গবেষণা

শব্দে শব্দে দীন শেখা : আমির


আমির মানে যেহেতু একজন নেতা, আমির শব্দের অর্থ যেহেতু একজন পথপ্রদর্শক এবং আমির শব্দটির সাথে যেহেতু অঙ্গাঅঙ্গিভাবে অনুসরণ, আনুগত্য ও অনুকরণের কিছু বিষয় জড়িত রয়েছে সুতরাং কাকে আমির মানা যাবে এবং কাকে আমির মানা যাবে না এ ব্যাপারে ইসলামের কিছু দিক-নির্দেশনা রয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে প্রথম ও সর্বোচ্চ আমির মূলত আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। এ মর্মে ইসলামে তিনটি দিক নির্দেশনা রয়েছে-


মাওলানা মিরাজ রহমান : আমির শব্দটি আরবি। অর্থ সেনাপতি, শাসক, নেতা, গোত্রপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান এমনকি কোনো একটি বিশেষ দলের প্রধানের ক্ষেত্রেও আমির শব্দটির ব্যবহার দেখা যায়। শব্দটি মূলত একটি ইসলামি পরিভাষা। হাদিস শরিফে বিভিন্ন জায়গায় শব্দটি রাষ্ট্রপ্রধান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে (আল মুজামুল ওয়াসিত, বুখারি, কিতাবু ফাদাইলিস সাহাবা: বাব: ৮; মুসনাদ, ১ম খণ্ড ১০৯ পৃ.)। সাকিফার সম্মেলনের বিবরণে ‘আমির’ বিশেষণটি মুসলিম রাষ্ট্রের প্রধান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে (আত তারাবী, ১ম খণ্ড)।

আমির হল মুসলিম বিশ্বে ব্যবহৃত একটি উচ্চ প্রশাসনিক পদবি। আমিরের শাসনাধীন অঞ্চলকে “আমিরাত” বলা হয়। আরবি শব্দ আমিরের আক্ষরিক “নেতা”। স্ত্রীবাচকে একে “আমিরা” বলা হয়। আমির দ্বারা সাধারণ অর্থে নেতা বোঝালেও এটি দ্বারা শাসক বা গভর্নরও বোঝানো হয়, বিশেষত ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে। ১৫৯৩ সালে ফরাসি এমির থেকে এটি ইংরেজি ভাষায় প্রবেশ করে। শুরুর দিকে আমির পদবিটি সামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হত। পদবি ছাড়াও আমির শব্দটি মুসলিমদের মধ্যে ব্যক্তি নাম হিসেবে প্রচলিত। এছাড়াও বাংলাদেশে ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের প্রধান ব্যক্তিকেও আমির বলা হয়। তাবলীগ জামাত প্রধানকেও আমির বলা হয়। (উইকিপিডিয়া, শব্দ : আমির)

আমির একটি মর্যাদাসূচক উপাধি। মুগল বা মুগল-পূর্ব যুগে এ উপাধি মুসলিম রাষ্ট্রের একজন উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাকে দেওয়া হতো। মুসলিম অভিজাত সমাজে আমির উপাধি সিপাহসালার এবং মালিকের মধ্যবর্তী অবস্থানে ছিল। বুগরা খান তাঁর পুত্র কায়কোবাদকে (দিল্লির সুলতান, ১২৮৭-১২৯০ খ্রি.) উপদেশ প্রদানকালে সামরিক সংগঠনকে নিম্নরূপে বর্ণনা করেন, একজন সর-ই-খইল এর অধীনে দশজন অশ্বারোহী সৈন্য, একজন সিপাহসালার দশজন সর-ই-খইল পরিচালনা করেন, দশজন সিপাহসালারের ওপর একজন আমীরের কর্তৃত্ব, একজন মালিকের কর্তৃত্ব রয়েছে দশ জন আমিরের ওপর এবং একজন খান, দশজন মালিকের বাহিনী পরিচালনা করেন। সুতরাং একজন আমির কমপক্ষে ১০০০ অশ্বারোহী সৈন্য পরিচালনা করতেন। আকবরের সময়ে প্রাদেশিক শাসককে আমিরও বলা হতো। (বাংলাপিডিয়া, শব্দ : আমির, লেখক : আবদুল করিম)

