দিবস বিধান

মুহাররম ও আশুরা নিয়ে যা না জানলেই নয়

লিখেছেন মিরাজ রহমান

বছর ঘুরে আবার এসেছে মুহাররম মাস। শুরু হলো নতুন হিজরী বছর— ১৪৪১। ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মুহাররম। মুহাররম মাস ও পবিত্র আশুরা দিনের পরিচয় এবং এ দিনে রোজা পালনের ফজিলত-বিধান এবং করণীয়-বর্জনীয় কিছু বিষয় নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন— মুহাররম মাস ও পবিত্র আশুরা নিয়ে যে সব বিষয় না জানলেই নয়

১. মুহাররম মাসের পরিচয় : ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস— মুহাররম। মুহাররম শব্দটি আরবী, যার অর্থ— পবিত্র, সম্মানিত। প্রাচীনকাল থেকে মুহাররম মাসটি পবিত্র মাস হিসেবে গন্য। চারটি পবিত্রতম মাসের মধ্যে এটি একটি। এ মাসের দশম দিনকে আশুরার দিন বলা হয়।

আল্লাহ মহান পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস ১২টি । তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অবিচার করো না। (সুরা- তওবা, আয়াত-৩৬)

হজরত আবু বাকরাহ (রা.) নবী করীম (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, বছর হলো বারোটি মাসের সমষ্টি। তার মধ্যে চারটি মাস অতি সম্মানিত। তিনটি পর পর লাগোয়া, সেগুলো হলো— জিলকদ,  জিলহজ ও মুহররম আর চতুর্থটি হলো রজব। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৯৫৮)

২. পবিত্র আশুরার দিবস পরিচিতি : ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিবস— পবিত্র আশুরা। ইসলামিক পঞ্জিকা অনুযায়ী মুহাররম মাসের দশম দিনকে আশুরা বলা হয়। ইসলাম ধর্ম অনুসারীদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন এই আশুরা। আশুরা শব্দটি  আরবী শব্দ ‘আশারা’ থেকে নেয়া হয়েছে। এর অর্থ ১০। মুহাররম মাসের দশম দিন হওয়ার একে আশুরা বলা হয় বলে অনেক ইসলামি স্কলার মন্তব্য করেছেন।

৩. এই দিনে কি কি ঘটেছিল? পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই এই দিনে সংঘটিত হয়েছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা। বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে পাওয়া সেসব ঘটনাগুলি হলো—  ১।  আল্লাহ তায়ালা এই দিনেই আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেন। ২। পৃথিবীর প্রথম মানুষ হজরত আদম (আ.) –এর সৃষ্টিও হয়েছে এই দিনে।  ৩। এই দিনেই হজরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়াকে (আ.) দুনিয়ায় প্রেরণ করা হয়। ৪। মহাপ্লাবন শেষ হওয়ার পর হজরত নূহ (আ.) -এর নৌকা এই দিনেই পর্বতে গিয়ে ঠেকেছিল। ৫। হজরত মূসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদেরকে আল্লাহ তায়ালা এই দিনে ফিরাউনের হাত থেকে রক্ষা করেন এবং এই দিনেই লোহিত সাগরে ডুবে মারা যায় ফিরাউন।  ৬। এই দিনেই হজরত আইয়ুব (আ.) দূরারোগ্য অসুখ থেকে পরিত্রাণ পেয়েছিলেন। ৭। হজরত ঈসাকে (আ.) এই দিনেই ঊর্ধাকাশে উঠিয়ে নিয়েছিলেন আল্লাহ তায়ালা। ৮। হজরত ইউনূস (আ.) এই দিনে মাছের পেট থেকে মুক্তি লাভ করেন।  ৯। এই দিনেই হজরত ইউসুফ (আ.) ও তাঁর পিতা হজরত ইয়াকুব (আ.) -এর সাক্ষাৎ হয়। ১০। কারবালার ময়দানে এই দিনে হজরত হোসাইন (রা.) তাঁর সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে নির্মমভাবে শাহাদাৎ বরণ করেন।

৪. এই দিনে কি কি ঘটবে? ১। এই দিনে কেয়ামত সংঘঠিত হবে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, কিয়ামত হবে মুহাররম মাসের দশ তারিখ আশুরার দিন শুক্রবার এবং তা হবে মাগরিবের সময়। ২। কোনো কোনো বর্ণায় পাওয়া যায়, ইমাম মাহদীর আগমন ঘটবে এই দিনে। ৩। এই দিনেই দাজ্জালের আর্বিভাগ ঘটবে।  ৪। ইয়াজুজ-মাজুজের আগমন ঘটবে এই দিনে। ৫। ইসলামী স্কলারদের মতে, এই দিনে হজরত ঈসা (আ.)-এর পূনঃআগমন ঘটবে।

