দাওয়াত ফিচার

মানবিক দাঈর সন্ধানে

দাওয়াহর দৃষ্টিতে যদি আমরা পৃথিবীকে মানুষকে ভাগ করি, তাহলে বলতে হয় পৃথিবীর মানুষ দু-ভাগে বিভক্ত। দাঈ আর মাদউ। এক দল দাওয়াত দেন আরেক দল যাদের দাওয়াত দেওয়া হয়। এক গ্রুপ যারা দাওয়াত পেয়ে তাদের আকীদা ও আমলকে এর নির্দেশনায় পরিশুদ্ধ করেছে। আর যারা এখনো পরিশুদ্ধ হওয়ার পরিবেশ বা দাওয়াত পায়নি তাদের এর আওতায় আনার চেষ্টা করা। উভয় ধারাতেই কত ধরনের বিচিত্র চিন্তা-চেতনার মানুষ! কত সংস্কৃতি আর বৈচিত্র্যের ধারক ও বাহক! যারা দাঈ ধারার অর্থাৎ যেসব মুসলিমরা দাওয়াত প্রদান করেন, তাদের দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে হাজারো বৈচিত্র্য আর ধারায় কী বিচিত্র জীবনের খেলা ঘরে ঘোরপাক খাচ্ছে! ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানদের কালচার আর আফ্রিকার মুসলমানদের কালচার কি এক? হ্যাঁ, আকিদাগতভাবে অবশ্যই এক। কিন্তু রূপ-বৈচিত্র্যের মধ্যে কত পার্থক্য! আকিদার প্রকাশভঙ্গিতে কত রূপ! আমরা বাংলাদেশ বা এ উপমহাদেশের কথাই বলি না কেন? যে মুসলমানের আকিদায় আল্লাহ, রাসূল, কিতাব, আখেরাতের ব্যাপারে কোনো মতপার্থক্য নেই। তারা কি একতাবদ্ধ বা ঐক্যবদ্ধ প্রক্রিয়ায় আছে? দল কতগুলো? হিসাবের ভার পাঠকের কাছে রইল। আমি একবার হিসাব করতে গিয়ে হাঁপিয়ে পড়েছি। আবার এসব দাঈ অভিযাত্রীদের এক করার মানসিকতায় দু-একজনের সাথে কথা বললে তো ক্রিকেট খেলার মতো বোল্ট। কেউ কেউ বলল, আপনি কি তাদের দালাল? অথবা ওই গ্রুপের তো ঈমানই নেই, তাহলে কার সাথে ঐক্যের কথা বলছেন? এরূপ হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ঐক্য-প্রক্রিয়ার মাঠে টিকে থাকা কঠিন।

এক সংস্কৃতি ও ধারায় মাঝে থেকে যদি বাংলাদেশেই এ অবস্থা হয়, তাহলে যে দেশের রাজত্ব মাদউ তথা অমুসলিমদের হাতে সে দেশের মুসলমানদের অবস্থা কী? এর ওপর তো মাজহাবী, লা-মাজহাবী, সুন্নী-অসুন্নী, শিয়া-সুন্নী, ওয়াহাবী, সালাফী, আহলে কুরআন, আহলে হাদীস, মাইজভান্ডারী, কাদেরী, সূফী, দেওবন্দী, নদভী, লখনভী, আলিগড়ি, আলিয়া ও কওমীপন্থী, পীরপন্থী, তাইয়্যেবীসহ আরও কত গ্রুপ যে আছে? প্রত্যেক গ্রুপে আবার উপগ্রুপ আছে। এ তো গেল আকিদাগত। আর রাজনৈতিক অথবা আঞ্চলিক? অধিকাংশ দল বা উপদলের অন্য গ্রুপ বা দলকে হেয় করার যে কঠোর মনোভাব তাতে মাঝেমধ্যে নিজেকেই প্রশ্ন করি মূলধারা কারা? আপনি আরবের বা সৌদিদের কথা বলবেন, তাদের ব্যাপারে আবার আরবেরই অন্য গ্রুপের ফতোয়া বা তাখরিজ দেখুন। চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে! সত্যি কুরআনের অনুসারী বিশ্বের মুসলমানদের এত গ্রুপ যে তাদের বিনষ্ট করার জন্য অন্যের ষড়যন্ত্রের প্রয়োজন নেই। নিজেরাই যথেষ্ট।

