্রিষ্টীয় ১৩ শতাব্দির শেষভাগে মুলতানের শাসক যুবরাজ মুহাম্মদ খান শহিদ তার পিতা গিয়াসুদ্দিন বলবনের পক্ষ থেকে শেখ সাদিকে ভারতের আসতে দুইবার আমন্ত্রণ জানান। বয়োবৃদ্ধির কারণে তিনি তখন আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারেন নি। তবে গুলিস্তাঁ ও বোস্তাঁ নিজ হাতে নকল করে তাকে উপঢৌকনস্বরূপ প্রেরণ করেছিলেন।[20]

সমুদ্রপথে তিনি ওমান সাগর, ভারত মহাসাগর, পারস্য উপদ্বীপ, আরব সাগর, লোহিত সাগর ও ভূমধ্য সাগর বহুবার পরিভ্রমণ করেন। এ ছাড়া ইরাক, আজারবাইজান, বসরা, কুফা, ওয়াসেত, রায়, দিয়ারে বকর, তাবরিজ, রাশিয়া ও রোমের (ইটালি) অঞ্চলগুলি দীর্ঘদিন চষে বেড়ান। আফ্রিকায়ও কয়েকবার যেতে হয় তাকে। ইয়েমেনের সানআ নগরি ও মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার কথাও তার গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। ইসপাহানে একবার তিনি তার বাল্যকালের বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ পান, যে তাকে তার জীবনের দুর্দশার কথা ব্যক্ত করেছিলো। অথচ এক সময় বন্ধুটি ছিলো প্রাণবন্ত, যুদ্ধপ্রিয় ও বেশ বিচক্ষণ। শেখ সাদি তাকে জিজ্ঞেস করলেন— কোন জিনিস তোমাকে এমন পুরানো শিয়ালের মত জরাজীর্ণ করেছে? বন্ধু জবাব দিয়েছিলো, মোঙ্গল তাতারদের আক্রমণের কারণে সে নিজের ব্যাপারে এবং অন্যান্য মুসলিম শাসকদের ব্যাপারেও এমন হতাশ হয়েছে, যেখান থেকে কেয়ামত ছাড়া মানুষ আর মুক্তি পেতে পারে না।

সাদি মধ্য এশিয়া সফর করতে করতে দেখেছেন, মোঙ্গল তাতারদের আক্রমণের কারণে এভাবেই মানুষের মনে গভীর হাতাশা নেমে এসেছে। ১২২৬ সাল (৬২০ মতান্তরে ৬২১ হি.) থেকে টানা ৩০ বছর যে সাদি দীর্ঘ পরিব্রাজক জীবন পার করলেন, তা-ও কি মোঙ্গলদের অত্যাচারের ভয়ে?— ঐতিহাসিকেরা কিন্তু তা-ই লিখেছেন। তবে অনেকের আপত্তি থাকলেও পাশ্চাত্যের বহু ঐতিহাসিকের অভিমত— শেখ সাদি ছিলেন ইবনে বতুতার পরে প্রাচ্যের সবচে’ বড় পর্যটক। অবশ্য এ সময় তিনি হেজাজ থেকে রোম হয়ে পায়ে হেঁটে হজেও গমন করেছেন। কমপক্ষে ১৪ বার হজ সম্পন্ন করেছেন তিনি।[21]

১২৫৬ সালে (৬৫৪ মতান্তরে ৬৫৫ হি.) শিরাজে ফিরে এসে মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করেন।[22] দেশে ফিরেলেও থিতু হতে পারেন নি। কারণ শেখ সাদি ততদিনে দেশ বিদেশে বেশ মশহুর হয়ে পড়েছেন। এবং বহু জায়গা থেকে উড়ে আসা নিমন্ত্রণ তাকে গ্রহণ করতে হয়েছে। তাকে শেখ উসমান মারভান্দির (১১১৭-১২৭৪) আমন্ত্রণে তুরস্কে যেতে হয়েছে। আর্মেনিয়া, আবিসিনিয়া, তুর্কিস্থান এবং ভারতের পশ্চিমাংশেও তিনি বিভিন্ন আমির, বাদশা ও মন্ত্রীর আমন্ত্রণ রক্ষার্থে ভ্রমণ করেছেন। যতদিন দুর্বল হয়ে না পড়েছেন, দেখে গেছে কখনো সাধারণ কারো আমন্ত্রণেও তিনি সাড়া দিয়েছেন।

