দিবস বিধান

শবে বরাত : করণীয়-বর্জনীয়

আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত তথা নিসফে শাবান। শবে বরাত নিয়েও আমাদের সমাজ বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়িতে লিপ্ত। সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ পূণ্যময় রজনীকে এমনভাবে উদযাপন করে, যা সম্পূর্ণ ইসলাম বহির্ভূত। তারা এই পবিত্র রাতে এমনসব কাজ-কর্ম করে যা সুস্পষ্ট বিদআাত ও নাজায়েজ। অপর একটি শ্রেণীর মানুষ এ রাতের ফজিলতকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন প্রচার করে নিজেরা যেমন নফল ইবাদত থেকে দুরে থাকেন, অপরকেও ইবাদতের প্রতি দুওে রাখার চেষ্ঠায় থাকেন। এই বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি ইসলাম সমর্থন করে না।

শবে বরাতের ফজিলতকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলা ঠিক নয়। কারণ ১০ জন সাহাবি থেকে শবেবরাতের ফজিলত সম্পর্কিত হাদিসগুলো বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং শবেবরাতের ফজিলত ও রাতের ইবাদতকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন তথা বিদয়াত বলা কোনোক্রমেই সংগত নয়। বরং বাস্ততার আলোকে স্বীকার করতেই হবে, এ রাত পূণ্যময় মুক্তির রাত। এ রাতে জেগে থেকে নফল ইবাদত-বন্দেগি করা পুণ্যময় কাজ। তবে ইসলামে এ রাতের ইবাদতের জন্য বিশেষ কোনো নিয়মনীতি নেই।

শবে বরাত কী? রাসুলের (সা.) ভাষায় ‘লাইলাতুন নিসফী মিন শাবান’। অর্থাৎ শাবান মাসের ১৫তম রজনী। হজরত মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, অর্ধ শাবানের রাতে অর্থাৎ শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিকুলের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও হিংসুক-বিদ্বেষী লোক ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান, হা. ৫৬৬৫, আল মু’জামুল কাবীর ২০/১০৯, শুআবুল ইমান, হদিস নং. ৬৬২৮)

হযরত আসিম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবি বকর তাঁর পিতার সনদে দাদা হযরত আবুবকর (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসুল সা. ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তায়ালা শাবানের ১৫তম রাত্রে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং সকল পাপীকে (যারা ক্ষমা প্রার্থনা করে) ক্ষমা করে দেন। তবে’ মুশরিক’ (আল্লাহর সাথে সমকক্ষ সাব্যস্তকারী) ও ‘মুশহিন’ (হিংসুক) ব্যতীত। (-বায়হাকি ফি শুয়াবিল ঈমান হা. ৩৮৩৫)

হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.), আবু সালাম আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা), আবু মুসা আশআরী (রা.) আবু হুরায়রা (রা.), আবুবকর (রা.),আউফ ইবনে মালিক (রা.) ও হজরত আয়েশা (রা) সকলেই এ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। হাদিসবিশারদগণ উক্ত হাদিসের রাবীদেরকে ছেক্বাহ তথা বিশ্বস্ত বলেছেন। মূল কথা হাদিসটি ‘সহীহ’। (-সহী ইবনে হিব্বান, আত তারগীব ওয়াত তারহীব ২ খন্ড:পৃঃ ১১৮, মাজমাউল ফাওয়ায়ীদ খন্ড ৮,পৃ. ৬৫, মুসনাদে বাযযার,খন্ড ৮.পৃ. ৬৭)

শবে বরাত তথা শাবানের ১৫ তারিখের রোজা বিষয়েসমৃদ্ধ হাদীস সম্ভারে শুধু একটি হাদীসই রয়েছে। হাদিসটি দুর্বল। ফলে কতিপয় আলেমের মতে এই রোজাকে শুদ্ধ ও সংগত বলা ঠিক নয়। তবে যেহেতু পুরো শাবান মাসে রোজা রাখার ফজিলত প্রমাণিত, আরো যেহেতু পনের তারিখটি আইয়ামে বীজের অন্তর্ভূক্ত। আর রাসূল (সা.) প্রায় প্রত্যেক চন্দ্র মাসের আইয়ামে বীজের সময় (১৩,১৪,১৫ তারিখ) রোজা রাখতেন। শবে বরাতের রোজার পক্ষে যেহেতু কোন মজবুত দলিল নেই, তাই যারা নফল রোজা রাখতে চান তারা আইয়ামে বীদ্বের তিনটি রোজা ১৩, ১৪ ও ১৫ রাখতে পারেন; এর পক্ষে সহীহ হাদীসের দলিল রয়েছে। শুধু একটি না রেখে এ তিনটি বা তার চেয়েও বেশি রোজা রাখতে পারলে আরও ভালো। কারণ, শা’বান মাসে রাসূলুল্লাহ (সা.) সবচেয়ে বেশি পরিমাণ নফল রোজা রেখেছেন।