মধ্যপ্রাচ্যে এক মুসলমান দেশ আরেক মুসলমান দেশে আক্রমণ করার জন্য ইসলামবিরোধীদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, যেমনটি হয়েছিল স্পেনে। মুসলিম ছোট ছোট ক্ষুদ্র স্পেনের রাজারা একে অপরের ব্যাপারে এতই অসহিষ্ণু হয়ে গিয়েছিল যে তারা পুনর্জাগরণবাদী খ্রিষ্টানদের অপর মুসলিম রাজ্যে আক্রমণের জন্য উৎসাহ দিত। আজকের মধ্যপ্রাচ্য ও তৎকালীন স্পেনের মুসলিমদের অভ্যন্তরীণ গোলযোগের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। বর্তমানে চলমান অসহিষ্ণু অবস্থা যৌক্তিক পর্যায়ে আছে কি? অপরের সাথে বিরোধিতা করার বা তাত্ত্বিক মতবিরোধ করার পর্যায় অবশ্যই আছে।

ইসলাম একটি সীমা পর্যন্ত ইখতেলাফ বা মতানৈক্যকে বৈধতা দিয়েছে। তবে ইখতেলাফের মানে তো এই নয়, সর্বদা কেবল নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি। এখন তো একে অপরের জীবন নাশের খেলায় মত্ত হয়ে উঠেছে? এটা কি ইসলাম? এটা কি দাঈর চরিত্র? কোনো বাছবিচার না করে একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছি আর ফতোয়ার কৌশলী অস্ত্র শানাচ্ছি! একবারও কারও পক্ষে বা বিপক্ষে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে সমাজ ও বাস্তব পরিপ্রেক্ষিত ভাবা হচ্ছে না। এ ভাবনা না থাকাটাই আমাদের সহজে কারও পক্ষে বা বিপক্ষে উত্তেজিত করে তোলে। ভাবনার অপর নামই তো গবেষণা, পড়াশোনা। কুরআন নাজিলের প্রথম যে বাণীটি ছিল তা তো পড়ার! কুরআন-হাদিসের জ্ঞানের মাধ্যমে বাস্তবতাকে উপলব্ধি করার। এ উপলব্ধির মাধ্যমে একজন দাঈ বিনয়ের মনজিলে পৌঁছতে বাধ্য। দাঈর দৃষ্টিতে সমাজকে বিশ্লেষণ করলে এত মত ও পথের সৃষ্টি হতো কি?

সংক্ষিপ্ত জীবনে অফুরন্ত কাজ করে দলাদলির ফুরসত কই? তাই আমার একান্তই ব্যক্তিগত ভাবনা, দাওয়াহ ও দাঈর চরিত্র ও পৃথিবীর বাস্তবতাকে নতুন করে চিন্তা ও বিশ্লেষণ করার সময় এসেছে। বিশ্লেষণের পর্যায়ে আমরা দাঈ হিসেবে পৌঁছতে পারলে রক্ষণশীলতার বেড়াজাল ছিন্ন হয়ে জগৎ আরও বেশি প্রশস্ত হবে। তখনই একজন মানবিক দাঈ পৃথিবীকে দেখবে সম্পূর্ণ অন্য চরিত্রে। তাঁর কাছে মনে হবে যে, আল্লাহ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে পরম মায়ায় পৃথিবীতে আগলে রেখেছেন, তাদের খাওয়াচ্ছেন, পরাচ্ছেন তাদের মাঝে তো আমাদের দাঈ হিসেবে কাজ করতে হবে।