একবার শিরাজ থেকে ১৬ শ’ মাইল দূরে কাশগড়ে বেড়াতে গেলেন একদল যুবকের আমন্ত্রণে। কারণ ততদিনে সেখানে পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে এবং তাতারিদের সঙ্গে খাওয়ারিজমের সুলতানের সন্ধি হয়েছে। সেখানে গিয়ে তিনি দেখলেন ছোট বড় সবাই তার নাম জানে ও তার কাব্য প্রতিভায় মুগ্ধ। সাদি উঠেছিলেন কাশগড়ের জামে মসজিদে। সেখানে একজন ছাত্র ‘মুকাদ্দামায়ে যমখশিরি’ পড়তে গিয়ে বারবার জপ করছে—  যারাবা যাইদুন আমরান (যায়েদ আমরকে মেরেছে)। সাদি ছাত্রটির কাছে গিয়ে বললেন— খাওয়ারিজমের সঙ্গে তার শত্রুর সন্ধি হয়ে গেছে তবু যায়েদ ও আমরের বিবাদ বন্ধ হলো না? ছাত্রটি সাদির কথা শুনে হেসেই খুন। সে জানতে চাইলো, তার দেশ কোথায়? উত্তরে ‘শিরাজ’ শোনামাত্রই সে ধরে বসলো বিখ্যাত কবি সাদির কবিতা তাকে শোনানোর জন্যে। সাদি তাকে বললেন—

اى دل عشاق بدام تو صيد *** ما بتو مشغول وتو بعمر وزيد

হে প্রেমিকদের হৃদয়মণি, তোমর প্রেমের ফাঁদে ফেঁসে গেছি। আমি মগ্ন তোমায় নিয়ে আর তুমি আছো ‘আমর ও যায়েদ’ নিয়ে।

এমন কবিতা শুনে বিষম খেলো ছাত্রটি— তাকে নিয়েই কি সাদি এমন চরণ রচনা করেছে? অগত্যা পাশ থেকে কেউ বলে দিলো, সাদির পরিচয়। ছাত্রটি করজোড়ে কবির কাছে ক্ষমা চেয়ে মিনতি জানালো— কাশগড়ে কয়েকটা দিন থাকলে সে তার সান্নিধ্যে কাটাতো। কিন্তু সাদির তখন অনেক ব্যস্ততা। তখনই তিনি কাশগড় ছেড়ে তাবরিজের উদ্দেশ্যে রওনা করছিলেন।

বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে দেখা করার সময়ও তিনি তাদের পরোক্ষ কিংবা প্রকাশ্যে উপদেশ বিলাতে কসুর করতেন না। তিনি বলতেন— রাষ্ট্রনায়কদের উপদেশ দেবার সাহস তারই আছে, যার মস্তক হারাবার ভয় নেই, গয়না পাবারও বাসনা নেই।

এই রাষ্ট্রনায়কদের কাছে আসা-যাওয়ার সময়েই সাদির লিখিত সেই প্রবাদতুল্য ঘটনাটি ঘটে। অর্থাৎ— সাদি কোনো এক সম্রাটের আমন্ত্রণ রক্ষার্থে রওনা হলেন। পথিমধ্যে রাত হয়ে গেলো। কোনো এক বাড়ির দরোজা খটখটিয়ে তাদের কাছে রাতে থাকার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। তারা কবিকে একটি ছোট্ট ঘর ও সামান্য খাবার দিয়ে আশ্রয় দিলো। পরদিন যথারীতি কবি সম্রাটের কাছে পৌছে গেলেন। সম্রাট তার জন্যে বিপুল আয়োজন করলেন। বিদায় বেলা কবিকে রাজসিক উপঢৌকনও দিলেন, দিলেন একজোড়া মহামূল্য পোশাকও। কবি সেই পোশাক গায়ে চড়িয়েই রওনা করলেন আবার। ঘটনাক্রমে ফেরার পথে পূর্বের স্থানেই রাত হলো। আবারও তাকে সেই বাড়ির দরোজা খটখটিয়ে আশ্রয় প্রর্থনা করতে হলো তাকে। এবারে বাড়ির লোকেরা তাকে যারপরনাই খাতির-যত্ন শুরু করলো। সম্মানজনক শোবার ঘরে ঘুমানোর ব্যবস্থাসহ ভালোমানের আপ্যায়নেরও আয়োজন করলো। কিন্তু খেতে বসে কবি খাবার মুখে না দিয়ে পোশাকের পকেটে পুরতে লাগলেন।  বাড়ির লোকজন কৌতূহল ধরে না রাখতে পেরে কারণটা জিজ্ঞেস করেই ফেললো। কবি বললেন— আগেরবার রাত্রি যাপনের সময় তো এতো আয়োজন ছিলো না, কারণ নিশ্চয় তখন আমার পোশাক দুরস্ত ছিলো না বলেই। আজ তাই এ আয়োজনের হকদার আমি নয়, সম্রাটের দেয়া এই পোশাক। অতএব…।

