রূপকথার কাহিনী শুনতাম, নানু এলে প্রতিদিন রাতে রূপকথার আসর বসতো আমাদের বাসায়। বাড়ির বারান্দায় মাদুর পেতে বসতাম সবাই। একে অন্যের গায়ে জড়িয়ে কিংবা কেউ কারো কোলে সিতান দিয়ে বসতাম আমার— আমি, মুক্তা, সুমন আরো অনেকে। পাশের বাড়িতে একজন মানুষের ইনতিকাল হয়েছে আজ। আমার বন্ধু ফয়সালের দাদা। বৃদ্ধা বয়সে মৃত্যু বরণ করেছেন তিনি। খুব ভালো মানুষ ছিলেন। মৃত্যু মানুষদের বিষয় নিয়ে নানুর রূপকথার আসর ছিলো সেদিন। নানু বলছিলেন, এখন আমার কানে স্পষ্ট বাজছে সেই আওয়াজ। নানুর সেই টেনে টেনে কথা বলার ভঙ্গিমা। নানু বলছিলেন, আকাশ থেকে একটি করে তারা খসে পড়ে আর জমিনে একজন মানুষের মৃত্যু ঘটে। একটি করে সেতারার পতন ঘটে এবং একজন মহামানবের বিদায় ঘণ্টা বাজে। এক এক করে সব মানুষ এবং মহামানবরা এভাবেই বিদায় নিবে একদিন। আকাশেরই ঐ তারা আর সেতারার পতনের সাথে মানুষের ইনতিকালের নাকি মিল রয়েছে।
আকাশ থেকে তারা ঝড়ুক কিংবা সেতারা খসুক, গগনপল্লীর ঐ তারকার পতনের সঙ্গে মানবমৃত্যুর কোনো মিল থাকুক আর নাই থাকুক— আজ একজন মহামানব বিদায় দিলেন এই ধরাধাম থেকে। আজ একটি মহান মানবআত্মার প্রস্থান ঘটলো মাটির এই পৃথিবী থেকে। ১৮ মার্চ ২০১৪ ঈসায়ি মঙ্গলবার তাবলিগ জামাতের অন্যতম মুরুব্বি, বিশ্ব তাবলিগ জামাতের আমির মাওলানা যোবায়েরুল হাসান কান্দলভি সাহেব ইহজগৎ ত্যাগ করে মাওলায়ে হাকিকির সান্নিধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬৪ বছর। চলে গেলেন তিনি। ইহলোক ছেড়ে পরলোকে পাড়ি জমালেন। চলে গেলেন এই জমিনের ঐ আসমানে।
কিছু শুভ্র-স্পর্শ থাকে হৃদয় থেকে কখনো যা মোছা যায় না
কিছু কিছু স্মৃতি আছে ভোলা যায়না। কিছু কিছু শুভ্র-স্পর্শ থাকে হৃদয় থেকে কখনো যা মোছা যায় না। মাওলানা যোবায়েরুল হাসান [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] এমন একজন মানুষ, এমন একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন যাঁর সংস্পর্শ-শুভ্রতায় শত হাজার মৃত হৃদয়েও ভালোবাসার ফুল ফুটতো। ইমানিয়াত আর আমলিয়াতের শ্বেত পাখিরা প্রতিযোগিতার এক বিশাল আকাশে ডানা মেলত। বেড়ে যেতো ইমান। বৃদ্ধি পেতো আমলের আগ্রহ-জযবা। একবার যে তাঁর কাছে গিয়েছে, একবার যে মানুষ তাঁর সংস্পর্শে বসেছে নববি আদর্শে আঁকা হুজুরের জীবন-জ্যোতি তাকে আলোকিত করেছে, শুভ্রতার হাতছানিতে ধন্য হয়েছে সে। বিশ্ব তাবলিগ জামাতের আমির এই ব্যক্তির সান্নিধ্যে এসে অসংখ্য-অগণিত অমুসলিম মুসলমান হয়েছে। ইমানের দৌলত লাভ করে জান্নাতি জীবনের পথে ফিরেছেন তারা। কাকরাইল মসজিদ প্রাঙ্গণে কথা হয় একজন নওমুসলিম ভাইয়ের সাথে— মাওলানা যোবায়েরুল হাসান [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর নাম নিতেই অঝোরে কান্না শুরু করে বলেন, ‘আমি অধম মাওলানা সাহেবের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছি। আমার জীবনের সব অর্জন দিয়েও আমি তাঁর ঋণ শোধ করতে পারবো না।’
জন্ম ও পিতার পরিচয়
মাওলানা যোবায়েরুল হাসান কান্দলভি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] ৩০ মার্চ ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের কান্দালায় জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর সম্মানিত পিতা ছিলেন তাবলিগ জামাতের তৃতীয় আমির হজরতজি মাওলানা এনামুল হাসান [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। পিতার হাত ধরেই তাবলিগ জামাতের মাওলানা যোবায়েরুল হাসানের অংশগ্রহণগত সূচনা ঘটে।
শিক্ষকালের দীক্ষানামা