সুতরাং মাদউ ছাড়া দাঈ হিসেবে আমি অর্থহীন। তায়েফের শিক্ষা আমাদের আত্মস্থ করতে হবে। ধৈর্যের শিক্ষা আমাদের হুদায়বিয়া থেকে নিতে হবে। রাসূলের (সা.) ডিফেনসিভ যুদ্ধের ইতিহাস হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। তাহলে দাঈ হিসেবে আমাদের মানবিকতার বিকাশ আরও প্রশস্ত হবে। আমাদের ধৈর্য ও মানবিকতার মৌলিকত্ব পৃথিবীকে আবার ঝংকৃত করবে। শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য মাদউগণই দাঈদের আহ্বান জানাবে। যেমনটি হতো রাসূল (সা.) ও তাঁর পরে খোলাফায়ে রাশেদার আমলে।

ওকে/এমএইচ

Comment

লেখক পরিচিতি

প্রফেসর ড. মো. ইকবাল হোছাইন

প্রফেসর ড. মো. ইকবাল হোছাইন— কুষ্টিয়াস্থ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক। তিনি দাখিল ও আলিম পরীক্ষা ১৯৮৮ ও ১৯৯০ সালে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে বোর্ড বৃত্তি লাভ করেন। এরপর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্ট্যাডিজ বিভাগ থেকে অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে ইউজিসি জনতা ব্যাংক বৃত্তি লাভ করে। মাস্টার্সেও প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ড. ইকবাল দাওয়াহ বিভাগে ১৯৯৯ সালে প্রভাষক হিসেবে বিভাগে যোগদান করেন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০১ সালে এমফিল এবং ইউজিসি বৃত্তি নিয়ে ২০০৪ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘সাংবাদিকতায় বঙ্গীয় উলামা-মাশায়েখ’। ২০০৭ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যলয় থেকে থিওলজীতে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল Faith in Contemporary Society. অত:পর ইষ্ট লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Human Rights Post Graduate Certificate (PGC) সম্পন্ন করেন। সেখানে থাকাকালীন সময়ে তিনি ‘রয়েল কলেজ অব লন্ডনে খন্ডকালীন শিক্ষকতা করেন। ২০১৩ সালে তিনি সৌদি সরকারের আমন্ত্রণে রয়েল গেষ্ট হিসেবে হজব্রত পালন করেন। ২০১৩ থেকে ব্যাংককস্থ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পিচ স্টাডিজের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। একই বছর তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও ওয়ার্কশপে অংশ নেয়ার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। ২০১৭ সালের এপ্রিলে আমেরিকান ফেডারেল সরকারের স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে Interfaith (Religious Education) in the USA বিষয়ে International Visitors Leadership Program (IVLP) সলের সদস্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি স্টেট সফর করেন। এসময় স্টেট ডিপার্টমেন্টে সরকারের অফিসিয়ালদের সাথে আলোচনাসহ বিভিন্ন স্টেটের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ধর্মীয় নেতা, কমিউনিটি নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময় করেন। একই বছর ভারতের উত্তর প্রদেশের রাজধানী লক্ষৌতে অবস্থিত সিটি মন্টেশ্বরী স্কুলের 7th International Interfaith Conference আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যোগদান করেন এবং Interfaith Award লাভ করেন। জুন ২০১৮ থেকে মে ২০১৯ পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটিতে Interfaith Networking -এর উপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। Interfaith in Islam and Muslim World নামে একটি গবেষণামুলক বই নিউইয়র্কস্থ Interfaith Center USA থেকে প্রকাশিত হয়। এক বছর গবেষণা কর্ম কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ Interfaith Center USA তাঁকে Proclamation প্রদান করেন।
ড. মো. ইকবাল মূলত: আন্তধর্মীয় সংলাপ, নারী অধিকার ও ইসলাম, মুসলিমবিশ্ব ও যুব উন্নয়নে কাজ করেন। উল্লিখিত বিষয়ে দা‘ওয়াহ কার্যক্রমের ব্যাপক প্রয়োজন রয়েছে। তাঁর ৯ টি বই ও ২৯টি গবেষণা প্রবন্ধ দেশী-বিদেশী জার্ণালে প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সময় প্রশাসন কতৃক অর্পিত দায়িত্ব হিসেবে সহকারী প্রক্টর, রোভারর্স স্কাউট সম্পাদক, প্রভোস্ট এবং প্রভোস্ট কাউন্সিলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত এবং ২ সন্তানের জনক।