জতিসংঘের সদর দপ্তরের হল অব নেশন্সের প্রবেশপথে সেঁটে থাকা কবির ‘বনি আদম’ কবিতার মতো আরো কয়েকটি কবিতা বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। তার মধ্যে ‘বালগাল উলা’ আরবি নাতটি মুসলিম বিশ্বের ঘরে ঘরে আপনজনের মতোই পরিচিত—

بلغ العلى بكماله *** كشف الدجى بجماله

حسنت جميع خصاله *** صلوا عليه وآله

অতি উচ্চতা মহিমা মহান পূর্ণগুণজ্ঞানে হে নবি; তব মাধুরীত অমর আঁধার বিদূরিত আজিরে সবি

অতীব সুন্দর তব তোমার সকল আচার ও বিধি; সহস্র সালাম ওপরে তোমার হে রাসুলে আরাবি।

এই শ্বাশত নাতটি নিয়ে একটি প্রবাদ আছে— নাতের তিনটে চরণ তো তিনি সঙ্গে সঙ্গেই রচনা করে করেছেন। কিন্তু চতুর্থ চরণ একাধারে তিন রাত, তিন দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরেও কিছুতেই মিলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। অস্থির হয়ে গেলেন তিনি। এ অবস্থায় চতুর্থদিন পেরিয়ে গেলে তার চোখে ঘুম নেমে আসে। আর স্বপ্নের ভেতর রাসুলের স. দেখা পান। স্বপ্নেই রাসুল স. তার কণ্ঠে নাতটি শুনতে চাইলেন। কবি তার তিনটে চরণ শুনিয়ে দিলে নবিজি স. পূরণ করে দিলেন চতুর্থ চরণ— সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি। ঘুম ভাঙামাত্রই সাদি লিখে ফেললেন এই চরণ।[23]

সাদির নিজস্ব রচনাতেই তার জীবনী ও রচনা সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায়। অধিকাংশ কাসিদা তিনি জীবনের শেষের দিকে রচনা করেছেন মনে করার কারণ হলো, এতে এমন কিছু ব্যক্তি সম্পর্কে ইঙ্গিত রয়েছে, যাদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে দেশ ভ্রমণ থেকে শিরাজে প্রত্যাবর্তনের পর। তবে প্রাচীন গজলসমূহ তার যৌবনকালের বলেই ধরে নেয়া যায়। হেনরি ম্যাস তার প্রবন্ধে সাদির রচনাসমূহের কাল নির্ণয়ের প্রয়াস পেয়েছেন।[24]

আমাদের বাংলা গদ্যের জনক যেমন বলা হয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে, তেমনি ফারসি গদ্যের জনক ধরা হয় কবি শেখ সাদিকে। তিনি প্রথম দিকে কিশোরদের জন্য উপদেশমূলক গল্প-কবিতা লিখতে শুরু করেন। তার ‘গুলিস্তাঁ’ গ্রন্থটি সে কারণেই ছোট ছোট উপদেশ গল্প ও চরণে সাজানো।

সাদি রচিত এ পর্যন্ত মোট ২৪টি গ্রন্থের খোঁজ পাওয়া গেছে। তার মধ্যে সবচে’ বিখ্যাত গ্রন্থ যে গুলিস্তাঁ (The Rose Garden), তা বলাই বাহুল্য। একে তার সবচে’ সুন্দর গদ্য সাহিত্যকর্ম বলা হয়। সম্ভবত বলা চলে এটা সমগ্র সাহিত্য জগতে এক অবিস্মরণীয় অবদান। এ মহাগ্রন্থের এক বিশেষত্ব হলো— শিক্ষণীয় গদ্য কবিতাকারে রচিত এর সমতুল্য অন্য কোনো গ্রন্থ খুঁজে পাওয়া ভার। প্রত্যেকটি কবিতা, বাক্য ও লেখা পদ্যাকারে লিখিত; এক বা একাধিক ফার্সি কবিতার মাঝেমধ্যে রয়েছে আরবি দৃষ্টান্ত।

