জীবনী স্কলারস

আরবি ক্যালিগ্রাফির জনক কে?

আমরা প্রায়ই একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হই। সেটা হলো—কার মাধ্যমে ক্যালিগ্রাফির মূল যাত্রা শুরু হয়েছে? তিনি হলেন—আবু আলী মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে আল-হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মুকলা আল-বাগদাদী।  সংক্ষেপে ইবনে মুকলা নামে তিনি প্রসিদ্ধ। তাঁর মায়ের নাম ছিল মুকলাহ। তিনি ৮৮৬ ইসায়ীতে বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৯৪০ ইসায়ীতে বাগদাদে মারা যান।

তবে ঐতিহাসিক ও শিল্পবোদ্ধাদের মতে, সত্যিকার চারুকলার বিষয় হিসেবে ক্যালিগ্রাফিকে (ক্লাসিক অর্থে) সুসংহত করেন রাজনীতিবিদ, কবি ও ক্যালিগ্রাফি শিল্পী আবু আলী মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে আল-হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মুকলা আল-বাগদাদী (মৃ. ৯৪০ খ্রি.) এবং তাঁর ভাই ও ক্যালিগ্রাফি শিল্পী আবু আব্দুল্লাহ ইবনে মুকলা (মৃ. ৯৪৯ খ্রি.)। তারা দু-ভাই ক্যালিগ্রাফিকে আনুপাতিক লেখনীতে বিন্যস্ত এবং একে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেন, যেটা ক্যালিগ্রাফির শিল্পমানকে উত্তরোত্তর শানিত করেছে।

ক্যালিগ্রাফির প্রধান ছয়টি শৈলী—সুলুস, নাসখ, মুহাক্কাক, রায়হানী, তাওকী ও রিকার সঠিক পদ্ধতিতে লেখার উদ্ভাবক আবু আলী মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে আল-হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মুকলা আল-বাগদাদী (মৃ. ৯৪০ খ্রি.)। মূলত ক্যালিগ্রাফির সবগুলো শৈলী তাঁর পদ্ধতি অনুসারে লেখা হয়। এ জন্য তাঁকেই ক্যালিগ্রাফির জনক বলা হয়। এ বিষয়ে তাঁর লিখিত কিতাবের নাম হচ্ছে—রিসালাহ ইবনে মুকলা। আর পদ্ধতির নাম হচ্ছে—‘আল-খত আল-মানসুব’।

ইরানী ঐতিহাসিকগণ তাকে পারস্য কর্মকর্তা ও নামের শেষে সিরাজী লিখেছেন। পর পর তিন জন আব্বাসীয় খলিফার সময়ে তিনি গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের চক্রান্তের শিকার হয়ে নির্যাতন ও শাস্তিভোগ করে কারাগারে মারা যান। ক্যালিগ্রাফিতে অসামান্য অবদানের জন্য আরব ঐতিহাসিকগণ তাঁকে আবুল খত ওয়াল খাত্তাত, ইমামুল খাত্তাতীন ওয়া কাওয়ায়িদু খত্তিহ, নাবিউল খত ওয়াল খত্তাতীন উপাধি দিয়েছেন।

কেমন ছিল ইবনে মুকলার ক্যালিগ্রাফি?

বিভিন্ন যুগে বিখ্যাত কবি, ঐতিহাসিক, সাহিত্য ও শিল্প সমালোচকগণ লিখে গেছেন ইবনে মুকলার ক্যালিগ্রাফি নিয়ে অসংখ্য প্রশস্তিগাথা। সেসব কথার মাত্র কয়েকটি তুলে ধরা হলো—

“খত্তুল ওজিরে ইবনি মুকলাহ/বুসতানুন, ক্বলবুন ওয়া মুকাল্লাহ” অর্থাৎ ইবনে মুকলাহর ক্যালিগ্রাফির উপমা হচ্ছে, সেটা পত্রপল্লবিত বাগান, হৃদয় ও সুপেয় ঝরনা। (মরুভূমির লোকেরা ছাড়া সত্যিকার এ উপমা অনুভব করা সম্ভব নয়)।  হিজরী চতুর্থ শতকের বিখ্যাত কবি ইবনে আব্বাদ ইবনে মুকলার ক্যালিগ্রাফিতে মুগ্ধ হয়ে এ কবিতা লেখেন।

বিখ্যাত আরবি শাস্ত্রবিদ ও সাহিত্যিক আবু মনসুর ছালাবি (মৃ. ৪২৯ হি.) বলেন, ‘ইবনে মুকলার ক্যালিগ্রাফির তুলনা সারা দুনিয়ায় বিরল। সত্যিকার ক্যালিগ্রাফি হচ্ছে ইবনে মুকলার ক্যালিগ্রাফি, সেটা যতই দেখা হয় ততই বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়।’

