দিবস বিধান

পবিত্র মিরাজের তাৎপর্য ও শিক্ষা

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য প্রত্যেক যুগেই নবি-রাসুল প্রেরণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবি হলেন আমাদের প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি সাইয়্যেদুল আম্বিয়া ও খাতামুল আম্বিয়া। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘হে রাসুল! আমি আপনাকে গোটা বিশ্বজগতের জন্য রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি।’ (সুরা আল-আম্বিয়া, আয়াত নং-১০৭)। মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তকে শক্তিশালী করার জন্য অন্য নবি-রাসুলদের মতো তাঁকেও দেওয়া হয়েছে অগণিত মুজিজা। তন্মধ্যে মিরাজ অন্যতম। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ২৩ বছরের নবুয়তি জীবনের অন্যতম অলৌকিক ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো এই মিরাজ। মদিনায় হিজরতের আগে মক্কায় অবস্থানকালে ২৬ রজব দিবাগত রাতে তিনি আল্লাহ প্রদত্ত বাহন বুরাকে চড়ে মিরাজ গমনের মাধ্যমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মহান সান্নিধ্য লাভ করেন। তবে মিরাজ কখন সংঘটিত হয় এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে।
হজরত মুসা ইবনে ওকবা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, মিরাজের ঘটনা হিজরতের ছয় মাস আগে সংঘটিত হয়। ইমাম নববি ও কুরতুবির মতে, মিরাজের ঘটনা মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তপ্রাপ্তির পাঁচ বছর পর সংঘটিত হয়েছে। ইবনে ইসহাক বলেন, মিরাজের ঘটনা তখন ঘটেছিল, যখন ইসলাম আরবের সব গোত্রে ছড়িয়ে পড়েছিল। ইমাম হরবি বলেন, ইসরা ও মিরাজের ঘটনা রবিউস সানি মাসের ২৭ তারিখ রাতে হিজরতের এক বছর আগে ঘটেছিল। বেশির ভাগ মতে, নবুয়তের দশম বর্ষে রজব মাসের ২৭ তারিখে মিরাজের ঘটনা সংঘটিত হয়। তিবরানি (রহ.) বলেছেন, যে বছর রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নবুয়ত দেওয়া হয়, সে বছরই মিরাজ সংঘটিত হয়। কারো মতে, হিজরতের ১৬ মাস আগে রমজান মাসে মিরাজ সংঘটিত হয়। মিরাজ গমন করে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কাছ থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আদেশসহ ইসলামি সমাজ পরিচালনার বিধি-বিধান নিয়ে আসেন। পবিত্র কুরআন মাজিদে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বিশ্ব মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ ও সার্বজনীন জীবন ব্যবস্থা হিসেবে রূপ দেয়ার জন্য তিনি বিশ্বের পালনকর্তার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা পেয়েছিলেন পবিত্র মিরাজ রজনীতে। এ জন্য এ রাতটি প্রত্যেক মুসলমানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সকল মুুজিজার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুজিজা হলো পবিত্র মিরাজ।
এ রাতে তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে সকল নবির ইমাম হয়ে সাইয়্যিদুল মুরসালিনের আসনে স্থায়ীভাবে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ফলে এ রাতটি নিঃসন্দেহে তার শ্রেষ্ঠত্বের গৌরবোজ্জল নিদর্শন বহন করে। মিরাজ শব্দটি এসেছে আরবি ‘উরুযুন’ শব্দ থেকে। ‘উরুযুন’ অর্থ সিঁড়ি আর মিরাজ অর্থ উর্ধ্বগমন। যেহেতু সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠা হয় সে জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঊর্ধ্বগমনকে মিরাজ বলা হয়। রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পথহারা মানুষদেরকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে এক টানা ১২ বছর দাওয়াত দেন মক্কায়। কিন্তু তার দাওয়াতে কিছুসংখ্যক মানুষ ইসলাম কবুল করলেও অধিকাংশরা লেগে যায় বিরোধিতায়। ধীরে ধীরে বিরোধিতা তীব্র থেকে তীব্রতর আকার ধারণ করে। নানা রকম অমানবিক নির্যাতন শুরু হয় রাসুলের উপরে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সান্ত্বনা দেয়ার জন্য এ সময়ই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর সান্নিধ্যে নিয়ে যান। নিজের প্রিয় হাবিবকে তার সান্নিধ্যে নিয়ে যেতে আল্লাহ নিজ কুদরতে মিরাজের আঞ্জাম দেন। বিভিন্ন তথ্যের মাধ্যমে তারই প্রমাণ ঘটে। এক মুহূর্তে ঘটে যায় মিরাজের ঘটনা। তাফসীরকারকগণ বলেন, চোখের এক পলক সময় ব্যয়িত হয়।