তার রচিত গ্রন্থের তালিকায় দুই নম্বরে রয়েছে বোস্তাঁ (The Orchard)। তবে যতদূর জানা যায়, এই গ্রন্থটি কবি গুলিস্তাঁর আগেই লিখেছেন। কবি পুস্তকের সমাপ্তির তারিখ ৬৫৫ হিজরি বলে উল্লেখ করেছেন, যা শিরাজে প্রত্যাবর্তনের পূর্বের বছর। গ্রন্থটি নিজ শহরের জন্য উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছিলেন। এ গ্রন্থটিও তিনি গুলিস্তাঁর মতোই আবুবকর বিন সাদ বিন জঙ্গির নামে উৎসর্গ করেছেন। এ গ্রন্থে মূলত পুরোটা জুড়েই ইনসাফ ও মানবাধিকারের কথা বিবৃত হয়েছে।

সাদির বিখ্যাত এ দুটি সাহিত্যকর্মই গদ্য পদ্যের মিশ্রণে রচিত। এ সম্পর্কে তার জীবনী লেখক আফ্লাকি লিখেছেন— He was particularly known for the wry wit he injected into his poems. অর্থাৎ— তিনি তার কবিতায় বিশেষত উইটের প্রয়োগ করেছেন। ‘উইট’ সম্পর্কে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী লিখেছেন— বর্তমানে উইট ও হিউমার উভয়কেই কমিকের প্রজাতি রূপে বিবেচনা করা হয়; কমিক হচ্ছে পাঠক শ্রোতার চিত্তে উৎফুল্লতা, কৌতুক ও হাস্যরস উদ্রেকের জন্য সাহিত্যের যাবতীয় উপাদান। তবে উইট ও হিউমার পূর্বতন সাহিত্য সমালোচনার ইতিহাসে বর্তমানের চেয়ে ভিন্নতর অর্থ বহন করে। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দি পর্যন্ত উইট বলতে বোঝাতো সাহিত্যের বিশেষ বুদ্ধিদীপ্ত উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে; প্রধানত অগতানুগতিক অভিনব চমক জাগানো উপমা নির্মাণের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ দেখা গেছে। এই অর্থের আভাস এখনো পাওয়া যায় half wit (হাবা) nit wit (জড়বুদ্ধি) প্রভৃতি শব্দের মধ্যে।[25] অবশ্য এ দুটি গ্রন্থে অনেক কাব্যাংশে এপিগ্রামের বৈশিষ্ট্যও লক্ষ্য করা যায়। অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত বুদ্ধিদীপ্ত ব্যঙ্গাত্মক প্রশংসাসূচক অথবা জ্ঞানগর্ভ মন্তব্যকে এপিগ্রাম বলা হয়। ইংরেজ কবি আলেকজান্ডার পোপ (১৬৮৮-১৭৪৪) এপিগ্রাম রচনায় ছিলেন সিদ্ধহস্ত।