হাফেজ মাওলানা আকসাদ রায়পুরি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর কাছে পবিত্র কোরান শরিফ হিফজ করার মাধ্যমে মাওলানা যোবায়েরুল হাসান [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। হিফজ সম্পন্ন করার পর ফারসি, আরবিসহ আরো বেশ কিছু ভাষা আয়ত্ব করেন তিনি। এরপর কওমি মাদরাসায় হিদায়াতুননাহু, কাফিয়া ইত্যাদি জামাতের প্রাথমিক কিতাবাদির শিক্ষা নিজ গৃহে থেকে বিভিন্ন ওস্তাদের সোহবতে অর্জন করেন। এরপর ১৯৭১ সালে জামেয়া মাজাহিরুল উলূম সাহারানপুর থেকে দাওরায়ে হাদিস জামাত পাশ করার মাধ্যমে পড়াশুনা জীবনের ইতি টানেন মাওলানা যোবায়েরুল হাসান [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]।
বিবাহ-শাদি-সন্তানাদি
১৫ জানুয়ারি ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে মাওলানা ইলিয়াস [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর কন্যা এবং শায়খুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর নাতনী তাহেরা খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন মাওলানা যোবায়েরুল হাসান [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। তিন ছেলে, তিন মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ছিলো তাঁর পারিবারিক সংসার। পারিবারিক জীবনে তিনি ছিলেন একজন সফল অভিভাবক। তাবলিগের কাজে ব্যস্ততার পাশাপাশি সর্তকভাবে পরিচালনা করেছেন ছেলে সন্তান ও কন্যা সন্তানদের। ছেলেদের ইলমি জ্ঞান অর্জন করিয়েছেন এবং কন্যাদের উপযুক্ত পাত্রস্থ করেছে তিনি। তাবলিগ জামাত সম্পর্কে অনেকের মাঝে এমন একটি কথার প্রচলন রয়েছে, তারা বলেন- যারা তাবলিগের সাথে একবার জড়িয়ে যায়, তারা সংসারত্যাগী হয়ে যায়। তাবলিগ জামাত সম্পর্কে এমন ধারণা পোষণ করা একান্ত অজ্ঞতার শামিল বৈ অন্য কিছু নয়। তাবলিগ জামাতের মুরুব্বিরা ছিলেন একেকজন সফল অভিভাক। তাবলিগি কাজের ব্যাপারে তাঁরা যেমন ছিলেন সচেষ্ট ও সর্তক পারিবাকি জীবনেও তাঁরা তেমন সফল ও দায়িত্বশীল ছিলেন। মাওলানা যোবায়েরুল হাসান [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর জীবনেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তাঁর এক ছেলের নাম মৌলভি মুহাম্মাদ জাহিরুল হাসান। দ্বিতীয় জনের নাম মৌলভি মুহাম্মাদ সুহাইব। তৃতীয় ছেলের নাম হাফেজ খুবাইব।
দাওয়াতে তাবলিগের সাথে সম্পৃক্ততা
৯ আগস্ট ১৯৭৪ ঈসায়ি শুক্রবার সর্বপ্রথম মাদরাসায়ে কাদিমের মসজিদে তাবলিগ জামাতের সাথীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন মাওলানা যোবায়েরুল হাসান [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। এই প্রথম তিনি তাবলিগের সাথীদের উদ্দেশ্যে কথা বলেছিলেন। এই সময় থেকেই মূলত তাঁর আনুষ্ঠানিক তাবলিগি জীবনের সূচনা হয়, পিতা বা পারিবারিক সম্পর্ক থাকার কারণে যদিও আরো অনেক আগে থেকেই মাওলানা যোবায়েরুল হাসান [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] তাবলিগ জামাতের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন।
ইসলাহি সম্পর্ক
তাবলিগ জামাতের আমির ছিলেন মাওলানা যোবায়েরুল হাসান [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। লক্ষ-কোটি মানুষের দিশারি ছিলেন তিনি। তাঁর পরামর্শ, তাঁর বাতানো পথে কুরবান ছিলো শত-সহস্র প্রাণ। এতোটা সম্মানিত, এতোটাই উচু মাকামের অধিকারী হওয়ার পরও আত্মশুদ্ধির মেহনত করেছেন মাওলানা যোবায়েরুল হাসান [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। আত্মশুদ্ধির মেহনত শুরু করেছিলেন তিনি পড়াশুনা জীবনের ইতি টেনেই। দাওয়ায়ে হাদিস জামাত