দোয়া বিধান

যে ১৫ সময়ে দোয়া করলে অবশ্যই কবুল হয়

লিখেছেন মিরাজ রহমান

দোয়া ইসলামের স্বতন্ত্র একটি ইবাদত। হাদিস শরিফে দোয়াকে ইবাদতের ‘মগজ’ বলা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, যে আল্লাহর কাছে চায় না বা দোয়া করে না; আল্লাহ তার ওপর রাগান্বিত হন। অন্য একটি হাদিসে এসেছে, দোয়ার মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তনও সম্ভব। সুতরাং প্রত্যেক মুসলমানের উচিত গুরুত্বসহকারে বেশি বেশি দোয়া করা। আল্লাহ মহানের দরবারে দীর্ঘ মোনাজাতে সময় কাটানো।

যে কোনো সময়ই দোয়া করা যায়। প্রভুর দরবারে বান্দার আরজি পেশ করার নিদিষ্ট কোনো সময় বেঁধে দেননি তিনি। তবে এমন কিছু সময় রয়েছে, যখন দোয়া করলে, অবশ্যই তা কবুল হয়। হাদিসে রাসুলের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, মোট ১৫টি সময় বা মুহূর্তে এমন রয়েছে, যখন দোয়া করলে অবশ্যই আপনার দোয়া কবুল হবে, ইনশা আল্লাহ।

সুপ্রিয় দর্শক! আসুন, এবার আমরা— নিশ্চিতভাবে দোয়া কবুল হওয়া সেই ১৫টি সময় সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জেনে নেই।

১. শেষ রাতে বা সাহরি খাওয়ার আগ মুহূর্তে : বুখারি শরিফের ১১৪৫ নং এবং মুসলিম শরিফের ৭৫৮ নং হাদিসে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন রাতের এক-তৃতীয়াংশ বাকি থাকে, তখন আল্লাহ তাআলা নিকটবর্তী আসমানে নেমে আসেন এবং ঘোষণা করতে থাকেন— কে আমাকে ডাকছো, আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কে আছো রিজিকপ্রার্থী, আমি তাকে দান করবো। কে আছো ক্ষমাপ্রার্থী, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব।

২. পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ পরবর্তী সময় : তিরমিজি শরিফের ৩৪২১ নং হাদিসে হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলকে (সা.) জিজ্ঞেস করা হলো, ইয়া রাসূলুল্লাহ! কোন সময়ের দোয়া দ্রুত কবুল হয়? তিনি বললেন, রাতের শেষ সময়ে এবং ফরজ নামাজের পরে।

৩. আজান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময় : তিরমিজি শরিফের ২১২ নং হাদিসে উল্লেখ হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, আজান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়ের দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না।

৪. বৃষ্টির বর্ষণের সময় : আবু দাউদ শরিফের ২১৭৮ নং হাদিসে উল্লেখিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, দুই সময়ের দোয়া ফেরানো হয় না। ১. আজানের সময়ের দোয়া। ২. বৃষ্টি পড়ার সময়কার দোয়া।

৫. সিজদাহর সময় : মুসলিম শরিফের ৭৪৪ নং হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, সিজদাহর সময় বান্দা আল্লাহ মহানের সবচেয়ে নিকটতম অবস্থায় থাকে। সুতরাং তোমরা সে সময় আল্লাহর কাছে বেশি বেশি চাও।

মুসলিম শরিফের ৪৭৯ নং হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, রুকুতে তোমরা রবের বড়াই বর্ণনা কর। আর সিজদায় দোয়া করতে সচেষ্ট হও। কারণ, তোমাদের জন্য সেটা দোয়া কবুল হওয়ার উপযুক্ত সময়।

৬. দোয়া ইউনুস পাঠের সময় : তিরমিজি শরিফে উল্লেখ হয়েছে, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে মুসলমান হজরত ইউনুস (আ.)-এর ভাষায় অর্থ্যাৎ দোয়া ইউনুস পাঠের মাধ্যমে দোয়া করবে; সে যে সমস্যাতেই থাকুক না কেন; আল্লাহ তায়ালা তার ডাকে সাড়া দিবেন বা দোয়া কবুল করবেন। দোয়া ইউনুস হলো— লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতুম মিনাজ জোয়ালিমীন। অর্থ : আপনি ব্যতীত আর কোনো উপাস্য নেই। আমি আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। অবশ্যই আমি পাপী।