৩. পান্দনামা। অর্থাৎ— উপদেশগ্রন্থ। সাদির পান্দনামাকে ডি. হাবেল্ট তুলনা করেছেন পিথাগোরাসের ‘গোল্ডেন ভার্সেস’-এর সঙ্গে।[26]গোল্ডেন ভার্সেস এক সময় সমগ্র গ্রিক জগতে বালকগণের নীতিপাঠ্য বলে নির্দিষ্ট ছিল। ৪. রেসালেয়ে কাসায়েদে আরাবি। এ গ্রন্থকে রচনাকালের বিবেচনায় দ্বিতীয় পদ্য গ্রন্থ বলা হয়। এ গ্রন্থের ভাষা আরবি, প্রায় ৭০০ শ্লোক বিশিষ্ট। এতে বাগদাদের খলিফা মুস্তাসিম বিল্লাহর উদ্দেশ্যেও একটি কাসিদা রয়েছে। ৫. রেসালেয়ে কাসায়েদে ফারসি। ফারসি কাসিদা। এ গ্রন্থে আছে আল্লাহর একত্ববাদ ও তার যুগের প্রসিদ্ধ ব্যক্তিবর্গের প্রশংসা বাণী। ৬. মিরাসি। এ গ্রন্থ শোকগাঁথা নিয়ে কয়েকটি কাসিদায় সমৃদ্ধ; যা মুস্তাসিম বিল্লাহ, আবুবকর বিন সাদ বিন জঙ্গি, সাদ বিন আবুবকর, আমির ফখরুদ্দিন আবুবকরের মৃত্যু সম্পর্কে লিখিত। ৭. মোলাম্মায়াত। অর্থাৎ— ভর্ৎসনা। ৮. মোসালসাত। অর্থাৎ— ত্রিকোণমিতি। ৯. তারজিয়াত। অর্থাৎ— স্তবক। ১০. তাইয়্যিবাত। অর্থাৎ— সুগন্ধি, পবিত্রতা। ১১. বাদায়িহ। অর্থাৎ— অভিনব ও বিরলতা। ১২. খাওয়াতিম। অর্থাৎ— সমাপণী ও যবনিকা। ১৩. গাযলিয়াতে কাদিম। অর্থাৎ— পুরাতন গজল। ১৪. কিতয়াত। অর্থাৎ— টুকরো কথা। এতে কয়েকটি আরবি-ফারসি প্রশংসাবাক্য আছে শামসুদ্দিন জুয়াইনি স¤পর্কে। ১৫. হাযলিয়াত। অর্থাৎ— রসিকতা সমৃদ্ধ কবিতার সংকলন। ১৬. রুবাইয়াত। অর্থাৎ— চার চরণবিশিষ্ট কবিতার সংকলন। ১৭. মুফরাদাত। অর্থাৎ— নি:সঙ্গতা। ১৮. রেসালেয়ে দর তাকরীরে দীবাচে। অর্থাৎ— তার বক্তৃতাগুলির একটি সংকলন। ১৯. রেসালেয়ে মাজালেসে পাঞ্জেগানে। এতে রয়েছে সাদির মজলিসি জিকির ও উপদেশাবলি। ২০. রেসালায়ে সাওয়ালে দর সাহেবে দিওয়ান। অর্থাৎ— চিঠিপত্র। দেওয়ান শামসুদ্দিন মুহাম্মদ জুয়াইনির চিঠি ও সাদির উত্তরপত্রের সংকলন। ২১. রেসালায়ে সাওয়ালে সাদ উদ্দিন দর আকল ও এশক। অর্থাৎ— জ্ঞান ও প্রেম সম্পর্কিত চিঠি এবং এ সম্পর্কে সাদির বিভিন্ন উত্তর। ২২. রেসালায়ে নাসিহাতুল মুলুক। অর্থাৎ— সাদির রাজনৈতিক উপদেশাবলি। ২৩. এক হাজার কবিতা সম্বলিত একটি দেওয়ান। ২৪. কুল্লিয়াতে শাইখ। এতে আছে তার গদ্য-পদ্যের সংকলন। এ সকল সাহিত্যকর্ম প্রথমে সাদি নিজেই একত্র করেছেন এবং বিন্যস্ত করেছেন। তবে সাদির মৃত্যুর পরে আলি বিন আহমাদ বিন আবুবকর বিসতুন পুনরায় সুবিন্যস্ত ও একত্র করেন।

এস রুশো বলেন—‘দেওয়ান’ নামে সাদির আরো প্রায় ১০০০ কবিতা আছে, তা আজ পর্যন্ত প্রকাশিত হয় নি। ইউরোপের কোনোও লাইব্রেরিতে তা রক্ষিত থাকতে পারে।[27]

সাদির রচনা সম্পর্কে সাহিত্যসমালোচকদের অভিমত হচ্ছে— তার গদ্য সাধারণ কিন্তু প্রকৃতির মতো অবলীলায় বহমান। এর সহজ ভাষা-প্রবাহের মধ্যকার বাগধারা, প্রতিশব্দ ও অনুপ্রাসের যথাযথ ব্যবহার ভেতরের ছন্দ এবং বাইরের অন্ত্যমিলকে করেছে তুলনাহীন। ইরানের লেখকগণ বছরের পর বছর ধরে চেষ্টা করেও তাকে অতিক্রম করতে পারেন নি, বিদেশি লেখকগণ কী করে তাদের ভাষায় শেখ সাদির সাহিত্য অনুবাদ করবেন? কারণ সাদির গদ্য শৈলী সহজ বটে, কিন্তু অনুকরণ অসম্ভব।