আশুরার দিনে সংঘঠিত ঘটনা এবং সংঘঠিতব্য বিষয়াবলী সম্পর্কে আল্লামা ইবনুল জাওজি (রহ.) তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মাওজুআতু ইবনে জাওজি’-তে বলেন, আশুরার দিনে সংঘটিত ঘটনাবলি এবং সংঘঠিতব্য বিষয়াবলীর আলোচনা বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। তা সত্ত্বেও ইতিহাসের উপাদান হিসেবে এসব ঘটনার আবেদন ও গুরুত্ব কম নয়।



৫. যেভাবে এলো এ দিবসে রোজা পালনের বিধান : ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনা হিজরত করেন, তখন ইয়াহুদিদের মুহাররমের ১০ তারিখে রোজা রাখতে দেখেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা এদিনে রোজা রাখো কেনো? তারা বললো, এটা আমাদের মুক্তি দিবস। মহান আল্লাহ এদিন মুসা (আ.) ও তাঁর সম্প্রদায়কে মুক্তি দিয়েছেন এবং ফেরাউনকে তার দলবলসহ সাগরে নিমজ্জিত করেছেন। এর শুকরিয়া স্বরূপ হজরত মুসা (আ.) এদিন রোজা রেখেছেন। একই কারণে আমরাও রাখি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমরা তোমাদের অপেক্ষা মুসার অধিকতর আপন ও হকদার। অতঃপর তিনি নিজেও এদিন রোজা রাখেন ও সবাইকে রোজা রাখার নির্দেশ দেন। (বুখারি ও মুসলিম)

৬. আশুরার দিবসে রোজা পালনের হুকুম ও ফজিলত : ইসলামী বিধানে আশুরা রোজার গুরুত্ব ও ফজিলত অপরীসীম। রাসুল (সা.) বলেছেন  ‘রমজানের পর আল্লাহর মাস মুহাররমের রোজা সর্বশ্রেষ্ঠ।’ (সহীহ মুসলিম ও জামে তিরমিজি)। এছাড়া রাসুল (সা.) আরো বলেছেন, ‘আমি আশাবাদী যে, আশুরার  রোজা দ্বারা আল্লাহ অতীতের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ মাফ করবেন।’ (সহীহ মুসলিম ও জামে তিরমিজি)। অন্য এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে,  ‘তোমরা আশুরার রোজা রাখ এবং ইহুদীদের সাদৃশ্য ত্যাগ করে আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোজা রাখ। (মুসনাদে আহমাদ)

৭. এ দিবসে করণীয় : একজন মুসলিম হিসেবে আশুরা দিবস উপলক্ষে বিশেষ বিশেষ কিছু করণীয় রয়েছে। আর সেগুলা হলো—

১. আশুরার দিনে রোজা রাখা। তবে এর সাথে ৯ তারিখ বা ১১ তারিখ মিলিয়ে আরো একটি রোজা রাখা। কারণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা আশুরার দিনে রোজা রাখ। তবে এ ক্ষেত্রে ইয়াহুদীদের থেকে ভিন্নতা অবলম্বন করতঃ তোমরা আশুরার পূর্বে অথবা পরের একদিনসহ রোজা রাখবে। (মুসনাদে আহমাদ)

২. এই দিন  বেশী বেশী তাওবা-ইস্তিগফার করা। কারণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, মুহাররম হলো আল্লাহ তাআলার (নিকট একটি মর্যাদাবান) মাস। এই মাসে এমন একটি দিন আছে, যাতে তিনি অতীতে একটি সম্প্রদায়কে ক্ষমা করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অপরাপর সম্প্রদায়কে ক্ষমা করবেন। (তিরমিজি)

৩. দীনের খাতিরে এই দিনে হজরত হুসাইন (রা.) যে ত্যাগ-তিতিক্ষা প্রদর্শন করেছেন তা থেকে সকল মুসলমানের দীনের জন্য যে কোন ধরনের ত্যাগ ও কুরবানী পেশ করার শিক্ষা গ্রহণ করা।

৮. এ দিবসের বর্জনীয় বিষয় : একজন মুসলিম হিসেবে আশুরা দিবসে কিছু কিছু কাজ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। আর সেগুলা হলো—