শেষ করেই শায়খুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর হাতে বায়আত গ্রহণ করেন মাওলানা যোবায়েরুল হাসান [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮ ঈসায়ি শুক্রবার শাইখুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] তাঁকে পূর্ণ খেলাফত প্রদান করেন। একই সাথে তাবলিগ জামাতের প্রথম আমির মাওলানা ইলিয়াস কান্দলভি [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর সিলসিলায় স্বীয় পিতা হজরতজি মাওলানা এনামুল হাসান [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর থেকেও ইজাযতপ্রাপ্ত হন মাওলানা যোবায়েরুল হাসান [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]।
হামকো মাফ ফরমা, হামারে দোয়াউকো কবুল ফরমা
আয় আল্লাহ হামকো মাফ ফরমা, হামারে দোয়াউকো কবুল ফরমা— টঙ্গীর তুরাগতীরে ভরাট কণ্ঠে হৃদয়ভেজা এমন দোয়া আর শোনা যাবে না। বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে তিনি আর কখনও লাখ লাখ মুসল্লি নিয়ে হাত তুলবেন না। মোনাজাতের আগে দীনের পথে গমনকারীদের উদ্দেশে আর হেদায়াতি ভাষণও তিনি দেবেন না। আর কোনোদিন পরিচালনা করবেন না যৌতুকবিহীন বিয়ের মজলিস। এমন করুণ কণ্ঠে প্রতি ইজতিমায় আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করতেন বিশ্ব তাবলিগ জামাতের আমির, আলমি শুরার অন্যমত সদস্য-মুরুব্বি মাওলানা যোবায়েরুল হাসান [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। বাংলাদেশের মুসলমানদের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক ছিলো মাওলানা যোবায়েরুল হাসানের [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। প্রতি বছর টঙ্গীর তুরাগ তীরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমায় তিনি আসতেন। ইজতেমার বিশেষ আকর্ষণ আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করতেন তিনি। মোনাজাতের আগে তাবলিগের ছয় উসূলের ওপর হেদায়েতি বয়ানও করতেন মাওলানা যোবায়েরুল হাসান [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। তাঁর দরাজ কণ্ঠ, আবেগময় ভাষা এবং সাবলীল উপস্থাপনায় আখেরি মোনাজাত অন্যরকম এক ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করত। তাঁর দোয়ার কারণে হৃদয়ভেজা কান্না আর আমিন আমিন ধ্বনিতে প্রতি বছর মুখরিত থেকো বাংলাদেশের তুরাগতীর।
আলমি শূরার অন্যতম সদস্য, শীর্ষ মুরুব্বি
বিশ্ব তাবলিগ জামাতের অন্যতম নীতিনির্ধারক ছিলেন মাওলানা যোবায়েরুল হাসান [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]। ভারতের নিজামুদ্দিন মারকাজের শূরার অন্যতম শীর্ষ সদস্য ছিলেন তিনি। তাঁর পরিচালনায়ই মূলত পরিচালিত থেকো বর্তমান তাবলিগ জামাতের সকল কার্যক্রম। বিশ্ব তাবলিগ জামাতেরর সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ ছিল তাঁর হাতে। তাবলিগ জামাতের সকল মুরুব্বিদের মুরুব্বি ছিলেন তিনি। কেউ মানুক আর না মানুক, মাওলানা যোবায়েরুল হাসানই [রহমাতুল্লাহি আলাইহি] ছিলেন বর্তমান বিশ্ব তাবলিগ জামাতের রূপকার। আধুনিক জামানার এই ফেতনা-ফাসাদের এই যুগে নববি আদর্শগত নুরানি এক জামাতের রাহবার ছিলেন তিনি। মাওলানা এনামুল হাসান [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর ইনতিকালের পর তাবলিগ জামাতের একক কোনো আমির না থাকার সিন্ধান্ত হয়, শূরা সদস্য দ্বারা পরিচালিত হয় তাবলিগ— তবুও একথাই সঠিক যে, বর্তমান তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বি হিসেবে মাওলানা যোবায়েরুল হাসানকেই মানতেন সবাই। ###