তবে বিদেশি লেখকগণ বাহুমাত্রাতেই তার রচনা অনুবাদ করেছেন। ফার্সি সাহিত্যিকদের মধ্যে শেখ সাদিই লেখাই সর্ব প্রথম ইউরোপের কোনো ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। আন্দ্রে দু রিয়ার (Andre du Ryer) সর্বপ্রথম তার রচনা গুলিস্তাঁর আংশিক অনুবাদ করেন ফ্রেন্স ভাষায় ১৬৩৪ সালে। তারপর অ্যাডাম ওলীরিয়াস (Adam Olearius) দ্রুতই তার অনুকরণে জার্মান ভাষায় সম্পূর্ণ অনুবাদ করেন গুলিস্তাঁ ও বোস্তাঁ। হেগেল তার নন্দনতত্ত্ব নিয়ে লিখেছেন— এটা মানতেই হবে, তার কবিতা অত্যন্ত উচ্চমানের এবং ইসলামি বিশ্বের কবিতাকে তা যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেছে। কবি তার কবিতার চরিত্র মুহাম্মাদি আকারের ভেতর দিয়ে সর্বজনীনতা নিয়ে এসেছেন সুনিপুণ দক্ষতায়। বলতে গেলে ফেরদৌসির মহাকাব্যে যে সুর ধ্বনিত হয়েছে, যে আবেগ ও ভালোবাসার কথা বলেছে, তা সাদির কবিতায় এসে পূর্ণতা পেয়েছে এবং একই সঙ্গে তা সংযুক্ত করেছে নৈতিকতার সুর জীবনের একেকটি সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতাকে সাথে নিয়ে; যেহেতু ভ্রমণ-চর্চায় সাদি একজন পথিকৃৎও। তাই দেখা যায়, জালাল-উদ্দিন-রুমির কল্পদর্শনের বাইরে এসে তিনি একটি ইন্দ্রিয়াতীত অথচ বাস্তবানুগ রসায়ন তুলে ধরতে পেরেছেন অনায়াসে।[28]

বিখ্যাত রাশিয়ান কবি আলেকজান্ডার পুশকিন (Alexander Pushkin) লিখেছেন— as Saadi sang in earlier ages, some are far distant, some are dead.[29]

জ্যেন ডি লা ফোন্টাইন (Jean de La Fontaine) ও বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনও (Benjamin Franklin) গুলিস্তাঁর মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছিলেন।[30] এমনকি র‌্যালফ ওয়াল্ডো এমারসন (Ralph Waldo Emerson) তার কবিতার প্রতি আগ্রহী হয়ে কয়েকটি অনুবাদ সংগ্রহে রেখেছিলেন এবং মুগ্ধ হয়ে নিয়মিত সেগুলো বাইবেলের সঙ্গে তুলনা করে পড়তেন।[31] বিখ্যাত ফরাসি পদার্থবিদ নিকোলাস লিওনার্দ সাদি কার্নটের (Nicolas Léonard Sadi Carnot) নামের তৃতাংশ ‘সাদি’ নামটি তার বাবা লেজার কার্নট (Lazare Carnot) দিয়েছিলেন শেখ সাদির নাম থেকেই বাছাই করে।

শেখ সাদির জীবনীকারগণ তার জীবনকে চার ভাগে ভাগ করে আলোচনা করেছেন। ১. প্রথম ত্রিশ বছর তিনি শিক্ষা অর্জন করেছেন। ২. তারপর ত্রিশ বছর তিনি মানুষের বিচিত্র জীবনকে কাছ থেকে দেখতে প্রাচ্য, ভারতবর্ষ, দূর পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। ৩. এরপর ত্রিশ বছর তিনি অব্যাহত লেখালেখি করেছেন। ভ্রমণের শেষ দিকেও তিনি প্রচুর লিখেছেন। ৪. আর বাকি ত্রিশ বছর, অর্থাৎ শেষ জীবন তিনি কাটিয়েছেন শিরাজে যুগ সংস্কারক বেশে এবং আল্লাহকে পাওয়ার সাধনায়। অর্থাৎ— সাদি সর্বোপির ১২০ বছর জীবিত থেকেছেন।[32] প্রত্যেক লেখকেরই টুকরো টুকরো জীবন ছড়িয়ে থাকে তার সমগ্র রচনায়। সাদির রচনাবলির ক্ষেত্রে সেটা আরো বেশি সত্য।