বিখ্যাত শিল্প সমালোচক ইবনে তবাতবা (মৃ. ৭০৯ হি.) বলেন, ‘ইবনে মুকলার ক্যালিগ্রাফির এতটা জনপ্রিয় হয় যে, কুফি শৈলীর যুগের অবসান ঘটিয়ে দেয় ইবনে মুকলার গোলায়িত ধারার ক্যালিগ্রাফি। এরপর একে সুসংহত করেন আরেক বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার ইবনে বাওয়াব।’


রিসালাহ ইবনে মুকলার পৃষ্ঠা। ছবি : সংগৃহীত


বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার ইয়াকুত আল-মুস্তাসিমী তার রচনাসমগ্র মুজামে লিখেছেন, ‘ইবনে মুকলা তাওকি ও রিকা শৈলীতে যে শিল্পমান এনে দিয়েছেন, পৃথিবীতে তার কোনো তুলনা নেই।’

ঐতিহাসিক কলকশান্দি বলেন, ‘ক্যালিগ্রাফিতে হরফের সঠিক পরিমাপ, আকৃতি ও গঠন এবং লিখন-পদ্ধতির যে নীতিমালা ইবনে মুকলা উদ্ভাবন করেছেন, তাতে পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্ত থেকে পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত ক্যালিগ্রাফি ছড়িয়ে পড়েছে ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।’

শিল্প সমালোচক তুর্কি আতিয়া আল-জাব্বুরি বলেন, ‘আরবি ক্যালিগ্রাফির ভিত্তি রচিত হয়েছে ইবনে মুকলার হাতে।’

আরেক শিল্প সমালোচক সুহাইলা আল-জাব্বুরি বলেন, ‘ইবনে মুকলা হচ্ছেন আরবি ক্যালিগ্রাফির প্রথম স্থপতি। তাঁর “আল-খত আল-মানসুব” হচ্ছে আরবি ক্যালিগ্রাফির প্রথম নীতিমালার বয়ান।’

বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার ও গবেষক ইউসুফ জিন্নুন বলেন, ‘ইবনে মুকলা তাওকি শৈলীতে পবিত্র কুরআনের দুটি কপি লিখেছেন, যার কোনো তুলনা নেই। তার শৈলীর উৎকর্ষ অনন্য ও শিল্পোত্তীর্ণ। এ জন্য ক্যালিগ্রাফির জগতে তিনি নবিউল খত উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন।’

ইবনে মুকলার ওস্তাদগণ কারা?

আসলে ইবনে মুকলার পরিবার বাগদাদে একটি সুন্দর ক্যালিগ্রাফি চর্চার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। পারিবারিক ঐতিহ্য হিসেবে তিনি পিতা-মাতার কাছে ক্যালিগ্রাফির প্রথম সবক লাভ করেন। ঐতিহাসিক ইবনে নাদিম বলেন, আমি ইবনে মুকলার দাদার হাতে লেখা পবিত্র কুরআন দেখেছি। সেটা এত সুন্দর ও মনমুগ্ধকর ছিল যে, তা হৃদয়ে গেঁথে আছে। ইবনে মুকলার ক্যালিগ্রাফির বিখ্যাত ওস্তাদ ছিলেন আবুল আব্বাস ছালাব। তিনি ক্যালিগ্রাফিতে ফাসিহ অর্থাৎ স্বচ্ছ ও স্বচ্ছন্দ হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। আরেকজন বিখ্যাত উস্তাদ ছিলেন ইবনে দুরাইদ। তিনি ক্যালিগ্রাফিতে জামহার খ্যাতি পেয়েছেন।

তবে ইবনে মুকলার ক্যালিগ্রাফির আসল উস্তাদ ছিলেন ইসহাক বিন ইবরাহীম আল-আহওয়াল আল-ইয়াযিদী। তিনি তুহফাতুল ওয়ামেক নামক ক্যালিগ্রাফির কিতাব লিখেছেন এবং আব্বাসীয় খলিফা আল-মুকতাদির ও খলিফা-পুত্রদের ওস্তাদ ছিলেন। ইবনে মুকলা তার এই ওস্তাদের কিতাব অনুসরণ করে রিসালাতু ফিল খত্তি ওয়াল কিতাবাহ এবং কিতাবুল কলম গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন।

ইবনে মুকলার পাঁচ পুত্র-সন্তানের কথা জানা যায়। তারা সবাই বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন।

ইবনে মুকলা দুটি কুরআন নকল করেন। এ ছাড়া ত্রিশ পৃষ্ঠার একটি কাব্য “দিওয়ান” রচনা করেন। ঐতিহাসিক ইবনে নাজ্জার তার ইতিহাসগ্রন্থে লিখেছেন, ইবনে মুকলা “ইখতিয়ারুল আশ’য়ার” নামে একটি নির্বাচিত কাব্যমালা লিখেছিলেন। তবে ইবনে মুকলার ক্যালিগ্রাফি বিষয়ক সবচেয়ে বড় গ্রন্থটির নাম হচ্ছে জুমালুল খত। তিনি বাগদাদের পূর্বাংশে দজলা (টাইগ্রিস) নদের শাখানদী নাহরে মুসার তীরে একটি বিশাল ফুল ও খেজুর বাগানের ভেতর প্রশস্ত বাড়িতে বাস করতেন। সেটা ক্যালিগ্রাফি চর্চার একটি বিখ্যাত কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। ঐতিহাসিকগণ বলেন, তিনি এ বাগানবাড়িটি বানাতে দুই লাখ দিনার খরচ করেছিলেন। তবে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পরাজিত হয়ে তিনবার তার এ বাড়িতে আগুন দেয়া হয়। দ্বিতীয়বার খলিফা কাহিরের নির্দেশে বাড়িটি জ্বালিয়ে দেয়া হয় এবং ৩২৪ হি. শেষবার বাড়িতে আগুন দিয়ে ইবনে মুকলার সন্তানদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। এতে ঐ এলাকার লোকেদের মুখে মুখে এ বাড়ির করুণ পরিণতি নিয়ে কবিতা উচ্চারিত হতে থাকে।