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিভিন্ন শাসনামলে আমীরদের কর্মপরিধি বা ক্ষমতার গণ্ডি বিভিন্ন ছিল। যেমন উমাইয়্যা শাসনামলে আমীরদের দায়িত্ব ছিল সৈন্য বাহিনীকে সংগঠিত করা, আরীফ নিযুক্ত করা, নিজ নিজ ইউনিটের লিখিত বিবরণ সংরক্ষণ করা, নিয়ম শৃ´খলা রক্ষা করা, বেতন প্রদান করা ইত্যাদি। এছাড়া আমীর সে সময়ে নিজে অথবা তাঁর প্রতিনিধি দ্বারা অভিযান পরিচালনা করতেন, চুক্তি সম্পাদন করতেন, সালাতের ইমামতি করতেন, মসজিদ নির্মাণ করতেন, বিজিত অঞ্চলে ইসলাম প্রচার ও প্রসারের তত্ত্বাবধান করতেন এবং কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সব সময়ই কাজী নিযুক্ত করতেন। আব্বাসী শাসনামলে আমীরের ক্ষমতা কিছু হ্রাস পায় এ সময় (ডাক বিভাগ কর্মকর্তার) গুরুত্ব ও ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল তারা আমীরের কর্মকাণ্ড ও প্রদেশের অবস্থা সম্পর্কে খলীফাকে প্রতিবেদন প্রেরণ করতেন। কাজী সরাসরি খলীফা কর্তৃক মনোনীত হতেন বিধায় তারা কার্যত আমীরের অধীন ছিলেন না। এ সময় আমীরের কার্যকাল অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত হতো। সালজুকী, আয়্যুবী ও মামলুকদের শাসনামলে সর্বস্তরে সামরিক কর্মকর্তাদেরকে আমীর উপাধি দেওয়া হতো। ইব্ন জামাআ (মৃ. ৭৩৩/১৩৩৩)-এর বর্ণনায় এ পরিবর্তন সম্পর্কীয় আলোচনা রয়েছে। তিনি বর্ণনা করেন যে, তাঁর সময় সে সকল সামরিক কর্মকর্তাকে আমীর বলা হতো যাদেরকে সৈন্যদল সংরক্ষণের জন্য জায়গীর প্রদান করা হতো। তাদের প্রধান দায়িত্ব ছিল সামরিক ব্যাপারে সহায়তা করা। (মুহাম্মাদ আসাদুজ্জামান রচিত ইসলামী শব্দমঞ্জুষা)

আমির মানে যেহেতু একজন নেতা, আমির শব্দের অর্থ যেহেতু একজন পথপ্রদর্শক এবং আমির শব্দটির সাথে যেহেতু অঙ্গাঅঙ্গিভাবে অনুসরণ, আনুগত্য ও অনুকরণের কিছু বিষয় জড়িত রয়েছে সুতরাং কাকে আমির মানা যাবে এবং কাকে আমির মানা যাবে না এ ব্যাপারে ইসলামের কিছু দিক-নির্দেশনা রয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে প্রথম ও সর্বোচ্চ আমির মূলত আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। এ মর্মে ইসলামে তিনটি দিক নির্দেশনা রয়েছে-

এক. ইসলামের জীবন ব্যবস্থায় আসল আনুগত্য লাভের অধিকারী হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ। একজন মুসলমানের সর্বপ্রথম পরিচয় হচ্ছে সে আল্লাহর বান্দা। এরপর সে অন্য কিছু। মুসলমানের ব্যক্তিগত জীবন এবং মুসলমানদের সমাজ ব্যবস্থা উভয়ের কেন্দ্র ও লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য করা ও বিশ্বস্ততার সাথে তাঁর নির্দেশ মেনে চলা। অন্যান্য আনুগত্য ও অনুসৃতি কেবল মাত্র তখনই গৃহীত হবে যখন তা আল্লাহর আনুগত্য অনুসৃতির বিপরীত হবে না। বরং তার অধীন ও অনুকূল হবে। অন্যথায় এই আসল ও মৌলিক আনুগত্য বিরোধী প্রতিটি আনুগত্য শৃংখলকে ভেঙ্গে দূরে নিক্ষেপ করা হবে। এ কথাটিকেই নবি (সা.) বলেনে, অর্থাৎ স্রষ্টার নাফরমানি করে কোনো সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না। (আল হাদিস)

দুই. ইসলামি জীবন ব্যবস্থার দ্বিতীয় ভিত্তি হচ্ছে, রাসূলের (সা.) আনুগত্য। এটি কোনো স্বতন্ত্র ও স্বয়ং সম্পূর্ণ আনুগত্য নয়। বরং আল্লাহর আনুগত্যের এটিই একমাত্র বাস্তব ও কার্যকর পদ্ধতি। রাসূলের (সা.) আনুগত্য এ জন্য করতে হবে যে, আল্লাহর বিধান ও নির্দেশ আমাদের কাছে পৌঁছার তিনিই একমাত্র বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। আমরা কেবলমাত্র রাসূলের (সা.) আনুগত্য করার পথেই আল্লাহর আনুগত্য করতে পারি। রাসূলের (সা.) সনদ ও প্রমাণপত্র ছাড়া আল্লাহর কোন আনুগত্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আর রাসূলের (সা.) আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নামান্তর। হাদিসে এই বক্তব্যটিই সুস্পষ্ট করেছেন আমাদের নবি (সা.) যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করলো সে আসলে আল্লাহর আনুগত্য করলো এবং যে ব্যক্তি আমার নাফরমানি করলো সে আসলে আল্লাহর নাফরমানি করলো। (আল হাদিস)

