বেসিক ইসলাম রোজা

শাওয়াল মাসের ছয় রোজা রাখবেন যেভাবে

লিখেছেন মিরাজ রহমান

হজরত আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে রমজানের রোজা এবং শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখল সে যেন সারা বছরই রোজা রাখল (পুরস্কারের দিক থেকে)।’ [মুসলিম ]

উপরোক্ত হাদিস প্রসঙ্গে আন নাসাঈ তার ‘সুবুল উস সালাম’ গ্রন্থে বলেছেন, যদি রমজানের ৩০টি রোজার সঙ্গে শাওয়ালের ছয়টি রোজা যুক্ত হয়, তাহলে মোট রোজার সংখ্যা হয় ৩৬টি। শরিয়ত অনুযায়ী প্রতিটি পুণ্যের জন্য ১০ গুণ পুরস্কারের কথা উল্লেখ রয়েছে। তাহলে ৩৬টি রোজা ১০ গুণ পুরস্কারে পরিণত করলে তা ৩৬০টি রোজার সমতুল্য হবে। অর্থাৎ সারা বছরের রোজার সমতুল্য হবে। কোনো কোনো আলেম বলেন, রমজানের শেষে শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখতে হবে, এমন কথা নেই একনাগাড়ে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, শাওয়াল মাসেই ছয়টি রোজা একনাগাড়ে রাখতে হবে এমন কথা নেই। শেষোক্ত মতামতটিই অধিক গ্রহণযোগ্য। অনেকেই প্রশ্ন করেন, যদি শাওয়াল মাসে সময় পাওয়া না যায়, তাহলে ভাঙতি রোজা পূর্ণ না করে আগে শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখার অনুমতি ইসলামে আছে কি-না। শুরুতে বর্ণিত হাদিসটিতে ‘সুম্মা’ শব্দের প্রয়োগই এ প্রশ্নের জবাব বলে মন্তব্য করেন শায়খ আল মুনাজ্জিদ। সুম্মা অর্থ অতঃপর। অর্থাৎ কেউ রমজানের রোজা পূর্ণ করল, অতঃপর শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখল, সে যেন সারা বছর ধরেই রোজা করল। এখানে ধারাবাহিকতার কথাই বলা হয়েছে। কাজেই হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নত অনুযায়ী রমজান মাসে কারো রোজা ভাঙতি হলে শাওয়াল মাসে সেই ভাঙতি রোজা আগে পূর্ণ করতে হবে। যদি ভাঙতি রোজা পূর্ণ করতে শাওয়াল মাস পুরোটাই লেগে যায় (বিশেষ করে অসুস্থতা, সফর বা মহিলাদের বিশেষ কোনো শারীরিক অবস্থায়), তাহলে তিনি জিলকদ মাসে ওই ছয়টি রোজা রাখলেও শাওয়ালের ছয়টি রোজার অনুরূপ সওয়াব পাবেন।

রমজানের কোনো ফরজ রোজা ভাঙতি হলে প্রথমে সেই ফরজ রোজাই রাখতে হবে। পরে শাওয়ালের ছয়টি রোজা করতে হবে। রোজা কাজা করার যথাযথ ও অনুমোদিত ওজর যার রয়েছে, তাকে অবশ্যই কাজা রোজা করতে হবে আগে। কেননা রমজানের রোজা হলো ইসলামের একটি স্তম্ভ। আর শাওয়ালের ছয়টি রোজা হলো মুস্তাহাব। যে এই মুস্তাহাব পালন করল না, সে তিরস্কৃত হবে না। কেননা এটা ফরজ ইবাদত নয়। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি একটি নেক কাজ করে সে আল্লাহর অনুগ্রহে দশটি নেকি পাবে। আলোচ্য আয়াতে একটি ভালো কাজের প্রতিদান হিসেবে ১০ গুণ বৃদ্ধির ওয়াদা করা হয়েছে। কোনো স্থানে ৭০ গুণ, কোনো স্থানে ৭০০ গুণ, আবার কোথাও সীমাহীন বর্ণনা করা হয়েছে। এ জন্য বলা হয়, দশ দ্বারা আধিক্যতা বর্ণনা করা উদ্দেশ্য, নির্দিষ্ট সংখ্যা বর্ণনা করা উদ্দেশ্য নয়। সীমাহীন সওয়াবের ভান্ডার দিয়ে আমাদের কাছ থেকে এরই মধ্যে বিদায় হয়েছে পবিত্র রমজান মাস। হাজির হয়েছে মহাবরকতের বারতা নিয়ে পবিত্র শাওয়াল মাস। পবিত্র রমজানে মাসব্যাপী যারা সিয়াম সাধনা করেছেন তাদের জন্য এ মাসে শুভ সংবাদ রয়েছে। আর তা হলো শাওয়াল মাসের ৬ রোজা।