৭. ইফতারের আগ মুহূর্তে : তিরমিজি শরিফের ৩৫৯৮ নং হাদিসে উল্লেখ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে কারিম (সা.) বলেছেন, তিন ব্যক্তির দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না— ১. রোজাদারের দোয়া; যখন সে ইফতার করে। ২. ন্যায়পরায়ণ বাদশার দোয়া। ৩. মজলুমের দোয়া। আল্লাহ তাআলা তাদের দোয়া মেঘমালার ওপরে উঠিয়ে নেন এবং এর জন্য আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। আর আল্লাহ বলেন, আমার ইজ্জতের কসম! বিলম্বে হলেও আমি অবশ্যই তোমাদের সাহায্য করব।



৮. জুমআর দিনে : বোখারি শরিফের ৫৯২১ নং হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) একদিন শুক্রবার নিয়ে আলোচনা করলেন এবং বললেন, জুমার দিনে এমন একটি সময় আছে, কোনো মুসলিম যদি সে সময়টায় নামাজরত অবস্থায় থাকতে পারে এবং আল্লাহর কাছে কিছু চায়, আল্লাহ অবশ্যই তার সে চাহিদা মেটাবেন। এরপর রাসূল (সা.) তার হাত দিয়ে ইশারা করে, সময়টার সংক্ষিপ্ততার ইঙ্গিত প্রদান করলেন।

৯. জমজমের পানি পান করার সময় : ইবনে মাজাহ শরিফের ৩০৫৩ নং হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, জমজম পানি যে নিয়তে পান করা হবে, তা কবুল হবে।

১০. গোটা রমজান মাস জুড়ে : মুসনাদে আহমদের ৭৪৫০ নং হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, অবশ্যই আল্লাহ তাআলা রমজান মাসের প্রতি দিবস ও রাতে অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন এবং প্রত্যেক মুমিন বান্দার একটি করে দোয়া কবুল করেন। এছাড়া অন্য এক হাদিসে এসেছে, রোজাদারের দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। সুতরাং এই দুটি হাদিস থেকে বুঝা যায় যে গোটা রমজান মাস জুড়েই দোয়া কবুল হয়।

১১. আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের সময় : তিরমিজি ও রোখারি শরিফে এসেছে, হজের মৌসুম তথা জিলহজের প্রথম দশকে ও আরাফার দিবসে দোয়া কবুল হয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, দোয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো আরাফাতের দিনের দোয়া।

১২. যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর মুখোমুখি অবস্থায় : আবু দাউদ শরিফের একটি হাদিসে এসেছে, দুটি সময় এমন রয়েছে, যখন দোয়া করলে তা ফেরত দেয়া হয় না অথবা খুব কম ফেরত দেয়া হয়। ১. আজানের সময়ের দোয়া। ২. মুসলিম মুজাহিদ যখন যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর মুখোমুখি হয়।

১৩. রাতে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পর এই দোয়া পাঠ পরবর্তী সময় : বোখরি শরিফের ১১৫৪ হাদিসে এসেছে, হজরত উবাদা ইবনে সামিত (রা.) নবী করীম (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি রাত্রে নিদ্রা ভঙ্গ হলে এই দোয়াটি পড়বে এবং সে যদি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে, হে আল্লাহ্! আমাকে ক্ষমা করে দাও, অথবা অন্য দোয়া করে, তাহলে তার দোয়া কবুল হয়।

দোয়াটি হলো— লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু লাহুল মুলকু । সুবহানাল্লাহ আল্লাহু আকবার ওয়ালা হাউলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।

অর্থ আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোনো উপাস্য নেই। তিনি এক ও একক। তাঁর কোনো শরীক নেই। রাজত্ব ও সমস্ত প্রশংসা তাঁরই। তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাশীল। সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য। তিনি পূত-পবিত্র ও মহান। তাঁর সাহায্য ব্যতীত কারো ভাল কাজ করার ও মন্দ কাজ থেকে বেঁচে থাকার শক্তি নেই।

১৪. আজানের সময় : মাজমাউল জাওয়ায়েদ গ্রন্থের ১৮৮৪ নং হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন মুয়াজ্জিন আজান দেয়, আসমানের দুয়ার খুলে যায় ও দোয়া কবুল হয়।

১৫. আল্লাহর স্মরণে রাত্রি জাগরণকালে : মুসনাদে আহমদের একটি হাদিসে উল্লেখ হয়েছে, হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, যে মুসলিম আল্লাহর জিকির বা স্মরণের সঙ্গে রাত্রী জাগরণ করবে এবং দুনিয়া-আখিরাতের কোনো কল্যাণ চাইবে, তা তাকে দেওয়া হবে।