ইবনে মুকলা স্পষ্টবাদিতা ও ন্যায়নিষ্ঠার কারণে শাসকদের কোপানলে পড়েন। প্রথমে তাঁর ডান হাত কেটে ফেলা হয়, তখন বাম হাত দিয়ে ক্যালিগ্রাফি কলম ধারণ করে লিখতে থাকেন। এরপর তাঁর বাম হাত কেটে ফেলা হয়। তবু তিনি দমে যাননি। কথিত আছে, সত্যকথন তিনি জিহ্বায় কালি লাগিয়ে লিখতে থাকেন। তখন তাঁর জিহ্বা কেটে তাঁকে মৃত্যুমুখে পতিত করা হয়। ক্যালিগ্রাফির প্রতি তাঁর এই উৎসর্গিত অবদান ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে আছে।ক্যালিগ্রাফিতে এই ক্যালিগ্রাফারের অবিস্মরণীয় খেদমতের কারণে আজ বিশ্বের অগণিত ক্যালিগ্রাফির শিক্ষার্থী সহজে ক্যালিগ্রাফি করার সুযোগ লাভ করেছে।

ওকে/এমএইচ

Comment

লেখক পরিচিতি

মোহাম্মদ আবদুর রহীম

আমি মোহাম্মদ আবদুর রহীম, বাণিজ্য নগরী খুলনার সবচেয়ে বড় মহল্লা টুটপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৬৮ সালের জুন মাসে জন্মেছি। তবে সার্টিফিকেটে তারিখ ভিন্ন। কিছু স্মৃতিতে রাখার আগেই মাকে হারিয়ে চাচির হাতে বড় হয়েছি। তিনি আমাকে মানুষ হতে পথ দেখিয়েছেন, সংগ্রাম করতে ও অধিকার আদায়ের মনোবল জুগিয়েছেন।
পরিবারের ঐতিহ্য অনুযায়ী দীনি ইলিম শিখতে খুলনা আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হয়েছি। শৈশব থেকে ছবি আঁকা ও ক্যালিগ্রাফির প্রতি প্রবল আকর্ষণে খুলনা শিশু একাডেমিতে ও বাশের কঞ্চির কলম দিয়ে মাদরাসার ওস্তাদের কাছে ক্যালিগ্রাফি শিখেছি। ঢাকায় এসে গত শতকের ৯০ দশকের প্রথমদিকে ওস্তাদ শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী (রহ.) কাছে ক্যালিগ্রাফির মূল খতগুলো শেখার পর সনদ লাভ করেছি। এছাড়া তুরস্কের ফেরহাত কারলু, ইরানের আলী ফারাসাতি, সিদাঘাত জাব্বারি ও মাহবুবে পুররহিমীর কাছেও ক্যালিগ্রাফির শিক্ষা লাভ করেছি।
এরপর ২০০৯ ও ২০১০ সালে ইরান ও আলজেরিয়ায় ক্যালিগ্রাফির ফেস্টিভ্যালে সরকারি সফরে গিয়ে পুরস্কার পেয়েছি। ২০১২ ও ২০১৩ সালে আইসেসকো ও ইরসিকা, তুরস্ক থেকে পুরস্কার পেয়েছি। হাজারের বেশি সংখ্যক ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম করা হয়েছে। ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে শতাধিক লেখা পত্রপত্রিকা ও গবেষণা জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ক্যালিগ্রাফি বিষয়ক ছয়টি (একটি ম্যানাসক্রিপ্ট) বই প্রকাশিত হয়েছে। দেশে বিদেশে প্রায় অর্ধশত প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছি। এছাড়া টিভি চ্যানেলে ২০০৮ সালে আমার স্ক্রিপ্টে একটি ক্যালিগ্রাফি ডকুমেন্টারি প্রচারিত হয়েছে। ২০০৬ সালে ক্যালিগ্রাফ আর্ট নামে একটি পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি। দুই দশক ধরে ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে শিক্ষকতা পেশায় আছি। ২০১৮ সালে ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্যকলা থেকে এমফিল ডিগ্রি অর্জন করেছি।
বর্তমানে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে পিএইচ.ডি ফেলো হিসেবে গবেষণা কর্মে রত আছি।