সাদির নিজের বর্ণনা দ্বারা অবশ্য স্পষ্টই বোঝা যায়— তিনি সুফিবাদ ও এরফানে বিশ্বাসী ছিলেন। সুফিতত্ত্বের নিগুঢ় বিষয়ে তার জ্ঞানও ছিলো সুগভীর। তিনি তার পদ্য ও গদ্য রচনায় নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধকে জাগ্রত ও সমুন্নত করার উদ্দেশ্যে তাসাউফের মর্ম ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাই কবি নামের চেয়ে নীতিশিক্ষক হিসাবে তিনি সুখ্যাতি পেয়েছেন বেশি।[33] তবে কতিপয় বিরুদ্ধাবাদীদের ভাষ্য থেকে শেখ সাদি সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা থেকে খুবই ভিন্ন খবর পাওয়া যায়। দরবেশ ও দার্শনিক শেখ সাদির মধ্যে দেখা মেলে এক ইন্দ্রীয়পরায়ণ পুরুষের, যে কি না পুরুষের প্রেমে পড়ে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে অনেকেই সাদির কবিতার পাশ্চাত্য অনুবাদকে দায়ী করেছেন। কেননা, অবশ্য সাদির দৈহিক প্রেমের ধারণাটিকে ফার্সি সাহিত্যবিশারদদের কেউই ভাবগত প্রেমের বাইরে ব্যাখ্যা করেন নি।[34]

জন্মসালের মতো সাদির মৃত্যুসাল মতপার্থক্য আছে প্রচুর। তবে ১২৯২ খ্রিষ্টাব্দ ও ৬৮২ হিজরিকেই সবচে’ গ্রহণযোগ্য মত বলে অনুমান করা যায়।[35] তবে এতটুকু নিশ্চিত করেই বলা যায়, পারস্যে ততদিনে আতবক বংশের রাজত্বের শেষলগ্ন চলছিলো। তার সমাধি সৌধ—সাদিয়াহ—শিরাজ শহরের পূর্বাংশে রোকনাবাদের স্রোতস্বিনী নদীর ফোয়ারার নিকটবর্তী একবাগানে অবস্থিত। পাহলভি রাজত্বকালে সমাধিটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়।[36]

তথ্যসূত্র


[1] দেখুন জাতিসংঘের নিউজ এজেন্সির সংবাদ— www.un.org/apps/news/infocus/sgspeeches/statments_full.asp?statID=1638#.VtCIzX1951t

[2] হোয়াইট হাউস নিউজ এজেন্সির সংবাদ— www.whitehouse.gov/the_press_office/VEDIOTAPED-REMARKS-BY-THE-PRESIDENT-IN-CELEBRATION-OF-NOWRUZ

[3] সহিহ বোখারি, হাদিস ৫৬৬৬; মুসলিম, হাদিস ২৫৮৬।

[4]  তেহরান রেডিও, ২১/৪/২০১০।

[5] এডওয়ার্ড ব্রাউনের মতে— ১১৮২, আরবেরি বলেছেন— ১১৯১, আর রথন্ট মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর মত হলো— ১১৯৩, আবার কারো মতে— ১১৭৫ সাল। উইকিপিডিয়ায় আছে— ১২১০ সাল। একই কারণে হিজরি সাল নিয়ে মতান্তর হয়েছে। সাধারণত আমাদের দেশে গুলিস্তাঁর যেই ফার্সি কপি পাওয়া যায়, তার ভূমিকায় দেখা গেছে ৫৮৯ হিজরি লেখা। কারো মতে— ৫৭৫, আবার অনেকে তার জন্ম হিজরি সপ্তম শতাব্দির শুরুর দিকে বলেছেন। দেখুন— এনসাইক্লোপিডিয়া ইরানিকার সূত্র : www.iranicaonline.org/articles/sadi-sirazi

[6]  তারিখে আদাবিয়্যাতে ইরান, পৃষ্ঠা ২১০।

[7] তিনি ১১৯৫ খ্রিষ্টাব্দে পারস্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন।