এছাড়া বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায় যে, রোগাক্রান্ত অবস্থায়, বালা-মুসিবতের সময়, দূরবর্তী সফরের সময়, অত্যাচারিত বা নির্যাতিত হওয়ার সময়, হজ পালন অবস্থায়, ইসমে আজম পাঠ পরবর্তী সময় এবং কদরের রাতে করা দোয়াও আল্লাহর দরবারে নিশ্চিতভাবে কবুল হয়।

পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ কি কেউ আছেন, যার কোনো চাওয়া নেই? নেই কোনো কমতি বা প্রয়োজন? এমন মানুষ  একজনও নেই। কোনোকালে ছিলও না। মানুষ মাত্রই প্রয়োজনের মুখাপেক্ষী। কমতি আর চাওয়া-পাওয়ার হিসেব-নিকেষে গড়া একটি সত্ত্বা। সুতরাং প্রত্যেক মুসলমানের উচিত একমাত্র আল্লাহ মহানের দরবারে বেশি বেশি দোয়া-মোনাজাত করা। কারণ আমরা এমন এক প্রভুর বান্দা— যিনি চাইলে খুশি; না চাইলে অ-খুশি। আল্লাহ মহান আমাদের সবাইকে উল্লেখিত ১৫টি সময়ে একমাত্র তার কাছেই দোয়া-মোনাজাত ও সব চাওয়া-প্রয়োজন ব্যক্ত করার নেক তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

 

Comment

লেখক পরিচিতি

মিরাজ রহমান

গতানুগতিক ধারার বাইরে থেকে কাজ করে ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন মিরাজ রহমান। পেশায় পুরোদস্তুর একজন সাংবাদিক হলেও কেবল ইসলামকে ঘিরেই আবর্তিত তার ধ্যান-জ্ঞান। দৈনিক পত্রিকার ইসলাম পাতায় লেখালেখি থেকে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন বটে, কিন্তু একসময় শিল্প চর্চায়ও ছিলেন বেশ মনোযোগী।
মিডিয়ায় সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেছেন যখন, তখনও তিনি ছাত্র। মাদানিনগর মাদরাসার কাফিয়া জামাতের (শ্রেণি) শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় কণ্ট্রিবিউটর হিসেবে প্রথম কাজ শুরু করেন দৈনিক যুগান্তরে। ধারালো লিখনী শক্তি অল্পদিনের মধ্যে পরিচিত করে তোলে তাকে। দেশের জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রায় সবগুলোতেই ইসলামবিষয়ক কলাম ও ফিচার লিখেছেন দীর্ঘ সময়। জাতীয় প্রিন্ট মিডিয়াগুলোতে তার অন্তত দুই সহস্রাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
মিরাজ মূলত পড়াশুনা করেছেন কওমি শিক্ষাধারায়, এর পাশাপাশি তিনি জেনারেল শিক্ষাধারায়ও পড়াশুনা করছেন। সহ-সম্পাদক হিসেবে প্রথম যোগদান করেন দৈনিক ডেসটিনি পত্রিকায়। সেখান থেকে দৈনিক কালের কণ্ঠে। দেশে-বিদেশে অনলাইন গণমাধ্যমের জয়যাত্রা শুরু হলে মিরাজ ইন্টারনেট জগতকে ইসলাম প্রচারের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র বিবেচনা করে অনলাইনেই গাঁটছাড়া বাঁধেন। দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইসলামবিষয়ক অনলাইন পোর্টাল প্রিয়.কমের ‘প্রিয় ইসলাম’-এর সৃষ্টি ও পথচলার সূচনা তারই হাতে। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন প্রিয়.কমের প্রিয় ইসলাম বিভাগের এডিটর ইনচার্জ। সর্বশেষ কর্মরত ছিলেন দৈনিক বাংলাদেশের খবরের ফিচার ইনচার্জ হিসেবে।
টেলিভেশনে অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা ও আলোচনার সঙ্গেও ইতিমধ্যে যুক্ত হয়েছেন মিরাজ রহমান। পরিচালনা করেছেন বেশ কিছু অনুষ্ঠানও। এসো কলম মেরামত করি, ছোটদের নবী-রাসূল সিরিজ, তাবলিগী জামাতের পৃষ্ঠপোষক-মুরুব্বি ছিলেন যাঁরা, শরয়ী পর্দার বিধান, আশিক মিন ফিলিস্তিন, নারী তুমি সৌভাগ্যবতী ও হালাল ব্যবসা ও হালাল অর্থনীতির কথকতাসহ বেশ কিছু আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থেও জনক তিনি। বর্তমান তিনি ইসলাম প্রতিদিনের সম্পাদক ও প্রকাশক এবং দ্য সুলতান প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।