১. আশুরার দিন ক্রন্দন-বিলাপ করা, বুকে চাপড়ানো, পিঠে চাবুক দিয়ে আঘাত করা, নিজেকে রক্তাক্ত করা ও শোক মিছিল করা— কোনোটিই শরিয়তসম্মত কাজ নয়। কোরআন-হাদিসে এর কোনো ভিত্তি নেই। সুতরাং প্রত্যেক মুসলমানের উচিত এসব কাজ থেকে বিরত থাকা।

২. আশুরার দিন ভালো খাবারের আয়োজন করতে হবে, মুরগি জবাই করতে হবে- এমন ধারণা ও কুসংস্কার আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। ‘এদিন ভালো খেলে সারা বছর ভালো খাওয়া যাবে’-এ জাতীয় কথিত হাদিস শোনা গেলেও মূলত এ ধরনের কোনো বিশুদ্ধ হাদিস পাওয়া যায় না।

৩. আমাদের আরও একটি কথা মনে রাখতে হবে, আশুরা মানে কারবালার ঘটনা নয়; এদিন ঐতিহাসিক অনেক ঘটনা ঘটেছে। কারবালার ঘটনা ওই ঘটনাগুলোর মধ্যে ঐতিহাসিক ঘটনা। যার মধ্যে মুসলমানের অনেক শিক্ষার বিষয় আছে।

 

Comment

লেখক পরিচিতি

মিরাজ রহমান

গতানুগতিক ধারার বাইরে থেকে কাজ করে ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন মিরাজ রহমান। পেশায় পুরোদস্তুর একজন সাংবাদিক হলেও কেবল ইসলামকে ঘিরেই আবর্তিত তার ধ্যান-জ্ঞান। দৈনিক পত্রিকার ইসলাম পাতায় লেখালেখি থেকে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন বটে, কিন্তু একসময় শিল্প চর্চায়ও ছিলেন বেশ মনোযোগী।
মিডিয়ায় সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেছেন যখন, তখনও তিনি ছাত্র। মাদানিনগর মাদরাসার কাফিয়া জামাতের (শ্রেণি) শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় কণ্ট্রিবিউটর হিসেবে প্রথম কাজ শুরু করেন দৈনিক যুগান্তরে। ধারালো লিখনী শক্তি অল্পদিনের মধ্যে পরিচিত করে তোলে তাকে। দেশের জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রায় সবগুলোতেই ইসলামবিষয়ক কলাম ও ফিচার লিখেছেন দীর্ঘ সময়। জাতীয় প্রিন্ট মিডিয়াগুলোতে তার অন্তত দুই সহস্রাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
মিরাজ মূলত পড়াশুনা করেছেন কওমি শিক্ষাধারায়, এর পাশাপাশি তিনি জেনারেল শিক্ষাধারায়ও পড়াশুনা করছেন। সহ-সম্পাদক হিসেবে প্রথম যোগদান করেন দৈনিক ডেসটিনি পত্রিকায়। সেখান থেকে দৈনিক কালের কণ্ঠে। দেশে-বিদেশে অনলাইন গণমাধ্যমের জয়যাত্রা শুরু হলে মিরাজ ইন্টারনেট জগতকে ইসলাম প্রচারের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র বিবেচনা করে অনলাইনেই গাঁটছাড়া বাঁধেন। দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইসলামবিষয়ক অনলাইন পোর্টাল প্রিয়.কমের ‘প্রিয় ইসলাম’-এর সৃষ্টি ও পথচলার সূচনা তারই হাতে। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন প্রিয়.কমের প্রিয় ইসলাম বিভাগের এডিটর ইনচার্জ। সর্বশেষ কর্মরত ছিলেন দৈনিক বাংলাদেশের খবরের ফিচার ইনচার্জ হিসেবে।
টেলিভেশনে অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা ও আলোচনার সঙ্গেও ইতিমধ্যে যুক্ত হয়েছেন মিরাজ রহমান। পরিচালনা করেছেন বেশ কিছু অনুষ্ঠানও। এসো কলম মেরামত করি, ছোটদের নবী-রাসূল সিরিজ, তাবলিগী জামাতের পৃষ্ঠপোষক-মুরুব্বি ছিলেন যাঁরা, শরয়ী পর্দার বিধান, আশিক মিন ফিলিস্তিন, নারী তুমি সৌভাগ্যবতী ও হালাল ব্যবসা ও হালাল অর্থনীতির কথকতাসহ বেশ কিছু আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থেও জনক তিনি। বর্তমান তিনি ইসলাম প্রতিদিনের সম্পাদক ও প্রকাশক এবং দ্য সুলতান প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।