শবে বরাত রজনীতে নিজের যাবতীয় গোনাহের জন্য তাওবাহ করে রাব্বুল আলামিনের দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করা। নিজের মনের নেক আশা-আকাঙ্খা পূরণের জন্য ও মৃতদের মাগফিরাতের জন্য বেশী বেশী করে দোয়া করা। নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার, দোয়া-দুরুদ, তাওবাহ-ইসতিগফার, দান-সদকা, উমরি ক্বাযা নামাজ, কবর জিয়ারতসহ ইত্যাদি নফল আমলের মাধ্যমে রাতগুজার করা। তবে মাকবারে তথা কবরে যাওয়া জররী নয়। কবর জিয়ারতকে রুসম বা রেওয়াজ পরিণত করা যাবে না। কারণ রাসুল (সা.) চুপিসারে একাকী জান্নাতুল বাকিতে কবর জিয়ারত করেছেন। আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-কে নিদ্রা থেকে জাগ্রত করেননি এবং পরবর্তীতেও কবর জিয়ারত করার কথা বলেননি। তবে দলবদ্ধ ছাড়া একাকীভাবে কবর জিয়ারতে কোন বাধা নেই। আনুষ্ঠানিকতা ও জামাত ছাড়া একাকীভাবে সামর্থ্যানুযায়ী নফল ইবাদত-বন্দেগী করা। মসজিদে গিয়ে সমবেতভাবে ইবাদতের জরুরত নেই।

যে সকল ইবাদত নামাজ জামাতে ও সমবেতভাবে আদায় করার প্রচলন রাসুল থেকে প্রমাণিত রয়েছে তা জামাতে আদায় করা। বাকীগুলো একাকীভাবে করা। আল্লাহ তায়ালা নফল ইবাদতকে একাকিত্বে আদায় করাই বেশি ভালবাসেন। ইখলাছের সাথে স্বল্প আমল ঐকান্তিকতাহীন অধিক আমল থেকে উত্তম।

শবে বরাতের আলাদা কোন নামাজ তথা নির্দিষ্ট সুরা দিয়ে নির্দিষ্ট রাকাত পড়ার রেওয়াজ ইসলামে নেই। শবে বরাতের নামে রাস্তা-ঘাটে আতশবাজি, ফটকাবাজি, ঘর আলোকসজ্জা, রাতে মসজিদে অতিরিক্ত আলোকসজ্জ্বা করা, মরিচলাইট, তারাবাতি, আধুনিক নয়ানাভিরাম বর্ণিল বাতির ঝাড়ে দিগদিগন্ত পল্লাবিত করা, আগরবাতি, মোমবাতি, গোলাপজল, কবরে পুষ্প অর্পন, বাসাবাড়িতে খিচুড়ি পাকানো, হালুয়া রুটি, তাবারুক তৈরি ও মিষ্টান্ন বিতরণের ধুমধামে মত্ত থাকে। রাস্তা-হাটবাজারে যুবকদের আড্ডা, অশূচি প্রতোযোগীতা এসকল কাজ গর্হিত ও শরিয়ত পরিপন্থী। এগুলো অবশ্যই বর্জনীয়।

Comment

লেখক পরিচিতি

এহসান বিন মুজাহির

এহসান বিন মুজাহির— তরুণ লেখক, সাংবাদিক ও শিক্ষক। জন্ম ১৫ মে ১৯৯২ । মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার জানাউড়ার সাইটুলা গ্রামে জন্ম এবং শ্রীমঙ্গল শহরতলীর মুসলিমবাগ আবাসিক এলাকায় (সুনগইড়) বেড়ে উঠা। পিতা মাওলানা মুজাহিরুল হক। শ্রীমঙ্গলের প্রাচীনতম দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাইটুলা ইসলামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম মাদরাসার প্রিন্সিপাল।
লেখক এহসান বিন মুজাহির মৌলবীবাজারের শ্রীমঙ্গলের গাউছিয়া শফিকিয়া সুন্নিয়া দাখিল মাদরাসা থেকে দাখিল, রাজনগর দারুস সুন্নাহ (ডিএস) ফাজিল মাদরাসা থেকে আলিম, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়ার অধিনে মৌলভীবাজার টাউন কামিল মাদরাসা থেকে ফাজিল (বিএ), বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোড’র (বেফাক) অধিনে ২০১০ সালে তাকমিল ফিল হাদিস (এমএ), বাংলাদেশ ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়েরর অধিনে ঢাকা সরকারি আলিয়া মাদরাসা থেকে ২০১৬-২০১৭ শিক্ষাবর্ষে দুই বছর মেয়াদি ফিকহ বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি (কামিল) লাভ করেন। ২০০৫ সাল থেকে লেখালেখির সাথে জড়িত। ছড়া-কবিতার মধ্যদিয়ে লেখালেখির জগতে পদার্পণ।
২০০৮ সাল থেকে ইসলাম সমাজ, সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ সমসাময়িক নানা বিষয়ে দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক বিভন্ন পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিনএবং দেশ-বিদেশের অনলাইন পোর্টালে লিখছেন। বর্তমানে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুলে প্রিন্সিপাল হিসেবে কর্মরত। পাশাপাশি জাতীয় দৈনিক খবরপত্রের শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি, সাপ্তাহিক শ্রীমঙ্গলের চিঠির নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক পাতাকুঁড়ির দেশের শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি, একুশে জার্নাল ডটকম, ই-নিউজ একাত্তর ডটকমের মৌলভীবাজার রিপোর্টার এবং শ্রীমঙ্গল উপজেলার শিক্ষকদের সংগঠন শ্রীমঙ্গল কিন্ডারগার্টেন শিক্ষক সমিতির সহ-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও সততা-নিষ্ঠার সাথে সক্রিয়ভাবে পালন করছেন।
শিক্ষা, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ময়দানেও সরব উপস্থিতি রয়েছে। লেখালেখি-সাংবাদিকতায় এহসান বিন মুজাহির হিসেবে সর্বমহলে পরিচিতি লাভ করলেও সার্টিফিকেট ও ভোটার আইডি কার্ড অনুযায়ী মূল নাম হলো মোঃ এহসানুল হক।