তিন. উপরোল্লিখিত দু’টি আনুগত্যের পর তাদের অধীনে তৃতীয় আর একটি আনুগত্য ইসলামি জীবন ব্যবস্থার আওতাধীনে মুসলমানদের ওপর ওয়াজিব। সেটি হচ্ছে মুসলমানদের মধ্যে থেকে ‘উলিল আমর’ তথা দায়িত্ব ও ক্ষমতার অধিকারীদের আনুগত্য। মুসলমানদের সামাজিক ও সামষ্টিক কার্যকলাপের ক্ষেত্রে দায়িত্ব সম্পন্ন ও নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি মাত্রই ‘উলিল আমর’-এর অন্তর্ভুক্ত। তারা মুসলমানদের মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও চিন্তাগত ক্ষেত্রে নেতৃত্বদানকারী উলামায়ে কেরাম বা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ হতে পারেন, আবার দেশের শাসনকার্য পরিচালনাকারী প্রশাসকবৃন্দ হতে পারেন অথবা আদালতে বিচারের রায় প্রদানকারীও হতে পারেন। মোটকথা যে ব্যক্তি যে কোনো পর্যায়েই মুসলমানদের নেতৃত্বদানকারী হবেন তিনি অবশ্যি আনুগত্য লাভের অধিকারী হবেন। তার সাথে বিরোধ সৃষ্টি করে মুসলমানদের সামাজিক জীবনে বাধা-বিপত্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা যাবে না।

একটি হাদিসে এসেছে, নিজের নেতৃবৃন্দের কথা শোনা ও মেনে চলা মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য, তা তার পছন্দ হোক বা না হোক, যে পর্যন্ত না তাকে নাফরমানির হুকুম দেয়া হয়। আর যখন তাকে নাফরমানির হুকুম দেয়া হয় তখন তার কিছু শোনা ও আনুগত্য করা উচিত নয়। (বুখারি ও মুসলিম)

আরো একটি হাদিসে এসেছে, আল্লাহ ও রাসূলের নাফরমানির ক্ষেত্রে কোন আনুগত্য নেই, আনুগত্য করতে হবে শুধুমাত্র ‘মারুফ’ বা বৈধ ও সৎকাজে। (বুখারি ও মুসলিম)

পবিত্র কোরআনে সুরা নিসার ৫৯ নম্বর আয়াতে আল্লাপাক ইরশাদ করেছেন, হে ঈমানদারগণ! আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রাসূলের আর সেই সব লোকের যারা তোমাদের মধ্যে দায়িত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী। এরপর যদি তোমাদের মধ্যে কোন ব্যাপারে বিরোধ দেখা দেয় তাহলে তাকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। যদি তোমরা যথার্থই আল্লাহ ও পরকালের ওপর ঈমান এনে থাকো। এটিই একটি সঠিক কর্মপদ্ধতি এবং পরিণতির দিক দিয়েও এটিই উৎকৃষ্ট। (সুরা নিসা: আয়াত ৫৯)

ইসলামি জীবন ব্যবস্থায় আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের সুন্নাত হচ্ছে মৌলিক আইন ও চূড়ান্ত সনদ মুসলমানদের মধ্যে অথবা মুসলিম সরকার ও প্রজাদের মধ্যে কোন বিষয়ে বিরোধ দেখা দিলে তার মীমাংসার জন্য কোরআন ও সুন্নাতের দিকে ফিরে আসতে হবে। কোরআন ও সুন্নাত এ ব্যাপারে যে ফায়সালা দেবে তাঁর সামনে মাথা নত করে দিতে হবে। এভাবে জীবনের সকল ব্যাপারে কোরআন ও রাসূলের সুন্নাতকে সনদ, চূড়ান্ত ফয়সালা ও শেষকথা হিসেবে মেনে নেয়ার বিষয়টি ইসলামি জীবন ব্যবস্থার একটি বৈশিষ্ট্য।

সৌজন্যে : প্রিয়.কম

Comment

লেখক পরিচিতি

আবদুল্লাহ মারুফ

আমি আবদুল্লাহ মারুফ। বর্তমানে অধ্যয়নরত আছি আল বায়ান অ্যারাবিক লানিং সেন্টারে। পাশাপাশি নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি হেরার জ্যোতি ও মাসিক ঘাসফড়িঙ -এর। পড়াশুনা, লেখালেখি আর ঘুরে বেড়ানো এই আমার ছোট্ট জীবন। ইসলাম প্রতিদিনের সাথে আছি কন্ট্রিবিউটিং রাইটার হিসেবে।

কমেন্টস করুন