বর্ণিত আছে, মিরাজ থেকে ফেরার পর দরজার কড়া নড়তে এবং অযুর পানি গড়াতে দেখেছেন রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। পবিত্র কুরআনের সুরা বনি ইসরাইলের প্রথম আয়াতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মিরাজ গমনের বর্ণনা এসেছে এভাবে- ‘তিনি সেই পরম পবিত্র মহিমাময় সত্তা যিনি তার স্বীয় বান্দাকে এক রাতে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত। যার পরিবেশকে করেছেন তিনি বরকতময়। যাতে তাকে নিজের কিছু কুদরত দেখান। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছুরই শ্রোতা ও দ্রষ্টা।’ ২৬ রজব রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মে হানি বিনতে আবু তালিবের ঘরে ঘুমিয়েছিলেন। হঠাৎ হজরত জিবরাইল (আ.) এসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মসজিদুল হারামে নিয়ে যান। সেখানে তার বুক বিদীর্ণ করে জমজম কূপের পানি দিয়ে সিনা মুবারক ধৌত করে শক্তিশালী করেন। তারপর সেখান থেকে তিনি বুরাক নামক এক ঐশী বাহনে করে সশরীরে বাইতুল মুকাদ্দাসে নিয়ে যান। বুরাক হলো এমন একটি প্রাণী, যা গাধা ও খচ্চরের মাঝামাঝি আকৃতির একটি জন্তু। তার দুই উরুতে রয়েছে দুটি পাখা। তা দিয়ে সে পেছনের পায়ে ঝাপটা দেয়, আর সামনের দৃষ্টির শেষ সীমায় পা ফেলে।
প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাইতুল মুকাদ্দাসের দরজায় খুঁটির সঙ্গে বুরাকটিকে বেঁধে যাত্রাবিরতি করেন এবং বাইতুল মুকাদ্দাসে এসে সকল নবির ইমাম হয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। তারপর তিনি বুরাকে চড়ে ঊর্ধ্বে গমন করতে থাকেন। একের পর এক আসমান অতিক্রম করতে থাকেন। পথিমধ্যে হজরত মুসা (আ.) সহ অনেক নবি রাসুলের সাথে সাক্ষাৎ হয়। সপ্তম আসমানের পর বাইতুল মামুরে গিয়ে হজরত জিবরাইল (আ.)-কে রেখে তিনি রফরফ নামক আরেকটি ঐশী বাহনে চড়ে বিশ্বের স্রষ্টা মহান আল্লাহর দরবারে হাজির হন। সেখানে আল্লাহর সাথে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথোপকথন হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মুসলমানদের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ জীবন ও রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন বিধি-বিধান রাসুলকে উপহার দেন। মিরাজ থেকে আসার পর এ ঘটনার বর্ণনা দেয়া হলে বিনা প্রশ্নে তা বিশ্বাস করেন হযরত আবু বকর (রা.)।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মিরাজ গমনের বিষয়ে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। এছাড়া মুফাসসিরগণও এ সম্পর্কে ব্যাপক তথ্য প্রমাণাদি পেশ করেছেন। মিরাজের ঘটনা থেকে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় হলো- মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের অসীম ক্ষমতার উপর নিঃশঙ্ক চিত্তে বিশ্বাস স্থাপন করা। মহান আল্লাহ্ চাইলে সবকিছুই করতে পারেন এবং তার ক্ষমতা অপরিসীম। এই চেতনাকে মাথায় রেখে আল্লাহ্কে ভয় করে সার্বক্ষণিক আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের চিন্তা করে সব কাজ করা। পাশাপাশি রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মর্যাদাকে উপলব্ধি করে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পূর্ণাঙ্গভাবে নিজ জীবনের আদর্শ বানানো। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের অস্তিত্ব, জান্নাত, জাহান্নামের মতো বিষয়গুলো যা আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান নয়, সেগুলোতে পরিপূর্ণভাবে ঈমান আনা এবং এতে কোন প্রকার সন্দেহ না রাখা। পবিত্র মিরাজের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে বর্তমান বিশ্বের মজলুম মুসলমানদেরকে কাফিরদের নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তির জন্য কাজ করতে হবে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে সেই তাওফিক দান করুন। আমিন!

Comment

লেখক পরিচিতি

মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ হাশেমী

মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ হাশেমী— প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক। জন্ম ০১ মার্চ, ১৯৮৪। কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলাধীন বেতুয়া গ্রামে জন্ম এবং বেড়ে উঠা। পিতা কুমিল্লা জেলার প্রখ্যাত ওয়ায়েজ ও মুফাসসিরে কুরআন মাওলানা আবুল হাশেম (রহ.)।
কুমিল্লা জেলার ঐতিহ্যবাহী দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধামতী ইসলামিয়া কামিল মাদরাসা থেকে দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল পাশ করেন। পাশাপাশি কওমি শিক্ষাধারায়ও কিছুদিন পড়াশুনা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল ডিগ্রিও অর্জন করেন।
দীর্ঘদিন যাবত দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন পোর্টালে লিখছেন। বর্তমানে একটি বেসরকারি কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।