[8] গুলিস্তাঁ, অধ্যায় ৬।

[9] গুলিস্তাঁ, অধ্যায় ২।

[10] তারিখে আদাবিয়্যাতে ইরান, পৃষ্ঠা ২১১-১২।

[11] ইসলামী বিশ্বকোষ, পৃষ্ঠা ৩৬৮।

[12] পারস্য প্রতিভা, পৃষ্ঠা ১১৭।

[13] দৌলতশাহ. পৃষ্ঠা ২০২।

[14] বোস্তাঁ, অনু. Hurt, পৃষ্ঠা ২৩৮।

[15] ইসলামী বিশ্বকোষ, পৃষ্ঠা ৩৬৯।

[16] নফহাতুল উন্স।

[17] পারস্য প্রতিভা, পৃষ্ঠা ১৪০।

[18] শিরুল আজাম, পৃষ্ঠা ৪০।

[19] বরকতুল্লাহ, পৃ. ১২৪।

[20] ইসলামী বিশ্বকোষ, পৃষ্ঠা ৩৬৯।

[21] প্রাগুক্ত।

[22] প্রাগুক্ত।

[23] অগ্রপথিক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত সীরাতুন্নবী স. ১৪১৬ সংখ্যা। এই কবিতা অবলম্বনে নজরুল গেয়েছেন তার বিখ্যাত গান— কুল মখলুক গাহে হজরত; বালাগাল উলা বেকামালিহি/রৌশনীতে আজো ধরা মশগুল; তাই তো ওফাতে করি না কবুল।/হাসনাতে আজও উজালা জাহান; হাসুনাত জমিউ খেসালিহি/নাস্তিরে করি নিতি নাজেহাল; জাগে তাওহিদ দ্বীন-ই কামাল/খুশবুতে খুশি দুনিয়া বেহেশত; সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি। (ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী, আলোকিত বাংলাদেশ, ২৫/৫/২০১৪)

[24] Essaisur le poets Saadi (Paris 1419)

[25] সাহিত্যকোষ, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী।

[26] পারস্য প্রতিভা, পৃষ্ঠা ১৪০।

[27] পারস্য প্রতিভা, পৃষ্ঠা ১৩৯।

[28]  on the Arts translated by Henry Paolucci, 2001, p. 155–157.

[29] Eugene Onegin by Alexander Pushkin.

[30] Yohannan, J. D. Persian Poetry in England and America: A Two Hundred Year History . 1977. New York: Caravan Books. ISBN 978-0882060064, pp. XXV-XXVI

Milani, A. Lost Wisdom. 2004. Washington. ISBN 0-934211-90-6, p. 39

[31] Milani, A. Lost Wisdom. 2004. Washington. ISBN 0-934211-90-6, p. 39

[32]  পারস্য প্রতিভা পৃষ্ঠা ১১৩।

[33]  ইসলামী বিশ্বকোষ, পৃষ্ঠা ৩৬০।

[34] নির্বাচিত প্রবন্ধ: গুলিস্তাঁ থেকে মিরজাফরের নাতি; হাসান ফেরদৌস; সময় প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৮।

[35] এডওয়ার্ড ব্রাউনের মতে— ১২৯১ সালে। উইকিপিডিয়ায় এনসাইক্লোপিডিয়া ইরানিকার সূত্রধরে ‘১২৯১ অথবা ১২৯২’ উল্লেখ করা হয়েছে। অনেকে ৬৯১ হিজরি বলে উল্লেখ করেছেন, কেউ কেউ মনে করেন— তিনি ৮০ বছর বয়সে ৬৯০ হিজরিতে মৃত্যুবরণ করেছেন। আবার অনেকে তার বয়স ১১৬ বছরও উল্লেখ করেছেন।

[36] ইসলামী বিশ্বকোষ, পৃষ্ঠা ৩৭০।


 

Comment

লেখক পরিচিতি

মনযূরুল হক

আমি মনযূরুল হক। সার্টিফিকেটে নাম মো. মনযূরুল হক মোর্শেদ। পেশা ও নেশা লেখালেখি। পড়াশুনার পাশাপাশি কাজ করছি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা নিতান্তই কম না- ৭টি। ২০১৫ সালে সামওয়্যারইনব্লগে সেরা লেখা নির্বাচিত হয়ে পুরুস্কৃত হয়েছি।

কমেন্টস করুন