হজরত আবু আইউব আল আনসারী (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি রমজানে রোজা রাখে, অতঃপর শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখে, সে যেন সারা বছর রোজা রাখল (সহিহ আল-বুখারি ও মুসলিম)। কেননা চন্দ্র বছর ৩৬০ দিন, রমজানে ৩০ দিন রোজা রাখাটা ৩০০ দিনের সমপর্যায়ে হয়ে যায়। আর বাকি থাকে ৬০ দিন। শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখলে ৬০ দিনের সমপর্যায়ে হয়ে যায়। এর ফলে এক বছর পূর্ণ হয়ে যায়। একটি বর্ণানায় পাওয়া যায়, প্রিয় নবী (সা.) আরও এরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা শাওয়াল মাসের ৬ দিনে আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি ওই ৬ দিন রোজা রাখবে আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক সৃষ্টি জীবের সংখ্যা হিসাবে তার আমলনামায় নেকি লিখে দেবেন, সমপরিমাণ বদি দূর করে নেবেন এবং পরকালে তার দরজা বুলন্দ করে দেবেন। হজরত সুফিয়ান ছাওরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি মক্কায় তিন বছর ছিলাম। মক্কাবাসীর মধ্য থেকে জনৈক ব্যক্তি প্রত্যহ জোহরের সময় মসজিদে হারামে এসে বাইতুল্লাহ তওয়াফ করে, নামাজ পড়ে আমাকে সালাম দিয়ে চলে যায়। ফলে তার ও আমার মাঝে হৃদ্যতা ও সম্প্রীতি সৃষ্টি হলো। হঠাৎ সে অসুস্থ হয়ে পড়লে আমাকে ডাকল এবং বলল, আমি মারা গেলে তুমি আমাকে নিজ হাতে গোসল দেবে, নামাজ পড়বে এবং দাফন দেবে। ওই রাতে তুমি আমাকে কবরে একাকী রেখে চলে আসবে না। তুমি আমার কবরের কাছে রাত যাপন করবে এবং মুনকার নকিরের সওয়ালের সময় আমাকে সহায়তা করবে। সুতরাং আমি তাকে নিশ্চয়তা দিই। আমি তার আদেশ মোতাবেক তার কবরের কাছে রাত যাপন করি। আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলাম। হঠাৎ ঘোষকের ঘোষণা শুনলাম, হে সুফিয়ান। তোমার রক্ষণাবেক্ষণ ও তালকিনের প্রয়োজন নেই। আমি বললাম, কিসের জন্য? তিনি বললেন, রমজানের রোজা এবং রমজান-পরবর্তী শাওয়ালের ৬টি রোজার কারণে। আমি ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না। অজু করে নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। অতঃপর আমি আবার একই স্বপ্ন দেখলাম।

সুতরাং আমি উপলব্ধি করলাম যে, এটা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে, শয়তানের পক্ষ থেকে নয়। সুতরাং আমি চলে গেলাম এবং বলতে লাগলাম, হে আল্লাহ! আপনি আমাকে রমজানের রোজা এবং শাওয়ালের ৬টি রোজা রাখার তৌফিক দান করুন। অতএব, শাওয়ালের ৬টি রোজার গুরুত্ব ও ফজিলত উপলব্ধি করে প্রত্যেক মুসলমানের উচিত এ পুণ্যময় নেক আমলে নিজেকে মশগুল রাখা। মহান আল্লাহ্ সবাইকে সেই তৌফিক দান করুন।

Comment

লেখক পরিচিতি

মিরাজ রহমান

গতানুগতিক ধারার বাইরে থেকে কাজ করে ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন মিরাজ রহমান। পেশায় পুরোদস্তুর একজন সাংবাদিক হলেও কেবল ইসলামকে ঘিরেই আবর্তিত তার ধ্যান-জ্ঞান। দৈনিক পত্রিকার ইসলাম পাতায় লেখালেখি থেকে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন বটে, কিন্তু একসময় শিল্প চর্চায়ও ছিলেন বেশ মনোযোগী।
মিডিয়ায় সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেছেন যখন, তখনও তিনি ছাত্র। মাদানিনগর মাদরাসার কাফিয়া জামাতের (শ্রেণি) শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় কণ্ট্রিবিউটর হিসেবে প্রথম কাজ শুরু করেন দৈনিক যুগান্তরে। ধারালো লিখনী শক্তি অল্পদিনের মধ্যে পরিচিত করে তোলে তাকে। দেশের জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রায় সবগুলোতেই ইসলামবিষয়ক কলাম ও ফিচার লিখেছেন দীর্ঘ সময়। জাতীয় প্রিন্ট মিডিয়াগুলোতে তার অন্তত দুই সহস্রাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
মিরাজ মূলত পড়াশুনা করেছেন কওমি শিক্ষাধারায়, এর পাশাপাশি তিনি জেনারেল শিক্ষাধারায়ও পড়াশুনা করছেন। সহ-সম্পাদক হিসেবে প্রথম যোগদান করেন দৈনিক ডেসটিনি পত্রিকায়। সেখান থেকে দৈনিক কালের কণ্ঠে। দেশে-বিদেশে অনলাইন গণমাধ্যমের জয়যাত্রা শুরু হলে মিরাজ ইন্টারনেট জগতকে ইসলাম প্রচারের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র বিবেচনা করে অনলাইনেই গাঁটছাড়া বাঁধেন। দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইসলামবিষয়ক অনলাইন পোর্টাল প্রিয়.কমের ‘প্রিয় ইসলাম’-এর সৃষ্টি ও পথচলার সূচনা তারই হাতে। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন প্রিয়.কমের প্রিয় ইসলাম বিভাগের এডিটর ইনচার্জ। সর্বশেষ কর্মরত ছিলেন দৈনিক বাংলাদেশের খবরের ফিচার ইনচার্জ হিসেবে।
টেলিভেশনে অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা ও আলোচনার সঙ্গেও ইতিমধ্যে যুক্ত হয়েছেন মিরাজ রহমান। পরিচালনা করেছেন বেশ কিছু অনুষ্ঠানও। এসো কলম মেরামত করি, ছোটদের নবী-রাসূল সিরিজ, তাবলিগী জামাতের পৃষ্ঠপোষক-মুরুব্বি ছিলেন যাঁরা, শরয়ী পর্দার বিধান, আশিক মিন ফিলিস্তিন, নারী তুমি সৌভাগ্যবতী ও হালাল ব্যবসা ও হালাল অর্থনীতির কথকতাসহ বেশ কিছু আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থেও জনক তিনি। বর্তমান তিনি ইসলাম প্রতিদিনের সম্পাদক ও প্রকাশক এবং দ্য সুলতান প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।